অণুগল্প ১ বৈশাখের বিশেষ সংখ্যায় নুসরাত রীপা
এক টুকরো পয়লা বৈশাখ
উফ্! এক্ষণে বুঝি একটু বসবার সময় হলো- এক গেলাস ঠান্ডা পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিল মহুয়া।
বারান্দার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সামনে দাঁড়ানো মতির মাকে বললো, তো কী বলবা?
আইজ যাইতামগা চাই। মেলায় যাইতাম…
কিন্তু কাম তো মেলা বাকি।
কাল সকাল সকাল আইসা সব কাম তুইলা দিমু,আইজ যাই!
মতির মা’র অস্থিরতা দেখে মহুয়া ওকে ছেড়ে দেয়।
দুপুর গড়িয়ে গেছে। মহুয়ার এখনো স্নান খাওয়া কিছুই হয়নি। হবে কীভাবে?এতো বড় সংসার। এতো মানুষ!সেই কাল রাত থেকেই তো শুরু হলো ননদ,দেবর,ছেলে মেয়েদের পছন্দমত রান্নাবান্না। বছরের শুরুর দিনে সবার মুখে হাসি থাকা চাই!
মহুয়া উঠোন জুড়ে ছড়িয়ে থাকা আমের ঝরা মুকুলের দিকে তাকালো। কিছু মুকুলে গুটিও চলে এসেছে। ধুর উঠোন টা আবার নোংরা হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় গানের আসর বসবে। বাচ্চাদের বাবা বলে গেছে মুড়ি আর চা রেডি রাখতে। সে মেলা থেকে নাড়ু,বাতাসা নিয়ে আসবে।
আজ পয়লা বৈশাখ। সক্কাল সক্কাল সবাই পান্তাভাত খেয়েছে ভর্তা ভাজি দিয়ে। ছেলে মেয়েদের জন্য নতুন কাপড় কেনা ছিলো। সেসব পরে, দুপুরে সরষে ইলিশ আর গরম ভাত খেয়ে সবাই মেলায় চলে গেছে!
পাড়ার বৌ-ঝিদেরও সাড়া শব্দ নেই। তারাও বোধহয় মেলাতেই গেছে দল বেঁধে।
মহুয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সেই কবে বাপের বাড়ি থাকতে শেষবার মেলায় গিয়েছিলো। স্বামীর ঘরে আসা অব্দি সেসব বাদ। একবার যেতে চেয়েছিলো, তখন শাশুড়ি বেঁচে ছিলেন। বলেছিলেন, সরকার বাড়ির বউদের মেলার ভিড়ে যাওয়ার রেওয়াজ নাই।
ব্যস আর যাওয়া হয়নি।
তারপর কত বৈশাখ এলো,গেলো।
এখন মহুয়ার মেয়েরা কলেজের বন্ধুদের সাথে একসাথে মেলায় যায়। ছেলেটা ছোট,স্কুল পেরোয়নি, মহুয়া ছেলেকে একা ছাড়তে চায় না, তাই স্বামীকে দিয়ে পাঠায়।
ননদ,দেবররা কেউই এখানে থাকে না। কিন্তু বৎসরের পয়লা দিন তাদের আসা চাই ই!
মেলার কথা মনে পড়তেই ছোট ছোট স্মৃতি মনে জাগে। রেশমি চূড়ি পরতে মহুয়া ভালোবাসতো। মেলা মানেই ছিলো দুহাত ভরা রেশমি চূড়ি! আহা কতোকাল সে চূড়ি কেনা হয় নাই!
নানান কথা ভাবতে ভাবতে উঠোনের তার থেকে গামছাটা পেড়ে নিয়ে স্নান করতে যায় মহুয়া। বিকেল হয়ে এসেছে। দূর থেকে মেলা ফেরত ছেলেমেয়েদের বাঁশি,ডুগডুগির শব্দ শোনা যাচ্ছে। মহুয়া ভাবে সবাই এসে যাবার আগেই পিঠে গুলো রস থেকে তুলে বোলে নিতে হবে।
দ্রুত স্নান শেষ করে শোবার ঘরে ঢুকতেই দেখে বাচ্চাদের বাবা বসে আছে বিছানায়। মহুয়া অবাক কণ্ঠে বলে, এতো আগে চইলা আসছো যে! পুলা কই?
বাইরে বন্ধুদের লগে আছে।
দেইখো আবার ঘুরি না উড়াইতে চইলা যায়।
মহুয়া রান্না ঘরের দিকে পা বাড়াতেই
বাচ্চাদের বাবা ডাক দেয়, একটু দাঁড়াও।
বলো- মহুয়া দাঁড়ায়।
বাচ্চাদের বাবা পাশে এসে পকেট থেকে এক থোকা লাল রেশমি চূড়ি বের করে মহুয়ার দিকে বাড়িয়ে ধরে,নাও।
মেয়েরা চূড়ি পরে না- মহুয়া মৃদু কণ্ঠে বলে।
বাচ্চাদের বাবা হেসে বলে,বোকা নাকী! তোমার জন্য আনছি। তুমি যে রেশমি চূড়ি পছন্দ করো সেইটা আমি ভুলি নাই। নাও হাতে পর!
অদ্ভূত ভালোলাগার সাথে লজ্জাও লাগে মহুয়ার। লোকটা বিয়ের পর প্রথম দিকে এমন করতো। আজ এতো বছর পর হঠাৎ হলো কী !..কৃত্রিম রাগ কণ্ঠে ঢেলে- ঢং করনের সময় নাই। রান্না ঘরে কাজ আছে—বলে মহুয়া চূড়ির থোকাটা দুহাত দিয়ে বুকের কাছে তুলে ধরে রান্না ঘরে পা বাড়ায়।