অনুবাদে জয়া চৌধুরী

Don Jose দোন খোসে / খোসে ওরোসকো খুয়ারেস ( মেক্সিকো) 

দোন খোসে, সত্তরোর্দ্ধ, রাতের খাবার শেষ করছিলেন, হঠাতই মনে পড়ল……
গ্রামের নাম ছিল সান খুয়ান। জায়গাটা আর পাঁচটা দেশের মতই ছিল যেখানে মানুষের থেকেও খিদেকে বেশি অনুভব করা যেত। ইটের বাড়ি আর উঠোনওয়ালা একটা আধা শহরের মত ছিল ওটা। উঠোনে মুর্গী শুয়োর আর কুকুরেরা পাশাপাশি অবস্থান করত নিপুণ সৌহার্দ্যে ( যদিও সবসময় নয়)। দিয়াজ পরিবার সেখানকার প্রত্যন্ত উর্বর জায়গায় থাকত। বাড়িটার ন’জন সদস্য ছিল। বাবা দোন ক্রিসোগোনো আর দ্যোনিয়া ভিসেন্তা (সংক্ষেপে দোন ক্রিস এবং দোন্যিয়া চেন্তা) ছিলেন ৭ পুত্রকন্যার জনক যার মধ্যে ৪ জন পুত্র ও তিনজন কন্যা, ভাবছিলেন খোসে ( তিনি সবার ছোট)। ওঁরা চাষবাস করে জীবনধারণ করতেন। ব্যাপারটা যদি এভাবে বলা যেত যে সান খুয়ান শহরের বাইরে একফালি জমির মালিক ছিলেন তাঁরা আর সেটা আধ হেক্টর মাপেরও হবে না, সেখানে ভুট্টা আর বীনের চাষ করতেন। ভাল ঋতুতে তা পুরো পরিবারের প্রায় আধখোরাকী হয়ে যেত। আর খারাপ ঋতুতে সেই সঙ্গে অন্যান্য টুকটাক কাজ যেমন রাজমিস্ত্রির জোগালু হওয়া, কিংবা চাল ভাল খামারবাড়ির ক্ষেতে কাজ করতেন। সেখানে যার হাতে দুনিয়ার সবচেয়ে উর্বর জমি গুলো ছিল সে হল দোন স্যামুয়েল, সবাই যাকে ‘কাকা’ বলে ডাকত।
গ্রামের ইস্কুলে কয়েক ক্লাস পড়াশুনো আর সেই সঙ্গে দোন ক্রিসের ভুট্টাক্ষেত আর ‘কাকা’র খামারবাড়িতে কাজ করতে করতে পেপে (দোন খোসে) বেড়ে উঠছিলেন। খামারবাড়ির কাজটা পেপের ভাল লাগত। যদিও মালিক খানিকটা দূরত্ব বজায় রাখত তাঁর সঙ্গে, তবে তিনি খুব মনযোগী ও কর্তব্যপরায়ন কর্মচারী ছিলেন। তাছাড়া চারপাশে এরকম নিয়ম শৃঙ্খলা তাঁর ভাল লাগত। যেটা তাঁর সবচেয়ে ভাল লাগত তা হল মালিকের ভূমিকা, ‘কাকা’কে তিনি সারাক্ষণ মাঠের কাজে হাত লাগাতে দেখতেন। তবে ভাল লাগা ছাড়াও আরো কিছু কিছু কাজ ‘কাকা’ করত যা তাঁর অত ভাল লাগত না। মালিক সেই খামারে গ্রামের সুন্দরী মেয়েদের কাজে ডাকত আর তাদের ছোটখাট উপহার দিয়ে তাদের সঙ্গে নোংরা কাজ করত। এটা পেপেকে ভয়ানক রাগিয়ে দিত। এমনকি একবার তো নিজের প্রেমিকা এভেরলিদা (এভা) কে পর্যন্ত সেই খামারে আসতে দেখেছিলেন। সে অবশ্য বলেছিল মালিক ওর সঙ্গে সেরকম কিছু করে নি।
আর একটা ব্যাপার পেপের ভয়ানক খারাপ লাগত সেটা হল ‘কাকা’-র খামারবাড়ির ম্যানেজাররা অন্য কর্মচারী আর জনমজুরদের সঙ্গে খুব বাজে ব্যাবহার করত। কারণ থাকুক বা না থাকুক কথায় কথায় হয় কিল চড় ঘুষি মেরে নাহয় গালাগালি দিয়ে সুখ করত তাদের ওপর, এতেও সুখী না হয়ে বারো ঘন্টা ধরে কাজ করাত। তাদের কর্মচারী না বলে ক্রীতদাস বলাই সংগত। আর এ সব কিছুই করত নিজেদের পরিবারকে আর একটু সুখ দেবার জন্য।
