• Uncategorized
  • 0

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিশেষ সংখ্যায় ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

শব্দের অভাব

-তুই এমন বললি কেন? নিজেরা মাছ খাস না বলে আমাদের মাছ কে ছোটো করার কোনো অধিকার নেই তোর। সুমনের বন্ধু রাঘবের সঙ্গে আজ ইশকুলে বচসা হল তুমুল।
রাঘব কলকাতার এক অবাঙালী পরিবারের ছেলে। ইশকুলে বাঙালী ছেলের সংখ্যা হাতে গোনা। সুমন বাড়ি এসে মা’কে বলে,
– মা কলকাতা তো বাঙালীদের জায়গা। এখানে ওরা কেন থাকে?
ক্লাস সিক্সের সুমন কে ওর মা বলেন,
– কলকাতা সব্বার। সবাইকে ভালোবেসে থাকতে দেয়।
সুমন বলে
– প্রায়ই বলে ওরা কলকাতার বাঙালী তুলে, মাছ নিয়ে এমন কেন বলবে?
মা বললেন,
– তোরা ছেড়ে দিবিনা একদম। পেয়ে বসবে। ওরা বাঙালীদের খুব ছোটো করে।
পাশ থেকে সুমনের দিদি কোয়েল বলল,
– আর এই কলকাতায় বিজনেস করেই এত টাকা ওদের।
সুমন বলল,
– জানিস দিদি? টিফিন বক্স খুললেই বলবে, ওহ্! ফিশ্! অথচ দ্যাখ, আমি কোনোদিন মাছ নিয়ে স্কুলে যাই না।
কোয়েল বলে,
– তুই বললি না কেন সঙ্গেসঙ্গে? তোরা তো ননভেজ ডিশ চুপিচুপি খাস। জানিস? আমাদের কলেজের সব মাড়োয়ারী মেয়েগুলো লুকিয়ে লুকিয়ে ক্যান্টিনে ফিশচপ, ফিশফ্রাই, চিকেন সব খায়।
অরেকদিন কি বলছে জানিস দিদি?
– অব রস্‌গুল্লা আ গয়া।
আমি না থাকতে পেরে বলেই ফেলেছি সেদিন।
– রাঘব, তুই এমন করছিস যেন রসোগোল্লা খাস না।
– আরে তুই কি বলছিস? কোয়েল বলে ওঠে,
– আমাদের ক্লাসের মেয়েগুলো কি বলে জানিস? এই চল্‌, সামোসা খেয়ে আসি। আমি খুব রেগেমেগে বলেছি সেদিন। তোরা বাঙালী হয়ে সামোসা বলিস কেন রে? আমাদের সিঙাড়া আর অবাঙালী সামোসায় হেভেন অ্যান্ড হেল ডিফারেন্স।
সুমনের মা বলেন,
– এই ছেলেগুলো কিচ্ছু পড়াশুনো করেনা। শুধু ইংলিশ শিখে নিয়ে বাবার গদিতে বসবে বলে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি হয়। আর পারলে বাঙালীদের নীচু করে কেবল।

– আর এখন এই এক হয়েছে “কেন কি”। দেখেছ মা? কোয়েল বলে। সবকথায় আমি তোকে খুঁজছিলাম ” কেন কি” আমার তাড়া আছে। কাল আমায় তোর খাতা টা দিবি ” কেন কি” আমি কাল অ্যাবসেন্ট ছিলাম। বাঙালিরাই বলছে এমন।
– হিন্দী তে কিঁউ কি বাংলায় হয়েছে, কেন কি। অসহ্য লাগে শুনতে। আর ফেসবুকে সেই কমেন্ট? কি দারুণ লাগছ? উফ! ডিসগাস্টিং! মা বলেন রেগেমেগে।
– সেদিন জানো মা? কলেজের সরস্বতী পুজোয় আমাদের দারোয়ান একটা হিন্দুস্থানী পুরুত কোত্থেকে ধরে এনেছে। সে নিজের মত পুজো করে চলেছে। তারপর বলে পূজা কে লিয়ে লাড্ডু নেহি লায়া আপলোগ?
আমরা তখন বললাম, ঐ তো আমাদের নারকোল নাড়ু আছে। দিন ঠাকুরকে। চুপ করে গেছে তখন। অং, বং, চং মন্ত্র বলে পুজো করে গেল। কিছুই বোঝা গেল না এবার।
সুমন বলল,
– আমাদের ইশকুলে কেউ আর দোল বলেনা এখন জানো মা? বলে হ্যাপি হোলি। আমি আরো বেশি করে বলি শুভ দোল।
– বেশ করিস। আমাদের কমপ্লেক্সের দোলের গেটটুগেদারে ওরা বলে নিরামিষ মেন্যু হবে। আমি সেদিন মিটিংয়ে গিয়ে সেই শুনে বলে এসেছি। বাঙালীরাও টাকা দেয় অতএব ননভেজ না থাকলে বয়কট করব। সেইশুনে একজন আবার বলে উঠল বংগালী লোগ কো পূজা মে ভি মছলি চাইয়ে? আমি আর না পেরে বলেছি, বাংলায় থাকেন আর এটাও জানেন না? বাঙালীদের দুর্গাপুজো, দোল সব পার্টিতেই মাছ মাস্ট, বুঝলেন?

