“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় প্রকল্প ভট্টাচার্য
by
·
Published
· Updated
আমার রবীন্দ্রনাথ
পঁচিশে বৈশাখ আসছে। বাঙ্গালির গর্ব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুদিন। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। জন্মদিন নয়, মৃত্যুদিন। প্রতি বছর এই দিনটিতে তাঁর আদরের দেশবাসীর হাতে তাঁর মৃত্যু ঘটে। হত্যা করা হয় তাঁকে তাঁর প্রাণপ্রিয় বাংলা দেশে এবং ভাষাতেই। সারা বছর অপ্রয়োজনেও ইংরিজি আওড়ানো বাঙ্গালিরা আসেন এই একদিন ‘টেগোর সং’ গেয়ে কৃচ্ছসাধন করতে। নিজেদের সংস্কৃতিবান প্রমাণ করবার জন্য তাঁরা নিজেদের জেন-এক্স ছেলেপুলেদের কোমরে ইলাস্টিক দেওয়া ধুতি পরিয়ে জোর করে স্টেজে তুলে “হেমোর্চিত্ত পূণ্যোতীর্থে জাগোরেধিরে…” আওড়াতে বলেন। হারমোনিয়াম প্যাঁপ্যাঁপিয়ে মৌলিক সুরে গাওয়া হয় “মরবি নাওঠে কোন্সুরে বাজিইইই!” জীবনে প্রথম, এবং সম্ভবতঃ শেষবার শাড়ি পরে কসরত করবার মতো কেঠো ভঙ্গীতে গণনৃত্য আয়োজিত হয় “পোস্তদের ডাক দিয়েছে আয়রে ছুটে আয় আয় আয়!” অথচ রবীন্দ্রনাথ কখনোই এইভাবে স্মরনীয় হতে চাননি। নিজের সৃষ্টি নিয়ে স্বাভাবিক স্পর্শকাতরতা ছিল তাঁর, সে গানের সুরেই হোক, বা নাটকের সংলাপে। নিয়ম ভেঙ্গে নতুন সৃষ্টির অজুহাতে অনর্থক, অতিরিক্ত এবং কখনো অশালীন সংযোজনের এই যে প্রতিযোগিতা চলছে এখন, তিনি চাননি এইভাবে সর্বত্রগামী হোক তাঁর রচনা। কখনো তাঁর সৃষ্টির আলোচনা ছেড়ে ব্যক্তিগত জীবনের অতিরঞ্জিত ঘটনার সঙ্গে মিথ্যা কুৎসা মিশিয়ে বাজারী জনপ্রিয়তার নেশায় মাতছে কিছু লেখক-প্রকাশক, কখনো বা তাঁর গানের কথা-সুর সহ লালিত্যের হত্যা করে, সেগুলি বিকৃত করে মোক্ষলাভের বৃথা আশা করছে কিছু সঙ্গীতকার। প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার নামে বর্তমান সমাজে প্রচলিত এই নোংরামীর মধ্যে কি বিশ্বকবির বন্দনা সম্ভব? জঞ্জাল দিয়ে কি দেব আরাধনা হয়? এই সর্বাঙ্গীন অসুস্থতা, এই অরাবীন্দ্রিকতা দেখে কবির ভাষাতেই বলে উঠতে বাধ্য হই, “দোহাই তোদের, একটুকু চুপ কর্।ভালোবাসিবারে দে আমারে অবসর।” আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ একজন ঋষিপ্রতিম কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকার-শিল্পী-শিক্ষাবিদ-পণ্ডিত-সমাজ সংস্কারক-দেশপ্রেমী ব্যক্তিমাত্রই নন, সমস্ত কিছু পার করে একটা উপলব্ধি, আর অনেকখানি ভালবাসা। আমাদের মনের গোপন গহ্বরে লুকোনো মণিমানিক্যের সন্ধান জানা এক জাদুকর। তাঁকে জানতে হয়, বুঝতে হয়। ঢাকঢোল বাজিয়ে তাঁকে জন্মদিনে শ্রদ্ধা না জানালেও চলে, কিন্তু আমৃত্যু নিজেদের জীবনে, মননে তাঁর শিক্ষা, তাঁর বিশ্বমানবপ্রেম, তাঁর প্রেম-পূজা-প্রকৃতির সঙ্গে আত্মস্থ হওয়া ঔদার্য যতোটা সম্ভব প্রয়োগ করতে হয়। তিনি রোজের অবলম্বন, রুজির বাহানা নন। মুখরতায় তাঁর পূজা হয় না, মৌনতাই তাঁর স্মরণের মন্ত্র। যদি সত্যিই রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করতে চান, তাহলে শুধু পঁচিশে বৈশাখই নয়, গোটা জীবনটাই পড়ে আছে আপনাদের সামনে। শ্রদ্ধায়, বিনয়ে, নতমস্তকে তাঁকে আরো জানুন, চিনুন। দুর্ভাগ্য, আমরা অধিকাংশ বাঙ্গালি দেড়শো বছরেও তাঁর আংশিক অথচ সঠিক মূল্যায়ণ করতে অক্ষম। হ্যাঁ, আজও।