লোকজন যখন দেখত এসব সত্ত্বেও তারা কিছু রোজগার করতে পারছে, আর সে টাকাটাও আশপাশের সব খামার এমনকী গ্রামের থেকেও বেশি এবং সেই টাকায় পরিবারের ভরণপোষণ চালাতে পারছে তারা ‘কাকা’র কাছে কাজের আশায় যেতেই থাকত। কিন্তু তাদের মধ্যে সামান্য কজনই তা পেত। তবুও সেকারণে বা অন্য কিছুর আশায় তারা লেগেই থাকত সেখানে। গোপনে গোপনে তারা ম্যানেজারের দ্বারস্থ হত। আর সেকারণেই মালিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আরো নির্মমভাবে শোষণের আরো পথ বের করত। তারা যে শুধু অন্যদের তুলনায় কম টাকার চুক্তিতে তাদের নিয়োগ করত তাই নয় আরো অনেক কঠিন শর্তও থাকত সেখানে। এটায় তারা নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাত। তারা মালিকের কাছে পুরো মাইনে নিত কিন্তু শ্রমিকদের হাতে কম টাকা তুলে দিত আর বাকী টাকাগুলো বাজেভাবে নিজেদের পকেট ভরত।
কেউ কেউ কাজ পাবার প্রবল ইচ্ছেয় চুপিচুপি কিছু বেহায়ার সঙ্গেও চুক্তি করত। যাতে তাদের নিয়ে ম্যানেজারদের কাছে যাওয়া যায় আর এভাবে কাজও জোটে। সেখানে তাদের অন্য ব্যবসার জন্য অন্য কাজের প্রস্তাব দিত। তাদের অনেকেই দুটো কাজই করত কিন্তু মাইনে পেত শুধু এ কাজের আর অন্য কাজের টাকা কোথায় জাদুর মত মিলিয়ে যেত। কেউ কেউ যারা চুরিচামারি করতে খামারে ঢুকত তাদের দশা ভয়ানক হত। কেনয়া ‘কাকা’ খামারের দেখভাল করার জন্য কয়েকটা বিশালাকার কুকুর পুষত, যারা বেআইনি লোকজন ঢুকতে দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে টুঁটি ছিঁড়ে দিত। অনেকক্ষেত্রে তারা মরেই যেত। ‘কাকা’ সেসব দেখেও দেখত না।
পরিস্থিতিকে এটা আরো গম্ভীর করে তুলেছিল। এই ম্যানেজারদের খাঁই মেটাতে গিয়ে লোকেরা অনেকেই তাদের পোষা জন্তুদের এমনকি বাড়িঘরও এই নেকড়েগুলোর কাছে বিক্রি করে দিত। ‘কাকা’ যখন এই ‘ম্যানেজ’ এর ব্যাপারটা ধরে ফেলল তখন সে এই ম্যানেজারগুলোর ওপরে মোড়লি করে সেসব বন্ধ করে দিল।
কিছুকাল কেটে গেছিল, বালক পেপে, এখন তিনি খোসে, এভাকে বিয়ে করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তাঁর মাথায় কিছু করবার ইচ্ছে টগবগ করে ফুটত ( কিন্তু সেটা কি?)। ‘কাকা’র কাছে যত সঙ্গীসাথী বন্ধুবান্ধব কাজ করত তাদের ভালোর জন্য কিছু করতে ইচ্ছে করত তাঁর। বলা বাহুল্য যে ততদিনে কাকার এসব কাজ তাঁকে ও তল্লাটের প্রভু বানিয়ে দিয়েছিল ,কাকা তখন গোটা এলাকা য় রাজত্ব করত। ব্যাবসা থেকে পুরুত সব জায়াগায় কাকারই ক্ষমতা ছিল । তাই খামারের বাইরে যত ক্ষুদ্র চাষি ছিল, সবাই তারা কৃষক ও দোকানদার দুইই ছিল। তাদের সব্বাইকে ‘কাকা’র গুন্ডারা ব্যবসার সময় জিনিষপত্রের কেনা বেচা কি দামে হবে সবকিছুর ঠিক করত। আর তাদের কাছে এদের সংকুচিত হয়ে যেতে হত।
আরো খারাপ হত যেটা ‘কাকা’ যেহেতু সব ধরনের ব্যবসাতেই হাত দিত, সেহেতু সে একাই একমাত্র যে সব কিছু কিনতে পারত- জামাকাপড়, খাবার দাবার মায় বীজ বোনার সময় কি বীজ পোঁতা হবে সেগুলোও। সংক্ষেপে এমন কোন কাজই ছিল না যেটায় ‘কাকা’ জড়িত না থাকত।
যাই হোক, পরে খোসের সঙ্গে খুয়ানের দেখা হয়েছিল। তাঁর এক বন্ধু। বহুবছর দেখা হয় নি তাঁর। কারণ তিনি রাজধানীতে পড়াশুনা করতে চলে গেছিলেন তারপর শেষমেশ গ্রামে ফিরে এসেছেন এখানেই বসবাস করবেন বলে। ওঁর পড়াশুনা যেহেতু কৃষিবিদ্যা নিয়েই ছিল, পাশ করে কৃষিবিদ্যা ইঞ্জিনীয়র হয়ে গেছিলেন। এখন গ্রামের জন্য কিছু করতে চান।
খোসে তাঁকে সব সমস্যার পাহাড়ের ওপর বসালেন। মূলতঃ ‘কাকা’ সমস্যার ব্যাপারে। সমস্যাগুলো প্রথমেই খুয়ানকে সতর্ক করে দিল। তারপরে তিনি ভাবলেন দেখি যাক না চেষ্টা করে। ‘কাকা’’ র যদি টাকাপয়সা থাকে খুয়ানেরও মগজ আছে।
প্রথমেই খুয়ান যা করলেন তা হল তিনি চলে গেলেন চাষিদের কাছে বললেন এখন আর ‘কাকা’র ওপর নির্ভর করার তেমন দরকার নেই। নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য তারাই স্বনির্ভর হতে পারবেন। খুয়ান বললেন একটা জিনিসই দরকার তাদের। তা হল শ্রম, ইচ্ছাশক্তির দৃঢ়তা আর সততা।
প্রথমে চাষিরা খুব উৎসাহী হল। কিন্তু কিছুদিন পরে পড়ে রইল স্রেফ তারাই যারা মনে করত নিজের বলেই আত্মনির্ভর হতে পারবে, এগোতে পারবে। এটা অবশ্য দ্বিগুণ কাজ আর পরিশ্রম দাবী করল।
পরের ধাপ হল জমিটাকে চাষের উপযোগী করে তোলা। তবে কেমিক্যাল সার দেওয়া চলবে না সেকথা খুয়ান নিজেই তাদের শিখিয়েছিলেন। এটা ঠিক যে কাজটা যারা জমিতে কেমিক্যাল ব্যবহার করে তাদের তুলনায় গোটা চাষ পদ্ধতিকে একটু দীর্ঘায়িত করে তুলবে।
সবসময় উন্নতি করার ভাবনায় মগ্ন খুয়ান নিজে তাদের দেশী বীজই বপন করবার জন্য দিলেন। এর ফলে তাঁর খরচও বেশি পড়ল। কিন্তু টাকা চোকানোর পরে তাঁর নিজের ও সঙ্গীদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ বীজ সংগৃহীতও হল।
খুয়ানের পরের কাজটি হল সঙ্গীদের বীজ নির্বাচন করা শেখানো, যাতে পরের বছরের চাষ করাও নিশ্চিত করা যায়।
ভাগ্যবশতঃ সে বছর ভালই ছিল, বৃষ্টির পরিমাণ যথেষ্ট, কাজেও কোন বাধা পড়ে নি, যদিও ‘কাকা’র তরফ থেকে খুয়ান ও তাঁর সঙ্গীদের ক্ষেতের ফসল কেনার জন্য একটা জঘন্য কম দর দেওয়া হল। ‘কাকা’র যুক্তি হল ওসব খারাপ বীজের ফসল। কিন্তু সেকথা তাদের মনোবল ভাঙতে পারল না। যদিও তাদের অনেকটা পথ যেতে হল তবুও দূরের বাজারে গিয়ে ‘কাকা’র দরের চেয়ে বেশি দামে ফসল বেচতে পারল তারা।
একাজ ‘কাকা’ কে দারুণ ক্ষুব্ধ করে তুলল। কিন্তু গোটা ব্যাপারটা সয়ে যাওয়া ছাড়া তাঁর হাতে কিছুই ছিল না। আর এমনি করে ক্রমশ তাঁর একচেটিয়া বাজারও হাতছাড়া হয়ে যেতে থাকল। এসব ঘটেছিল কারণ খুয়ান জানতেন গোষ্ঠীকে কিভাবে এক জায়গায় সংগঠিত করা যায়, নতুন দিশা খোঁজা যায়, সততার সঙ্গে লড়াই করা যায়, শান্তি ও সুবিচার কিভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়। আর সেটা এমন পর্যায়ে যে সময়ের সাথে সাথে খুয়ানকেই সেই জনপদ সান খুয়ানের নেতা নির্বাচিত করা হল যার নিঃশর্ত সহযোগী থাকলেন খোসে।
‘কাকা’ লক্ষ্য করেছিল যে গোটা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই নিজেকে সে খামারবাড়িতেই সীমাবদ্ধ রেখে দিল। সেখানে তার লক্ষ লক্ষ উপার্জিত টাকায় মৌজ মস্তিতে দিন কাটাতে লাগল।
কিন্তু এসব ঘটেছিল বহু বছর আগে। এখন দোন খোসে পরিবারের সঙ্গে বসে ভাবছেন কত পুরনো এসব ঘটনা। তাঁর বন্ধু খুয়ান, গ্রামের নেতা, মানুষকে সাহায্য করতে গিয়ে অন্য অঞ্চলে বসবাস করেছিলেন, যাতে করে মানুষগুলোর ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত উন্নতি ঘটে।
সমস্যার কোন কমতি ছিল না। তবু যে জিনিষটা দোন খোসেকে সন্তুষ্টি দিল তা হল শান্তি ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মানবতা, সততা, ঐক্যবদ্ধতা, সব হাতে হাত ধরে রইল।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।