আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিশেষ সংখ্যায় সৌম্যজিৎ আচার্য
বাঙালি ও কিছু জরুরি প্রশ্ন
কুইজ মাস্টার প্রশ্ন করলেন পৃথিবীতে এমন কোন প্রজাতির গাধা আছে যে অঙ্ক জানে? প্রতিযোগীরা একে ওপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি শুরু করল।এ আবার কেমন প্রশ্ন ! সারা রাত খেটে তারা এতো প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করেছে কিন্তু এমন একটা প্রশ্নের উত্তর তো? অঙ্ক জানা গাধার প্রজাতি তা আবার হয় নাকি? ভবতোষ স্যারও এতো গুলো এরিয়া বলে দিলেন কিন্তু এটা তো বলেননি?
গাধা কি সত্যি অঙ্ক জানে? তারা কুইজ মাস্টারকেই প্রশ্ন করলেন। কুইজ মাস্টার মৃদু হেসে বললেন, যদি গাধা অঙ্ক নাই জানল, শিখল, তবে অঙ্ক না পারলে,অঙ্ক ভুল করলে কেন আমাদের ছোটো বেলা থেকে শুনতে হয়, গাধা! অঙ্কটা পারলিনা কেন? তোর দ্বারা কিস্সু হবে না।
সত্যি, তো এমন তো বহুবার হয়েছে। অঙ্ক না পারলে তাদের অনেককেই তো বহুবার শুনতে হয়েছে তুই একটা গাধা। এমনকি বহু ক্ষেত্রে কিছু বুঝতে না পারলেও ওই শব্দ উচ্চারণ হয়েছে ‘গাধা’।
এতটা পরে যারা ভাবছেন এই প্রশ্নটা কোন কুইজ প্রতিযোগিতায় করা হয়েছে, তাঁদের জানাই এরকম কোনো কুইজ প্রতিযোগিতা আদতে হয়নি। এমন কোনো প্রশ্ন কোনো কুইজ মাস্টার কোনো প্রতিযোগীকেও করেননি। তবে কুইজ মাস্টার টি আছে। সে মানুষ নয় সময়। সময় আমাদের প্রশ্ন টা করছে। হে পাঠক, এবার আপনার উত্তর দেবার পালা।
আসলে বাংলা ভাষার এমন কিছু শব্দ আছে, যেগুলোর ব্যবহারবআমরা এরকম ভাবেই করে আসছি। কিন্তু এমন প্রয়োগের কারণটা কি? আসলে এও এক হ্যাংওভার, নিজের শ্রেষ্টত্ব জাহির এর জন্য। এও এক ঔদাসীন্য, ভাষাকে তরল করে পরিবেশনের। যেমন একটু বোকা ছেলেকে তার সহপাঠীরা উত্তক্ত করে তাকে ‘ঢেঁড়স’ বলে। কিন্তু কেউ কখনো কোনোদিনও
প্রশ্ন করেনি ঢেঁড়স কেন? ঢেঁড়স কি জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে উত্তীর্ণ হতে পারেনি? নাকি নামতা বলতে পারেনি?
কেতাদুরস্ত স্বামী যেমন তার স্ত্রী কে বলে ও তুমি বুঝবে না, নোটসর্বস্ব শিক্ষক যেমন ছাত্রছাত্রীদের বলেন ওটা পরীক্ষায় আসবে না। তেমনই এসব প্রশ্ন সিলেবাস এর বাইরেই থেকে গেছে। বাংলা ভাষার চর্চার, গবেষণার বিষয় হয়ে ওঠেনি কোনোদিন।
আসলে ভাষা হলো উলের সোয়েটার এর মতো। শীতের শেষে তাকে ধুয়ে শুকোতে দিতে হয়। ভাষায় যে আবর্জনা তাকে ধুয়ে ফেলতে হয়। কিন্তু বাংলা ভাষার এ উদ্যোগ খুব বেশি চোখে পড়েনা।
বলা হয় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের সমান। তাই মাতৃ ভাষার বিন্যাসে প্রয়োগ ও তার ব্যবচ্ছেদে আমাদের বেশী সতর্কতা জরুরি।যেমন ধরুন, হ্যাঁ বা সম্মতিসূচক শব্দ আজকাল খুব একটা শোনা যাচ্ছে না। ব্যবহার হচ্ছে। তবে পঞ্চাশোর্ধ বাঙালির মধ্যে। নতুন বং জেনারেশন এখন একটাই শব্দ ব্যবহার করছে, তা হল ‘একদম’। কিরে, বই মেলা যাবি? একদম। সিনেমার শেষ টা কি ভালো না? একদম। এই একদমে বলে যাওয়া শব্দটি এখন আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে।
জিও কাকা, তুমি তো দেখছি এদিকে আসলেই ভুল ধরতে শুরু কর। না ভাইপো, এগুলো ভুল তো বলিনি। আর ভুল বললে তুমি শুনবেই বা কেন? তোমরা যেমন খুশি চচ্চড়ি বানাতে পারো। তবে তার প্রয়োগ টা যথার্থ কিনা দেখে নাও। আর হ্যাঁ, “এদিকে আসলে” কথাটা ঠিক নয়। কথাটা হল “এদিকে এলে”। এটা দেখি আমার অনেক কবি বন্ধুও অসতর্কে ব্যবহার করে। যেদিন বাংলাদেশ থেকে কবিতা পড়ে ফিরলাম, সেদিন বিকেলেই এক কবিবন্ধু ফোন করলেন।প্রথমেই তার প্রশ্ন ছিল “হ্যালো, কবে আসলে”? প্রশ্ন টা হওয়া উচিত ছিল হকবে এলে? এরকম ভুরি ভুরি উদাহরণ দেওয়া যায়। তাতে শব্দ সীমা অতিক্রম করে মাত্র। এগুলো যারা বলে বা বলছেন তাঁদের এতে কিছু যায় আসেনা। আসবেই না কেন ? বাংলা ভাষা এখন হেমন্ত ঋতুর মতো ম্রিয়মান। অন্য ভাষাভাষীর মানুষের মধ্যে তাদের মাতৃভাষা নিয়ে যতটা উচ্ছাস আছে বাঙালির তা নেই।
ধরুন নন্দন চত্বরে এক ট্যাক্সিওয়ালাকে হাত নেড়ে দাঁড় করালেন। ট্যাক্সিওয়ালা অবাঙালি। তিনি প্রশ্ন করলেন, কাঁহা জায়েঙ্গে? সঙ্গে সঙ্গে আপনি মাতৃভাষা ভুলে, কিশলয় ভুলে হজবরল-কে খাটে শুইয়ে উত্তর দিলেন,
আক্রোপলিস যাওগে? সমালোচক রা হাহা করে তেড়ে আসবেন। বলবেন, বাংলা ভাষায় উত্তর না দিলেই কি সে বাংলা ভাষা বিরোধী? তাতো বলিনি। আমি যা বলতে চেয়েছি তা আপনিও বুঝতে পেরেছেন। তা হল ট্যাক্সিওয়ালাকে প্রশ্নটা বাংলাতেও করা যেত। অন্তত প্রথমবার। এ বঙ্গে থেকে সেকি আমার মাতৃভাষাটা জানেনা?