• Uncategorized
  • 0

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিশেষ সংখ্যায় চয়ন মুখার্জি

ভৈরব গাঙ্গুলির “পাল্কিভাঙা বউ” নাটকে একটি সংলাপ ছিল, “ইংরেজরা মাদার আর মাদারটাঙ্গ” শব্দুটো কখনো ভোলে না। তারা করেছিল বিশ্বজয়।
আর একটি একুশে ফেব্রুয়ারি জাগ্রত দ্বারে। এই প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে আজ আমাদের আত্মসমীক্ষা করার সময়, মুল্যায়ণ করার সময়, যে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি কিছু চর্বিত চর্বন ব্যতিরেকে আমরা , অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীরা আমাদের ভাষার জন্য কী করতে পারি বা কী করতে পেরেছি আজ অব্দি?
সম্প্রতি একটি বাংলা চলচ্চিত্রের সংলাপ দেখে চমকে উঠেছিলাম। নায়ককে সেখানে কেউ একজন জিজ্ঞাসা করছেন, “আপনি কি বাঙ্গালী?” উত্তরে নায়ক বলছেন, “না, আমি ভারতীয়!” দুটো পরিচয় কি পরস্পরবিরোধী? যদি না হয়, তাহলে খোদ বাঙ্গলা সিনেমাতেই এরকম সংলাপ কাদের প্ররোচনায় লেখা হচ্ছে?
ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যগঠন দেশের স্বার্থ পরিপন্থী, তাতে বিচ্ছিন্নতাবাদ বাড়বে, এমনটাই মনে করতেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরু। এজন্যই তেলেগু ভাষীদের জন্য আলাদা রাজ্য গঠন কিছুতেই করবেন না, একরকম প্রতিজ্ঞা করে বসেছিলেন। কিন্তু ৫৬ দিন অনশনের শেষে পট্টি শ্রীরামালু মারা যাওয়ার পরে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে, ফলে বাধ্য হয়ে তাকে অন্ধ্রপ্রদেশ গঠন করার পক্ষে মত দিতে হয়। আজ এত বছর পরে আমরা কী দেখছি? বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য, বিদ্যালয় জীবন থেকে আমরা যা তোতাপাখির মতো মুখস্ত করে আসছি তা যদি ধ্রুব সত্যি বলে মেনেই নিই, তাহলে বলতেই হবে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ভারতীয় জাতীয়তাবাদকেই আদতে আরো শক্তিশালী করেছে। একজন মানুষ একই সঙ্গে গর্বিত ভারতীয় আর গর্বিত বাঙ্গালী হতেই পারেন, কোনো বিরোধ নেই দুটো সত্বার মধ্যে।
এমন নয় যে ভাষার জন্য ভারতীয় বাঙ্গালীদের আত্মহুতির কোনো নিদর্শন নেই। পুরুলিয়া জেলাকে বিহারের সাথে সংযুক্ত করার যে অপপ্রয়াস শুরু হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙ্গালীদের সংগ্রামের সামনে তা ব্যর্থ হয় যে ইতিহাস আজ অনেকেরই অজানা। আর শিলচরের যে ১১ জন ভাষার অধিকারের দাবীতে জন্য গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন, তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন বাঙ্গালী। প্রশ্ন যেটা আসছে, আবার, বারবার , যেসেই উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কী কী করেছি?
