আজ এই সঙ্গনিরোধ জীবনে,ঘর জানালা এঁটে আমরা কারাটিনে বন্দী।প্রকৃতি কিন্তু আপন খেয়ালে হৈ হুল্লোর করছে রোজকার মত।কৃষ্ণচূড়া,শিরীষ ফুল পাঁপড়ি মেলে আলাপরত।জুঁই বা গন্ধরাজের আঘ্রান ঘুলঘুলি দিয়ে যখন ঢুকছে ঘরের মধ্যে- সেই গন্ধস্মৃতি বেয়ে অতীতে ফিরে যেতে চাইছে মন,বসন্ত দিবস,পহেলা বৈশাখের মত আরো একটা অনাড়ম্বর ভাবে কাটানো দিন আগত । অস্বস্তি হচ্ছে,অস্থির হয়ে উঠছি -আবার মনে হচ্ছে-এটার যেন দরকার ছিল-খুব দরকার ছিল-দশটার পাঁচটার ব্যস্ত জীবনে পঁচিশে বৈশাখ-ঐরকমই তো একটা দিন ছিল মাত্র।কিন্তু এইবার যেন অদ্ভূত এক ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজির হচ্ছে আমাদের সামনে- অনেকগুলো প্রশ্নও যেন তুলে তুলে দিল সে- সত্যিই কতটা রবীন্দ্রনাথকে বুঝেছি আমরা- কতদূর হেঁটেছি তার পথে-প্রয়োগে- নাকি ঘরের তাকে ধূলাবন্দী থেকে গেছে সে বছরের পর বছর।” কতবার ভেবেছিনু আপণা ভুলিয়া/ তোমারও চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া।”- কবিগুরুর কথা ধার নিয়েই আজ হৃদয়ের ঝাঁপি সত্যি খুলে দিতে ইচ্ছা করল।ডাউন মেমোরি লেনে হেঁটে আমার দীর্ঘ নাট্য যাপনে রবি ঠাকুর কতটা মিলে- মিশে থেকেছে তারই একটা খসড়া পাঠককে আমি দেওয়ার কিঞ্চিৎ চেষ্টা করছি মাত্র।
যে মফঃস্বল শহরে আমার বেড়ে ওঠা,সেই জায়গা ১৯৮৯ সালে- ( যখন আমার পাঁচ বছর বয়স ) ডোবা, খাল, ধান জমি আর আম, নারকেল, জাম,কাঁঠালের বাগান দিয়ে ঘেরা এক উদ্বাস্তু কলোনি।সেই ছোটবেলা থেকেই আমি দেখতাম এবং অনুভব করতাম- কলোনি জুড়ে ওয়াগন ব্রোকার,চোর,গুন্ডা,জুয়াবাজ মানুষগুলোর মাঝেই কিছু মানুষ আছে যাদের ঘরে সন্ধ্যেয় শাঁখের ডাকের সাথেই নিয়ম করে মেয়েরা গেয়ে উঠত-“হা রে রেরে রেরে” কিংবা “হে নূতন দেখা দিক আরবার”-এর মতন রবীন্দ্র সঙ্গীত,তবলার সঙ্গতে একটা অবাক করা মুগ্ধতা ভেসে যেত অড়হর খেতের ওপর দিয়ে দূর অন্ধকারে।তখন সবার বাড়িতে ইলেকট্রিক আসে নি।কূপি হ্যারিকেন জ্বলা অনাড়ম্বর ঘর গুলো থেকেশুনতে পেতাম “কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি” বা”তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে /সব গাছ ছাড়িয়ে” আর প্রায়ন্ধকার উঠোনে সন্ধ্যে থেকে রাত রিহার্সাল চলত নাটক- “ডাকঘর”। সামনে পঁচিশে বৈশাখ- মাচা প্যান্ডেল খটিয়ে যেটা মঞ্চস্থ হবে পাড়ার মাঠে।আমাদের নাটকের দল প্রতিবছর নিয়ম করে পালন করত ” রবীন্দ্র জয়ন্তি ও নাট্যোৎসব”-সে এক দারুণ মজার কান্ড।কচি-কাঁচা বড়োরা মিলে একটা জলজ্যান্ত চড়ুইভাতি।পঁচিশে বৈশাখের আগের দিন সারারাত জাগতাম সবাই।সারা রাস্তা, মঞ্চপ্রাঙ্গন জুড়ে লাগাতাম রবীন্দ্র মুখাবয়বের প্রতিকৃতি বা কবিতা নাটকের ভাঙ্গা অংশ।
আমার ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠা পুরোটাই রবীন্দ্রময়।একবার ডাকঘর নাটকে অমলও সাজতে হয়েছিল আমাকে।সেই যে জানালার শিক ধরে আর ঘরের চৌকিতে সারাক্ষণ বসে থাকা আর অবাক অবাক প্রশ্ন করা পিসেমশাইকে-
“আচ্ছা পিসেমশাই,কাজ কি খুঁজতে হয়?
