“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় শুভশ্রী সাহা
নিভৃত প্রাণের ও দেবতা
ঠাকুর বড় গোলমেলে জিনিষ, তার থাকার জায়গা সিংহাসনে, ধূপ ফুল মালা ধুনো গঙ্গাজল সব নিয়েই নমো করার জায়গা। এ কেমন ঠাকুর যিনি পদ্য লেখেন! গান করেন। সে সময়ে রবীন্দ্র গান মানেই ভাবতাম বুঝি তিনিই গান করছেন যে পুরুষ কন্ঠেই শুনতে পেতাম না কেন। তাঁর সঙ্গে আলাপ সহজ পাঠের সহজ সুরের সাথেই, কিন্তু সেই বয়েসে আমরা বড় বউ, রাম, এ ওকারদের সাথেই বেশি বন্ধুত্ব করে নিয়েছিলাম। বুঝতে শিখলাম যেদিন, সেও আরো পরে ফাইভ সিক্সের আগে তেমন করে মন তো টানে নি সত্যি করে। শুধু সুরেলা গান আর
ছন্দ কবিতাগুলো ছোট্ট মনেও দাগ কেটে যেত। তার পর মেয়েবেলায় সিংহাসন তার জন্য হয়নি বটে আলাদা করে মার্বেলের, কিন্তু সত্যিকারের ঠাকুর যে থাকেন সেটি বুঝতে শিখলাম তার লেখার আলোতেই। ইনি সেই কল্পতরু ভগবান নন, ইনি আমাদের নিভৃত প্রাণের দেবতা। সেই প্রাইমারী থেকেই শুরু, কোথাও কিছু করে দেখিয়ে বাহবা পেতে সেই ঠাকুর, পরীক্ষায় বেশি নাম্বার পেতে সেই ঠাকুর, গান গুন গুনানিতেও সেই ঠাকুর ই। সামান্য একটু ছোঁয়াতেই ভালো হয়ে যায় বয়:সন্ধির মনখারাপের অলি গলি। কবির ছবির কাছে গিয়ে বসতেই , মনে হয় নদীর ধারাজলে সিক্ত হতে যে কত আনন্দ কে জানে আমার মতন–!! তুমি নব নব রুপে এসো প্রাণে
ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা–
এই ভালোবাসার শুদ্ধ স্বর প্রেম নয়, প্রেম থেকে গভীরে গিয়ে ভালোতে বসত করা। ঠাকুর বললেন হৃদয় আমার প্রকাশ হলো অনন্ত আকাশে, প্রেম তো শুধু একার, একজনের আর এই অনন্ত আকাশ, অনন্ত প্রেম, অনন্ত আশ্বাস তার কি হবে শুনি, আমার আমার করে এত অন্তর ইন্দ্রিয় আটকে রাখলে চলবে কি করে, মোহ তে অত আবিষ্ট কেন বাপু তোমার মন, কি করিলি মোহের ছলনে– না হা হুতাশ করতে হয়। তাই ভালোবাসা মানেই শুধুই কারুর সাথে ভালোতে বসত করা। আর কারুর কারুর সাথেই বা কেন, সকলের কথাই ভাবো। এত সব সাবধান বাণী শুনে বয়স সন্ধির মন খারাপীর দিন রাত গুলো দিব্যি কাটাতে পেরে গেছিলাম। কাব্য সাহিত্য কবিতা গান না জানলেও তাঁর কথা গুলি দিব্যি আউড়ে নিয়েও বেশ ভালো থাকাই যায়। এও এক বাঁচার জন্য অমোঘ গুরু মন্ত্র।—-” দয়া, তব দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে”
বাণী তব ধায় অনন্ত গগনে গগনে লোকে লোকে–
বাণী তোমার সুরে, কবিতায়, গল্পে উপন্যাসে ছায়াছবিতে, ছবিতে আজ বিশ্বের দরবারে ছড়িয়ে পড়েছে সত্যিই, তবু মনে হয় হৃদয়ের পথে কতদূর পৌছেছে, নিজের বাইরে কতখানি এগিয়েছে এই দর্শন বোধ? সব পুজোর ই মন্ত্র থাকে কিন্তু উচ্চারিত হয় কোন গভীরে তত টাই! আমরা প্রতিবছর জন্মদিন পালন করি সাড়ম্বরে কবিতা গান উৎসব আনন্দে, মনে রাখি তারপরেও কতটা প্রশ্ন থেকেই যায় কিন্তু। প্যাকেজে গাওয়া গানে, সিডির উৎসাহে, রবীন্দ্রগানের টিউশনে, কবিতার স্কুলে, ছবির নির্মাণে ছায়াছবির অভিনবত্বে রবীন্দ্রময় এ জীবন তবু হিংসা দ্বেষ মলিনতা র্যাটরেস, কম্পিটিশন , কিছুই ছাড়তে পারেনি এখনো। দৌড়ের গতিজাড্যে আমরা এখনো তার কাছে পৌছেতে পারিনি। রোদ্দুর রায় নামক বিষাক্ত করোনা ভাইরাসেও কিছু অজীর্ণ জীব যুক্তি খুঁজে চলে। বিশ্ব ভারতীও, তার জায়গায় ডানা মেলতে পারল কই! ঠাকুরের স্বপ্নের উড়ানে কে দিতে পারলো পাল তুলে! তার নোবেল টুকুও রক্ষা করতে পারেনি তার ই স্বপ্নের আশ্রম। বিশ্বভারতীর অঙ্গণে দাঁড়িয়ে উপাচার্য রাজনীতির কথা অক্লেশে উচ্চারণ করে চলে যান। শিক্ষকের নিয়োগ নীতি ঘুরপাক খেতে থাকে দলাদলির চক্করে। এই জন্য ই কি তিনি বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছিলেন? এই কি ছিল তার আশ্রমের রুপ ও বিকাশে প্রতিবিম্বিত ভারতের বৈদিক ধ্যানধ্যারণার সার্থক রুপায়ন!!
রবীন্দ্র সংস্কৃতি চর্চার প্রতিষ্ঠান , আলোচনা সভা বেড়েছে বহুগুণ,কাজ হচ্ছে তার উপর প্রচুর। বিশ্বভারতীর কপিরাইট উঠে গিয়ে ঘরে ঘরে পেপারব্যাক কভারে পৌছেছেন রবি ঠাকুর,এখনো তিনিই সব প্রকাশকের কাছে বেস্ট সেলার– তবু কত দূরে এখনো, আমি আমরা আর আমাদের রবীন্দ্রনাথ — দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে—