সেই ছোটোবেলার কথা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের সাথে তাল মিলিয়ে স্টেজে আমার জীবনের প্রথম নাচের প্রোগ্রাম। দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী তখন আমি। কিরণমাসি, যে আমাদের স্কুলে খাবার জলের আর আনুষঙ্গিক কাজ-কর্মের দায়িত্বে ছিলো, একদিন সোজা আমাদের ক্লাসে ঢুকে বললো, ” এই ক্লাসে জবা নামে কেউ থাকলে এক্ষুনি রাধা দিদিমনির সাথে দেখা করো। ” বেশ ভয় পেয়ে এদিক ওদিক তাকালাম বন্ধুদের দিকে। কারন, রাধা দিদিমনি আমাদের কোনো ক্লাসই নিতেন না। তবে আমাকে ডাকলেন কেন? নিশ্চয়ই কোথাও কিছু ভুল করেছি। ভয়ে ভয়ে শুকনো মুখ নিয়ে ‘টিচার্স কমনরুমে’ গেলাম। দিদিমনি তো আমাকে দেখেই হাসি হাসি মুখে বললেন, “আয় , ভেতরে আয়।” আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার দিকে বেশ ভালো করে একবার তাকিয়ে বললেন ,” আমি তোকে একটা নাচের প্রোগ্রামে নিতে চাই। কাল থেকে স্কুলের পর আমি তোকে নাচ শেখাবো।” ঐটুকু বলেই আমার হাতে একটা সাদা খাম ধরিয়ে দিয়ে বললেন,”এটা তোর বাবা-মা’এর জন্য। এই প্রোগ্রামের ব্যাপারে।”
নাচ? আমি পারবো? ভয়ে ভয়ে মা’কে বললাম। শুনেই মা চোখ নাচিয়ে একগাল হাসলো। আমার মা’এর আবার নাচ-গানের প্রতি ভীষণ উৎসাহ। কাজেই — পরদিন থেকে শুরু হলো প্রাকটিস ” এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে —” স্কুলের গানের টিচার আর দু’টো মেয়ে মিলে গাইলো খালি গলায়। শুরু হলো আমার গানের তালকে পায়ের তালে অনুভব করার শিক্ষা। নাহ, গানের কিচ্ছু বুঝিনি।অনেকবার শোনার পর শুধু সুরটা ভালো লেগে গেছিলো।
সেদিন ছিলো ২৫শে বৈশাখ।আমাদের স্কুলে বেশ বড় করে কবিগুরুর জন্মদিন পালন করা হলো বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে। জন্মদিনে আমার বাবার কিনে দেয়া একটি সবুজ শাড়ি পড়ে আমি নেচেছিলাম এখনো মনে আছে। মা খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছিলো আমায়।পায়ে আলতা, চোখ এঁকে দিয়েছিলো বড় বড় করে আর মাথায় পরিয়ে দিয়েছিলো সাদা ফুলের মালা। সেই দিনগুলোতে ক্যামেরার বালাই ছিল না। তাই মন হাতড়ে স্মৃতিটাকে সতেজ করে নিতে হচ্ছে বার বার। বেশ অনেকটা সময় ধরে চলেছিল আমাদের স্কুলের অনুষ্ঠান। আমার নাচটি ছিল শেষের দিকে। আমার মা আর কাকিমা গিয়েছিলো। এখনো যেন কানে বাজে সেই প্রথম দিনের নাচের শেষের হাততালির আওয়াজ। নাচের প্রথম পুরস্কারটি পেয়েছিলাম আমি। স্কুল থেকে আমাকে দিয়েছিলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “বিসর্জন” বইটি।
বাড়ি ফিরে গিয়ে সেদিন বইটি বারবার দেখলাম। মা’কে বললাম, “ওরা কিচ্ছু জানে না, মা। ” মা তো অবাক ! বললাম, রাধা দিদিমনি বলেছে আমি যে গানের সাথে নেচেছি, সেটি ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান। এখন এই বইয়ের উপরেও লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এটা কেমন করে হতে পারে? আমি স্কুল শুরু করেছিলাম পাঁচ বছর বয়সে। কাজেই দ্বিতীয় শ্রেণীতে হলেও ছয় বছর বয়সে আমার পক্ষে বোঝা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল একই লোকের নাম গানেও, আবার গল্প বইয়ে কি করে হতে পারে।মা তো আমার কথা শুনে প্রথমে হাসলো। তারপর আমাকে নিয়ে বসে অনেক কথা বললো রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। প্রথম জানলাম যেন ওই নামের পেছনের সত্যিকার মানুষটিকে। উৎসাহ বেড়ে গেলো গল্প বইটি পড়ার জন্য। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মা বইটি পড়তে দেয়নি সেদিন। আরেকটু বড় হলে পড়তে দেবে বলে আমার হাত থেকে নিয়ে আলমারিতে তুলে রেখে দিয়েছিলো। এ প্রসঙ্গে একটু বলে রাখি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর “বিসর্জন’ গল্পটি লিখেছিলেন ত্রিপুরার উদয়পুরের মাতাবাড়ির পুজোর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে l
ধীরে ধীরে বড় হতে হতে রবীন্দ্রনাথের গানের সাথে নাচলাম অনেক , কবিতা আবৃত্তি করলাম, গান করলাম। কবিগুরুর হাত ধরেই বড় হলাম বলা যায়। মনের ঘরে স্হাপিত হয়ে গেলো রবিঠাকুরের আসন। নিত্য দিনের আরাধনা তাঁকে ছাড়া ভাবা যেত না একসময়। গানে গানে অন্তরের গহীনে তাঁর চলা —আর এর অনুভবেই পেতাম এবং আজও পাই এক প্রশান্তি। যাঁকে দেখিনি কোনোদিন, অনুভবে যাঁর বিচরণ জীবন জুড়ে, সে শুধু আমার একান্ত আপন রবিকবি। তাঁর জন্মদিনে তাঁকে জানাই আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শ্রদ্ধা ভালোবাসা। তাঁর চরণে জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম l
“আমি তাঁরেই খুঁজে বেড়াই যে রয় মনে আমার মনে
সে আছে ব’লে
আমার আকাশ জুড়ে ফোটে তারা রাতে,
প্রাতে ফুল ফুটে রয় বনে আমার মনে।“