– হয় বইকি।কত লোক কাজ খুঁজে বেড়ায়।
-বেশ তো আমিও তাদের মত কাজ খুঁজে বেড়াবো।
-খুঁজে যদি না পাও?
– খুঁজে না পাইতো আবার খুঁজবো।”
সংলাপগুলো যখন ছোটবেলায় বলেছিলাম,তখন আমার মনে হত-সত্যিই কোন কাজটা যে আমার সেটা আমাকে খুঁজতেই হবে।আবার এতদিন পর এই অতিমারি সময়ে-ট্রেনে হকারি করত এক দাদা এসে যখন জানালা দিয়ে জিজ্ঞাসা করে- কাজ খুঁজছি ভাই- কাজ আছে কোন? হঠাৎ চমকে উঠি-এতদিন পর এইরকম দ্যোতনা নিয়ে যে সংলাপটা ফিরে আসতে পারে আমার কল্পনাতেও আসে নি কোন দিন।অমল কিন্তু ছোট বেলাতেই বুঝত সেটা।অমল আরো বুঝত একা একা বাঁচা যায় না- সবাইকে সঙ্গে নিয়ে তাদের সাথে মিশে থেকে বাঁচতে হয়।
দইওয়ালাকে সে বলে- সে দই বেচে বেড়াতে পারলে খুব খুশি হয়,দই দই ভালো দই-আকাশের খুব শেষ থেকে পাখির ডাক শুনলে যেমন মন উদাস হয়ে যায়- দইওয়ালার ওই হাঁক দূর থেকে শুনে অমলের এক অবাক করা অনুভূতি হয়- যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।তাই সে বলে ওঠে-“কী জানি,কি মনে হচ্ছিল।” আবার যখন অমলের মনে হয় তার অন্ধ ও খঞ্জ ভিক্ষুকের চাকার গাড়িতে ভিক্ষুককে ঠেলে ঠেলে নিয়ে সে এদেশ- সেদেশ ঘুরে বেড়াবে- কিন্তু পিসেমশাই বলেন-‘ও মিথ্যে কানা,মিথ্যে খোঁড়া।’অমল তার ফকিরকে বলে ‘ও যেন মিথ্যা কানাই হোল কিন্তু ও চোখে দেখতে পায় না এটাতো সত্যি।’ তার ফকির তখন বলে ” ঠিক বলেছ বাবা, ওর মধ্যে সত্যি কেবল ওইটুকুই যে,ও চোখে দেখতে পায় না- তা ওকে কানাই বলো আর নাই বলো।”- এখন আমাদের মনে হয় না কি- আমরা তো সত্যি চোখ থাকতে দেখতে পাই না।তাকাই বটে।,কিন্তু দেখি কি? না হলে আমাদের চোখ এড়িয়ে কীভাবে মরে যায় লকডাউন ভারতবর্ষে হা-অন্ন পেটে দীর্ঘ দীর্ঘ পথ হেঁটে আসা পরিযায়ী শ্রমিকরা,কেন ডাক্তার- নার্সদের ইট- পাটকেল ছুঁড়ে মারি,তাদের ঢুকতে বারণ করি আবাসনে?