প্রথম বিষয়, মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা।
১৯৬৪ সালে ভারত সরকারের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রক (বর্তমানে মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক) ডক্টর জি এস কোঠারির নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে, যা “কোঠারি কমিশন” নামে পরিচিত। স্বাধীনতা উত্তর ভারতে রাজ্যে রাজ্যে শিক্ষা ব্যবস্থার হাল খতিয়ে দেখা এবং সেই সম্পর্কে রিপোর্ট পেশ করা। কমিশন পর্যবেক্ষণ করে জানায় যে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মাতৃভাষায় প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাদান প্রথা চালু হলেও স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে মাতৃভাষায় পঠন পাঠন তখনও শুরু হয়নি। কমিশনের সুপারিশে ভারতের প্রতিটি রাজ্যে মাতৃভাষায় স্নাতক ও উচ্চস্তরের শিক্ষা চালু করার জন্য রাজ্য সরকারগুলির উদ্যোগে একটি করে পর্ষদ গঠন করা হয়। পশ্চিমবঙ্গেও সেই সূত্রেই ১৯৭০ সালে চালু হয় “ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ফাউন্ডেশন ফর টেক্সট বুক প্রোডাকশন” যা বর্তমানে ” পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ’ নামে পরিচিত।
৫০ বছর পেরিয়েও সেই পর্ষদের কাজ কতটুকু এগিয়েছে? বা বলা ভালো আদৌ কিছু এগিয়েছে? বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক স্তরে কতগুলি বই বাজারে পাওয়া যায়? ভাষা হিসাবে বাংলা অতি অবশ্যই হিন্দির চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। হিন্দিতে যদি উচ্চশিক্ষা সম্ভব হয়, উচ্চস্তরের বই লেখা সম্ভব হয়, বাংলায় নয় কেন?
সদিচ্ছা নেই বলে।
কেউ কেউ বলেন বাঙ্গালা ভাষায় বৈজ্ঞানিক পরিভাষার উপযুক্ত বিকল্প শব্দ অমিল।অত্যন্ত বোকার মতো যুক্তি। যদি অমিলই থাকে, তাহলে সেই শব্দগুলি বাঙ্গালা ভাষায় অন্তর্ভুক্ত করা হোক। ভাষা তো প্রবহমান নদীর মতো, তাতে আদানপ্রদান চলতেই থাকে। আজ “পুলিশ”শব্দটি বাংলা ভাষার অঙ্গ হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ সেই যুগে দাঁড়িয়ে বাঙ্গালা ভাষায় রাদারফোর্ডের তত্ত্ব নিয়ে প্রবন্ধ লিখলে আমরা আজ পারবো না কেন?
বিপদে পড়লে পুলিশের বদলে আরক্ষা বলে চিৎকার করলে আদৌ কেউ সাড়া দেবে? অক্সিজেন বা হাইড্রোজেনের বদলে কি আমরা অম্লযান উদযান বলি?
এরপরেও কেউ যদি বাঙ্গালা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে আপত্তি তোলেন, তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে হয় আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কথা, “যিনি বলেন বাঙ্গালা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব নয়, তিনি হয় বাঙ্গালা জানেন না নয়তো বিজ্ঞান জানেন না!”
ভাষা বিস্তারের প্রধান কারণ অর্থনীতি। ইংরেজি যতজনের মাতৃভাষা তার চেয়ে ঢের বেশি লোক ইংরেজিতে লিখতে পড়তে জানে। কারণ কী? কারণ পেটের দায়, আর কিছুই না। তাই বাংলা ভাষার বিস্তারের জন্য যেটা দরকার, বাঙালির অর্থনীতির উন্নয়ন।
দেশভাগ এবং তারপরে কেন্দ্রীয় সরকারের বিমাতৃসুলভ আচরণের জন্য বাংলার অর্থনীতি বিধ্বস্ত হয়েছে, একথা সবাই জানেন, বেশি চর্বিত চর্বনের প্রয়োজন নেই। কিন্তু নিজের রাজ্যে আমরা আমাদের ভাষাকে কী মর্যাদা দিয়েছি?
ভারতের যে কোনো প্রান্তের একজন বাংলা না জেনেও পশ্চিমবঙ্গের মর্যাদাপূর্ণ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে আমলা হতে পারেন। কিন্তু উল্টোটা কি হয়? একজন বাঙালি হিন্দি না জেনে অন্য রাজ্যের সিভিল সার্ভিস দিতে পারবেন কি?
কেন এ রাজ্যের প্রতিটি চাকরিতে যোগদান করতে হলে মাধ্যমিক স্তরে একটি ভাষা হিসেবে বাংলা পড়া বাধ্যতামূলক করা হবে না? কেন এ রাজ্যের রাজধানী শহর কলকাতায় প্রতিটি জায়গায় বাংলায় হোর্ডিং দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হবে না? কেন এ রাজ্যের সরকারি গেজেট নোটিফিকেশনগুলি বাংলায় প্রকাশ করা হবে না?
