“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় দেবশ্রী ভট্টাচার্য
by
·
Published
· Updated
একটি প্রশ্ন ও রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ সেই কোন এক শিশুকালে । সহজ পাঠেরও আগে। আমদের স্কুলের গেট পেরিয়েই একটা বেশ বড় হলঘর ছিল। সকাল দশটায় সেই হলঘরে প্রার্থনা হত। কিন্তু তারও আগে স্কুলে পা দেওয়ার ঠিক সাথে সাথে আমাদের এক অলিখিত নিয়ম ছিল, হলঘরের দেওয়ালে ঝোলানো মনিষীদের ফটোর নিচে ঢকাশ করে মাথা ঠোকা। কে যে এই নিয়ম করেছিল জানা নেই, তবে সবাই করত তাই আমিও করতাম এবং চুলের বিনুনি ঘাড় ছাড়িয়ে কোমর অবধি যাওয়া পর্যন্ত এই নিয়ম বলবত ছিল। রবীন্দ্রনাথের সাথেও আলাপ এইভাবেই। তারপর রবিন্দ্রনাথ বার বার এসেছেন, কখনো পাঠ্য বইয়ের পাতায় কখনো প্রার্থনা সঙ্গীতে , কখনো রবীন্দ্র জয়ন্তীতে বলা আবৃত্তিতে । কিন্তু তখনো বোধহয় ধারণা করার পর্যায়ও পৌছতে পারিনি যে এ তো শুধু সমুদ্রের গর্জন শুনেছি মাত্র! সমুদ্র এখনো অনেক দূরে।
আরো বহু পরে আলাপ হল রবীন্দ্রনাথের জীবন দেবতার সাথে। বুঝলাম ,এতদিন ঠিক কিছুই বোঝা হয়নি। যে ‘ আগুনের পরশমণি’ – গানটা প্রায় রোজ চিৎকার করে প্রার্থনার সময় সুরে বেসুরে গাইতাম। সেই গানটাও যেন নতুন করে দেখা দিল। বুঝলাম , সাদা চোখে যা দেখা যায় তাই শুধু সত্যি নয়। তার পিছনেও আরেকটা সত্যি আছে। আরো ভালো করে বলতে গেলে বলতে হয়, যা সত্যি ছিল, তাতো চোখের সামনেই ছিল, শুধু দেখার চোখ তৈরি হয়নি। সেই দেখার চোখ কি আজও তৈরি হয়েছে! মনে হয় না। আজও রবীন্দ্র রচনাবলীর পাতা ঘাঁটলে মনে হয়, এত নোট বই ঘেঁটে , এত আলোচনা, সমালোচনার বই ঘেঁটেও ভদ্রলোককে যেন চেনা হয়নি ঠিক ভাবে।
রবীন্দ্র রচনার মূলে আছে তাঁর জীবন দেবতা। ভারতীয় দর্শনের মূল আধার ‘সো অহম্’ তত্ত্ব । একই পরম পুরুষ থেকে এই পৃথিবীর সমস্ত জীব সমস্ত অণু পরমাণুর সৃষ্টি । সেই পরম পুরুষের ব্যাপ্তি তাই এই পৃথিবীর কোণায় কোণায়। আমরাও সেই পরম পুরুষের অংশ । সেই বিশাল শক্তিপুঞ্জ আমাদের মধ্যেও বিদ্যমান। নিজের ভেতরের সেই শক্তিকে যখন মানুষ চিনতে পারে, তখনই তার মোক্ষ প্রাপ্তি হয়। মৃত্যুর ভয় থাকে না, দুঃখের অনভুতিও হয় না। এই তত্ত্বই রবীন্দ্রকাব্যে জীবন দেবতা। এই জীবন দেবতা কখনো এসেছেন নারী রূপে , কখনো পুরুষ। ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতায় এই জীবন দেবতা এসেছেন নারী রূপে, নৌকার কাণ্ডারি রূপে তিনি কবিকে নিয়ে যেতে চান অনেক দূরে কোথাও। আবার ‘জীবন দেবতা’ কবিতায় তিনি এসেছেন পুরুষ রূপে।
এসব ছেড়ে দিলাম। আমাদের অতি পরিচিত একটি গান সম্বন্ধে আলোচনা করি । আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণ মন অধিনায়ক’। রবীন্দ্রনাথকে চিনতে কত যে বাকি আছে শুধু এই গানটি আলোচনা করলেই বোঝা যায়। আজন্ম শেখা গানটি আরেকবার শুনিয়ে যদি প্রশ্ন করা হয় , এই গানে রবীন্দ্রনাথের জীবন দেবতা দেশ দেবতা হিসাবে ধরা পড়েছেন, কিন্তু এই দেবতা পুরুষ না নারী? দেশ বন্দনা ও ইশ্বর বন্দনা এখানে একাকার। ‘হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী’ নানা ধর্মের ও মানুষের ভারতভূমিতে যিনি ‘ জনগণ ঐক্য বিধায়ক’।
কিন্তু প্রশ্ন তো সেই একটাই। এই জীবন দেবতা, এখানে দেশ দেবতা পুরুষ না নারী? প্রথম স্তবকে রবীন্দ্রনাথ ‘অধিনায়ক’ বলেছেন , দ্বিতীয় স্তবকেও তাঁকে ঐক্য বিধায়ক বলেছেন। কিন্তু হঠাৎ করেই চতুর্থ স্তবকে বলেছেন
“ দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে রক্ষা করিলে অঙ্কে
স্নেহময়ী তুমি মাতা”।
সমগ্র গানে চতুর্থ স্তবকের অর্ধ ত্রিপদীতে একমাত্র ব্যাতিক্রম “স্নেহময়ী তুমি মাতা” – চরণটিতে ভারত বিধাতা আকস্মিকভাবে নারী সত্তায় রূপান্তরিত হয়েছেন । কীভাবে সম্ভব হল? একি তবে একটা ভুল! নাকি পঞ্চম স্তবকে , “ তব করুণারুণ রাগে নিদ্রিত ভারত জাগে
তব চরণে নত মাথা”।
এই ‘মাথা’র সাথে ছন্দ মেলানোর প্রয়াস মাত্র। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে কথাটা বোধহয় খাটে না। কবির পক্ষ নিয়ে বলা যেতে পারে ভারতবিধাতার হৃদয় মাতৃস্নেহের সনাতন সুধারসে আদ্র। দার্শনিকেরা হয়ত বলবেন দ্বৈতাদ্বৈতবাদের নিগুঢ় বিচ্ছ্বরণ । উত্তর আধুনিকতাবাদিরা বলবেন, এ হল উভ সত্ত্বা (uni- gender)। বৈষ্ণব তাত্ত্বিকের ভাষায় বলা যেতে পারে – ‘ না সো রমণ না হাম রমণী’ অর্থাৎ পুরুষও নয়, প্রকৃতিও বা নারীও নয়, শুধুই তত্ত্ব।
তবু প্রশ্নটা তো শেষ পর্যন্ত থেকেই যায়, ভারত ভাগ্যবিধাতা কি পুরুষ, না নারী নাকি অর্ধ নারীশ্বর? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর বোধ করি একমাত্র রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই দেওয়া সম্ভব।