অমলের মতই আমাদেরও আজ ভারী অসুখ।কবিরাজের বিধান মেনেই আমরা আজ গৃহবন্দী,কিন্তু আমাদের চোখের সামনে রাজার ডাকঘর বসেছে।রাজার বার্তা কবে পাব- তীর্থের কাকের মতই অনন্ত অপেক্ষা এখন আমাদেরও।
পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথের তোতা কাহিনী গল্পটিকে বিনির্মান করে আমি” তোতা কাহিনী ” নাটকটি নির্মান করি- তোতার যন্ত্রনা রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করতাম স্কুল জীবনে। রাজা ও তোতার কাল্পনিক সংলাপ রচনার সময় আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার অসাড়তা তুলে ধরার চেষ্টা করি রবীন্দ্রনাথের চেতনা ধরেই।পেশাগত জীবনেও শিক্ষক হওয়ার জন্য-দেখতে পাই- দৈনন্দিন যাপনের সাথে মিশে আছে পুঁথি ও পুঁজি সর্বস্ব শিক্ষার মূলগত অসাড়তা- যা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্র কর্তৃক নির্দেশিত শিক্ষাপ্রণালীর সাথে ব্যক্তি মননের যোজন দূরত্ব তৈরীর মাধ্যমে।
তোতা বলে উঠছে- আমি এই খাঁচায় বন্দী হয়ে থাকতে পারছি না- আমাকে মুক্তি দাও রাজা।আমি উড়তে চাই।
রাজা বলছে- মূর্খ তোতা,তোমার ওড়াওড়ি বন্ধ।
তোতা বলে -আমি গান গাইতে চাই।
রাজা বলে-তোমার গান গাওয়াও বন্ধ- তুমি পড়বে- মুখগুঁজে কেবলই পড়বে।বহু অর্থ ব্যয়ে এই সোনার খাঁচা নির্মান করা হয়েছে,শুধু তোমার শিক্ষার জন্য।তুমি সেই খাঁচায় বসে বসে পুঁথি পড়ে পড়ে মহাপন্ডিত হয়ে উঠবে- তোমার বেয়াদপি আমি বন্ধ করে দেব।
আজ একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে পৌছেও সোনার খাঁচা আমরা আবার প্রত্যক্ষ করি আমাদের তথাকথিত আধুনিক শিক্ষা কাঠামো ও প্রণালীতে
এমনকি এই সংকটকালেও- অনলাইন শিক্ষা, ভিডিও অ্যাপসের মধ্য দিয়ে সেই অসাড় সিস্টেমগুলোকেই আমরা মান্যতা দিয়ে চলেছি।যেখানে আমাদের নব্বই শতাংশ শিক্ষার্থীর কাছে নেই স্মার্ট ফোন বা নেট কানেকশন,অথচ কিভাবে আমরা দূরত্ব তৈরী করে দিচ্ছি এক বন্ধুর সাথে আর এক বন্ধুর।হ্যাভস আর হ্যাভস নটের। এই সময়েও যদি রবিঠাকুরের কাছে হাত পেতে দাঁড়াতাম-যে সময় সবচেয়ে বেশী দরকার, ওনার চর্চার পথ – যে পথে শিক্ষার্থীরা সময়কে বুঝতে পারবে, অনুধাবন করতে পারবে,প্রকৃতিকে অনুভব করতে পারবে,আর ফুলের মত ফুটে উঠবে সৃষ্টির পথ- কবিতা, গানে,নাটকে, চিত্রকলায়।
আমরা বন্ধ করে রাখলাম সেই দেখানো পথ।অথচ ঠাকুর পূজোর মত গলায় মালা ও প্রতিকৃতিতে পুষ্প প্রদান নিয়ম মেনেই হল,হবে।একটা অন্তর্বর্তী শূণ্যতা গ্রাস করে আছে আমাদের নিদারুনভাবে।
প্রতিবছর নিয়মকরে একটি বা দুটি রবীন্দ্র নাটক বা রবীন্দ্র সাহিত্য অনুপ্রানিত নাট্য নির্মানের সুবাদে ঝুলিতে প্রচুর সম্পদ জমে আছে,যা পাঠকের কাছে পেশ করতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে বোধহয়।তাই এক রবীন্দ্র কবিতার বিনির্মিত নির্মানের প্রক্রিয়া ও চলন আলোচনা করে এই নিবন্ধের ইতি টানব আজকে।
” কথা “কাব্যগ্রন্থে কাশ্মিরী কবি ক্ষেমেন্দ্রের ” বোধি সত্ত্বাবদান কল্পলতা” অবলম্বনে “অভিসার” নামক কবিতা লেখেন।দুটি পৃথক ঋতুতে,দুটি পৃথক প্রেক্ষিতে বৌদ্ধ সন্যাসী উপগুপ্ত ও মথুরা নগরীর নগর নটী বাসবদত্তার কাহিনী।
ঘটনা দু’হাজার বছরের আগের হলেও,আমার মনে হয় আজকেও কী ভীষণভাবে তা জীবন্ত।ঘটনাচক্রে বুদ্ধের বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি ও রবীন্দ্রনাথের জন্ম যেন গা ঘেঁষাঘেঁষি করে আছে আর রবীন্দ্র দর্শনে গৌতম বুদ্ধের কী অমোঘ প্রভাব তা প্রতি ছত্রে ছত্রে দেখতে পেয়েছি রবীন্দ্র সাহিত্যে।যখন মানুষ মানুষকে আড় চোখে দেখতে শুরু করে- আমারই হাতে নিহত হয় ভাই – বোন – বন্ধু-পরিজন।পৃথিবীর এই গভীরতর অসুখে রবীন্দ্রনাথ পরিত্রান খুঁজেছেন বৌদ্ধ পথে- বুদ্ধের ত্রিশরন মন্ত্রে-তার অষ্টম মার্গে।তাই তার সাহিত্যে বৌদ্ধ সন্যসীরা স্ব্য়ং মানবিকতার প্রতিভু,অহিংসা ও প্রেমের পূজারী।যে প্রেম শারীরিক তো নয়ই,বরং অনির্বচনীয়,- নির্বিকল্প- আধ্যাত্মিক।অভিসার কবিতার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয় নি।উপগুপ্ত রোগের উপশম নিয়ে হাজির হয়েছে নগর নটীর কাছে।
কবিতাটিকে বিনির্মান করে যে নাট্যটি নির্মান করলাম তার মধ্যে জোঁকের মত এঁকে দিয়েছি এই সময়ের সংকট।আচমকা আসা এক অতিমারী আর তার সাথে তৈরী হওয়া ভয় বা আশংকা আমাদের মন ও হৃদয় বৃত্তির শুদ্ধতাকে সেঁধিয়ে দিয়েছে অন্ধ কোটরে।পাশের বাড়ির কেও হাঁচলে তাকে সন্দেহ করছি।প্রতিবেশী কেও মারা গেলে তার ছায়া পর্যন্ত মাড়াচ্ছি না।পাছে বদ হাওয়া গায়ে লেগে কোন ছোঁয়াচে জীবানু আমার শরীরে এসে বাসা না বাঁধে।এই ভয়ংকর মুখোশ আঁটা সময়ে বুদ্ধ মার্গে রবীন্দ্রনাথই পথ দেখান আমাদের।সন্যাসী উপগুপ্ত যেন আজো হেঁটে আসছে ঐ দূরের পথ দিয়ে।বিম্বিসার,অশোকের ঐ ধূসর জগৎ থেকে।উপগুপ্ত হেঁটে আসছে একাকী,
তারপর সে কোলে তুলে নিচ্ছে জীবানুগ্রাসে আক্রান্ত সেই নগর নটীকে।বাসবদত্তার শরীরে লেপে দিচ্ছে অক্ষয় বটিকার প্রলেপ।সেই রোগগ্রস্থ যুবতীর জীর্ণ হাত খুঁজে পাচ্ছে তার সেই বন্ধুকে।রবীন্দ্রনাথ আমাদের দেখাচ্ছে এ সময়ের মুক্তির পথ-যে পথ মানবিকতার,যে পথ মনুষ্যত্ত্বের।
রবীন্দ্রনাথ মারা গেছেন আশি বছরেরও অধিক।তবুও উনি যেন প্রদীপ জ্বেলে দাঁড়িয়ে আছেন কোন মৃত পৃথিবীর অন্ধ সুড়ঙ্গের সামনে।একা নয় সবাই।বিচ্ছিন্নতা নয় সমগ্রতা।কৃত্রিমতা নয়,প্রকৃতির সান্নিধ্য-সভ্যতার সংকটকাল অতিক্রান্ত বিশ্ববীক্ষার যে পথ উনি দেখিয়ে গেছেন,তা শঙ্খ বাবুর অক্ষর নির্যাসে আমরা আরো একবার ঝালিয়ে নিতে পারি বৈকি-
“পৃথিবী হয়তো বেঁচে আছে/ পৃথিবী হয়তো গেছে মরে/ আমাদের কথা কে বা জানে/ আমরা ফিরেছি দোরে দোরে/ কিছুই কোথাও যদি নেই/ তবু তো ক’জন আছি বাকি/ আয় আরো হাতে হাত রেখে/আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।”