– আরে দিওয়ালি হুল্লোড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলাম বলে সেবার কেমন করল দেখলে না? সবাই হিন্দী গান গাইছে। হিন্দী গানের সুর বাজছে। আরে তোদের নয় দিওয়ালি। আগে তো আমাদের কালীপুজো। জানো মা? এর পরের বার আমি একটা শ্যামাসঙ্গীত গাইব। আরো রাগিয়ে দেব ওদের। কোয়েল বলে ওঠে।
– আরে টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনে দেখিস না কি অসহ্যভাবে আধাখেঁচড়া বাংলা বলে? সব রান্নার অনুষ্ঠানগুলোয় কি জঘন্যভাবে একটু হিন্দি, একটু ইংরেজী আর বাংলা মিশিয়ে রান্নার গল্প বলে চলে সঞ্চালক। বাংলা চ্যানেলে কথা বলছে অথচ বলবে ” এই হল মাংস রান্নার তারিকা” । সেদিন একজন বলল, আজ রান্নাঘরের ধামাকা হল হোলি স্পেশ্যাল। কোয়েলের মা বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে বলে উঠলেন।
তিনি আজন্ম বাংলা মাধ্যমে পড়েছেন। বাংলা বইয়ের পোকা। তাঁর খারাপ লাগতেই পারে । কিন্তু তাঁর মেয়ে কোয়েল বা ছেলে সুমন এরা ইংরেজী মাধ্যমে পড়া এখনকার প্রজন্মও বাড়িতে বাংলায় সারাক্ষণ কথা বলে। ওরা ফেলুদা, ব্যোমকেশ পড়ে । বাংলা ছবি দেখে।
ওদের আবাসনের অবাঙালি ছেলেপুলেদের সংস্কৃতির সঙ্গে কোথায় যেন ওদের বিস্তর ফারাক। মেলেনা মোটেও।
মা বললেন,
– দম বন্ধ হয়ে আসে এক একসময়। বাঙালী রান্নার মাসী এসে সকালবেলা জিগ্যেস করে দেখিস না? বৌদি কি সবজী হবে আজ? আমরা জীবনে এমন বলতাম? কি তরকারি অথবা কি রান্না হবে বলে এসেছি।
– তুমি আর কি বলবে মা? আমাদের কলেজে তো এইট্টি পার্সেন্ট বাঙালী পড়ে। তারা সেদিন কি তর্ক করল। আম্মা, আব্বু, খালা, ফুফু, পানি, গোসল বলে বাংলাদেশের বাঙালীরা? বলে বাংলাদেশের বাংলা নাকি আসল বাংলা । সেদিন আমি বলেছি, বাংলাদেশে মাতৃভাষা নিয়ে এত আন্দোলন হয়েছিল তারা বাংলাভাষা কি ধরে রেখেছে? এগুলো তো সব অন্যভাষা থেকে এসেছে রে। সেটা ওদের কে বোঝাবে?
আমাদের কলকাতাতেই তো রামধনুর মত একটা কিউট শব্দ কে রংধনু বানিয়েই ছাড়ল। মা বললেন, এগুলোই তো বাংলাভাষার অবনমন। খুব খারাপ লাগে দেখে।

সুমন সেইশুনে গুনগুন করে গেয়ে ওঠে…

জলে ভেজা মাঠে আকাশে হাত বাড়ায়,
মেঘের আড়ালে ভেসে থাকা সেই রংধনু কে চায়
দেখেছ কি তাকে? শুভমিতার এই গানটা কিন্তু হেব্বি, বল্‌ দিদি?
কোয়েল সেই শুনে বলল, আবার হেব্বি? সুমন বলে, ঠিক আছে। তবে কি বলব?
কোয়েল বলল, বল দারুণ, খুব ভালো। বাংলাভাষার শব্দভান্ডারে কি শব্দের ঘাটতি হয়েছে নাকি রে ?
মা সেই শুনে আহ্লাদে আটখানি হয়ে বলে ওঠেন, সত্যি তো, বাংলাভাষায় শব্দ তো আর কম পড়ে নাই।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *