“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় সায়ন্তনী দাশ সান্যাল
আমার রবীন্দ্রনাথ: এক অনন্য প্রতিবাদী স্বত্বা
টেকটাচটক ওয়েবজিনে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কে লেখা দিতে পারাটা বেশ শ্লাঘার বিষয়।অল্প সময়ের মধ্যেই এই ওয়েবজিনটি নানান গুণী ও প্রতিভাবান ব্যক্তিদের বিকাশক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।
আমার লেখার শিরোনাম ‘ রবীন্দ্রনাথ: এক অনন্য প্রতিবাদী স্বত্বা’। প্রতিনিয়ত এই মহামানব আমাদের আত্মাকে স্পর্শ করে যাচ্ছেন তাঁর গান, কবিতা, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধের মাধ্যমে। তাই আমি যদি আমার আনন্দে দুঃখে তাঁর ভূমিকাকে আলোচনার বিষয় করতাম
তাহলেও অপ্রাসঙ্গিক হতোনা, বরং অনুভূতির সজীবতাকে তুলে ধরতে পারতাম। কিন্তু এক অনন্য রূপে তাঁকে জানতে সাধ জাগে বৈকি।
রবীন্দ্রনাথ মানবপ্রেমিক।
তাঁর অনুভূতিপ্রবণ মন তাই বিদ্রোহ করে উঠেছে যখনই মানবতার উপর, মানব সভ্যতার উপর বর্বরতা তাঁর খড়্গ উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। তিনি তাঁর কলমকেই ব্যবহার করেছেন প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে। সে সাহসের তুলনা যেন আজও পাইনা। ঔপনিবেশিক পরাধীন এক দেশের কবির বুকে এমন দৃঢ়তা সত্যিই আশ্চর্যের। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু আদপেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেননা। বরং তিনি বোধহয় রাজনীতির থেকে দূরে সরে থাকতেই চেয়েছিলেন। তাঁর স্বদেশপ্রেম ছিল সাধারণের বোধের বাইরে।
রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক মতামতের প্রকাশ পায় বঙ্গভঙ্গের সময় (১৯০৫ খ্রি) থেকে। লর্ড কার্জনের বাংলাভাগের যুক্তি কবি কিছুতেই মানতে পারেননি। বাঙালী জাতির মেরুদন্ড ভঙ্গ করার যে ন্যক্কারজনক পদক্ষেপ ইংরেজ প্রশাসক নিয়েছিল তার প্রতিবাদে কবি শুধু কলমই ধরলেননা, সভা-সমিতি, গণ মিছিল, বিভিন্ন সমাবেশে বক্তব্য রাখা প্রভৃতি কার্যকলাপের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করলেন। আসলে সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন রূপকে প্রত্যক্ষ করে তীব্র ঘৃণার বোধ তাঁর মধ্যে সোচ্চার হয়ে উঠলো। এই সময় স্বদেশ বন্দনা করে তিনি একেরপর এক গান লিখলেন। যেমন, বাংলার মাটি বাংলার জল, এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে জয় মা বলে ভাসা তরী, বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান তুমি কি এমনি শক্তিমান- এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার দিন (১৬ই অক্টোবর, ১৯০৫ খ্রি) কবি এক অভূতপূর্ব কার্যসূচি গ্রহণ করলেন। রাখিবন্ধন কর্মসূচি। কবির সঙ্গে ছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী।। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে হাতে রাখি পরিয়ে তিনি বাঙালী জাতিস্বত্বা কে ঐক্যবদ্ধ করলেন। আসলে স্বদেশ মানে কবির কাছে ছিল ঐক্যবদ্ধ জাতিচেতনা। এরপর স্বদেশী আন্দোলনকে সমর্থন করতে দেখি তাঁকে। স্বদেশী সমাজ গঠন ছিল তাঁর স্বপ্ন।
কিন্তু এর পরেই স্বদেশী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হিন্দু মুসলিম সংঘর্ষ , জোর করে চাপিয়ে দেয়া স্বদেশিয়ানা তিনি মানতে পারেননি। অহিংস রাজনীতিতে বিশ্বাসী মানবদরদী কবির বুকে প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র মানুষটির দুঃখ বাজলো, যখন কম মূল্যের বিলাতি কাপড়ের পরিবর্তে বেশি দাম দিয়ে তাকে দেশী বস্ত্র কিনতে জোর করা হয়। তাঁর চেতনা এই সময় দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের থেকে দূরে সরে গিয়ে ছিল। সেইখানে তিনি হয়ে যান নিঃসঙ্গ। তাঁর বিশ্বাস ও আদর্শের কথা ফুটে ওঠে ১৯১৫ সালে প্রকাশিত ‘ঘরেবাইরে’ উপন্যাসের নিখিলেশ চরিত্রের মাধ্যমে। দরিদ্র প্রজার উপর চাপিয়ে দেওয়া স্বদেশিয়ানার প্রতিবাদে যাঁর ঘর ধ্বংস হয়ে যায়।নিখিলেশ যেন কবিরই নির্জন প্রতিবাদী সত্বার আদর্শ প্রতিরূপ। স্রোতের বিপরীতে গিয়ে কবি লেখেন,’ খদ্দর পরা দেশই যে সমগ্র দেশের আদর্শ এ কথা আমি কোন মতেই মানতে পারিনা।’