তার বদলে আজ আমরা দেখছি রাজ্যে সরকারি উদ্যোগে হিন্দি কলেজ চালু হচ্ছে বানেরহাটে। বিশ্বমানব হতে আপত্তি নেই কিন্তু নিজের ভাষার মর্যাদা খুইয়ে কখনোই নয়।
ভাষা বিস্তারের শক্তিশালী মাধ্যম হলো চলচ্চিত্র আর সাহিত্য।বাংলা চলচ্চিত্র আজ আদৌ বাঙ্গালীর মননকে তুলে ধরে কি? হাতে গোনা কয়েকটি বাদে বেশিরভাগ তামিল তেলেগু সিনেমার নকল। কেন? বাংলার মতো সমৃদ্ধ সাহিত্য ভারতে খুবই কম আছে। তা সত্ত্বেও অর্থহীন মাথামুণ্ডুহীন রিমেকের মাধ্যমে নাচগান সিটি দেওয়ার দেওয়ার দক্ষিণী সংস্কৃতি বাঙালিকে জোর করে গিলতে বাধ্য করা হচ্ছে?
দক্ষিণ ভারত চলচ্চিত্র শিল্পে এত উন্নত তার পিছনে বড় কারণ রাজ্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা। সেখানে প্রতিটি রাজ্যে সিনেমা হলগুলোতে প্রাইম টাইমে সপ্তাহের নির্দিষ্ট কিছুদিন প্রাদেশিক ভাষার সিনেমা দেখানো বাধ্যতামূলক। এই নিয়ম বাংলায় নেই কেন?
এক মালয়ালম বন্ধু আমাকে গর্ব করে বলেছিল, পৃথিবীর যে কোনো সাহিত্যের সাম্প্রতিকতম নিদর্শনগুলি কিছুদিনের মধ্যেই মালয়ালমে অনূদিত হয়ে যায়।সেখানে বাঙ্গলার অবস্থা?
এককালে বাঙ্গালী নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অনুবাদে ম্যাক্সিম গোর্কির লেখা ভালোবাসতে শিখেছে, টিনটিনকে ঘরের ছেলে বানিয়েছে। কিন্তু আজ? বইমেলায় হ্যারি পটারের একটি বাঙ্গালা অনুবাদ কিনে হতাশ হয়েছিলাম। জঘন্য বললেও কম বলা হয়!
যে সাহিত্য সম্মেলনগুলি বছর বছর চলতে থাকে, তাতে বাংলা নিয়ে আলোচনা কম, সাহিত্যিকদের ব্যক্তিগত ইগো চরিতার্থ করা বা রাজনৈতিক দলগুলিকে তৈলমর্দন করার কাজে বেশি ব্যবহার করা হয়। বাঙ্গালা ভাষা নিয়ে আন্দোলন করা গোষ্ঠী বা সংগঠনগুলিস সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। সেগুলি কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুর সংগঠন। ফলাফল? যে চর্যাপদ বাঙ্গালা ভাষার আদি নিদর্শন, শুধু মাত্র আমাদের অবহেলার কারণে সেই চর্যাপদকে নিজেদের ভাষার নিদর্শন দেখিয়ে ওড়িয়া ভাষা “ক্লাসিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ” এর তকমা পেয়ে গেছে। আজ্ঞে হ্যাঁ, ভারতে ক্লাসিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ ছয়টি। তাতে বাঙ্গালা ভাষার স্থান নেই। একজনও সাহিত্যিককে এ নিয়ে বলতে দেখেছেন কেউ?
বর্তমানে কয়েকটি সংগঠন যারা নিজেরা কিনা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়, তারা হিন্দি বিরোধিতার ডাক দেন। কিন্ত এটুকু বুঝতে হবে, বাংলা ভাষার অস্তিত্ব প্রতিক্রিয়াশীল নয়, শুধুমাত্র হিন্দি বিরোধিতার ওপরে তা দাঁড়িয়ে নেই। বাঙ্গালীকে অর্থনীতির উন্নতি করতে হলে ব্যবসা করতে হবে, তার জন্য নয় রাজ্যে পাড়ি দিতে হবে এবং সেজন্য একটু হিন্দি সগিখে রাখলে লাভ বই ক্ষতি নেই। বাঙ্গালা ভাষা আজ দুয়োরানী, তা সম্পূর্ণরূপে আমাদেরই অবহেলায়। আমাদেরই অপদার্থতায়।
বাঙ্গালা ভাষার ওপর শেষ খাঁড়ার ঘা পড়েছে বাংলা মিডিয়ামের প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরাজি তুলে নেওয়ায়। কমপক্ষে দুই তিনটি প্রজন্ম এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে , তাদের ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি হয়ে গেছে । আর তাদে পরিণাম দেখে সতর্ক আজকের প্রজন্ম নিজেদের ছেলেমেয়েকে আর বাঙ্গালা মাধ্যমের বিদ্যালয়ে পাঠায় না। পাড়ায় পাড়ায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে ইংরাজি মাধ্যমের বিদ্যালয়, তাতে ছেলেমেয়েরা কিছু আধুনিক আদবকায়দা শিখলেও নিজেদের সংস্কৃতি ঐতিহ্য কিছুই জানছে না, তারা বিভূতিভূষণ, বনফুল, শরৎচন্দ্র আত্মস্থ করতে শিখছে না।নিজেদের শেকড় থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন এই প্রজন্ম বাঙ্গালা মাধ্যম নিয়ে ঠাট্টা করে, বাঙ্গালীর সংস্কৃতি নিয়ে ঠাট্টা করে ময়ূরপুচ্ছধারী কাক সাজতে ব্যস্ত। তারা শিক্ষাকে বহন করে চলেছে, বাহন করতে পারেনি।
বাঙ্গালা সিনেমার যে কোনো নায়ক বা নায়িকার পাঁচ মিনিটের সাক্ষাৎকারে শুনলে দেখবেন, প্রতিটা বাক্যে একটি বাংলা শব্দের পরে দুইটি করে ইংরাজি শব্দ থাকে। এটাই বর্তমানের স্টাইল, নিজেকে “কুল” দেখানোর।
এর আরো একটি বিষময় ফল এই যে, রাজ্যে এখন দুই ধরনের লোক থাকে। কলকাতা ও তার মফস্বল নিবাসী বং প্রজন্ম আর জেলার বাঙ্গালী। কলকাতার বং জেলার উপভাষা নিয়ে ঠাট্টা করে, উচ্চারণ কায়দা নিয়ে ঠাট্টা করে। উপভাষা ছাড়া কি ভাষা বাঁচে? উপভাষা তো আমাদের সম্পদ!
ফলে কলকাতার প্রতি বাড়ছে ক্ষোভ। কলকাতা আজ একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। তার সাম্প্রতিক নিদর্শন পাওয়া গেলো বাঙ্গালা সিনেমার স্বর্ণযুগের এক কিংবদন্তি নায়িকা, বর্তমানে পরিচালকের একটি কথায়। মেদিনীপুর থেকে উঠে আসা অভিনেতা অনির্বান ভট্টাচার্যের ঝরঝরে ইংরাজি বলা দেখে তিনি অবাক হয়ে গেছে।কেন? ইংরাজি বলা কি শুধু কলকাতার বংদের মৌরসিপাট্টা?
প্রতি বছর ২১ শে ফেব্রুয়ারি আসবে যাবে, আমরা কিছু আবেগময় ভাষণ পাবো, কিছু কবিতা কিছু কোটেশন মুখস্ত করবো। কিন্তু এই প্রশ্নগুলির উত্তর কি আদৌ খোঁজ হবে? নাকি এই মেকি বাঙ্গালা প্রেমের নিদর্শন বছরের পর বছর চলতেই থাকবে এবং পঞ্চাশ বছর পরে পরীক্ষার খাতায় কোনো পড়ুয়া ইংরেজিতে লিখবে
এখানে একদা বাঙ্গালী নামক একটি জাতি বসবাস করিত যাহারা বর্তমানে ডোডো পাখির ন্যায় বিলুপ্ত হইয়া গেছে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *