ভারাক্রান্ত
থমথমে বাতাস, নির্জনে ডোবানো। কোকিলের ডাক এখন কোলাহল। এসময় ডাকাডাকির নয়। পৃথিবীর ঘোরতর অসুখের দিন। করোনা নামের এক ভাইরাসের ধাক্কায় মানুষ গৃহবন্দী। গৃহবন্দী কেন, গৃহবাসীও তো বলা যেতে পারে! তুমি জীবনকে কীভাবে ভাববে তার ওপরেই তো নির্ভর করে তার ভার এবং লঘুতা! সুখী গৃহকোণ শব্দটাতে কেমন যেন ফায়ার প্লেসের উষ্ণতা, একটা নিবিড় অনুভূতি, মায়া ঘন আলিঙ্গনাবদ্ধ জীবন। একদিন এই জীবন ক্রমশ কাটতে থাকে ভারে এবং ধারে, কেটে যায়, রক্তাক্ত হয়, ছিটকে যায় কোণ বহুমুখে।
কখনও এমনও হয়, বহু ব্যবহারে ক্ষয়ে যাওয়া কোন কোন শব্দে নতুন মাত্রা যোগ করে সময়, যেমন এই মৃত্যুভয়ে জর্জরিত দিনে দূরত্ব শব্দে আলো, এমন আলো যেন এই দূরত্ব বিষয়ে কেউ কিছুই জানত না এযাবৎ। সেল্ফ কোয়ারেনটিন, সেলফ আইসোলেশন, সোস্যাল ডিসট্যান্সিং অষ্টোত্তর শতনামের সেই একই কৃষ্ণে অবগাহন ! শব্দ আর তার নানা রং অর্থই জটিল করে সব, ভার চাাপায় জীবনে । অরণিকার জীবন জানে কীভাবে ধীরে ধীরে উষ্ণতা চাপা পড়ে সেল্ফ আইসোলেশনের বরফে। দায় দায়িত্ব, হিসেব নিকেশ আর কথার ওপর কথায় ভারি হয় ফুরফুরে রূপকথা। কাছে থেকেও দূর রচনা করে জীবন ! কাছে আসে দূূর। সেই দূরের জগতই মানুষের আশ্রয় ! এই জগতেই তারা কাছাকাছি আসে, হ্যাপি হ্যাপি সেল্ফি তোলে, কত রকম ডাকাডাকি, হৃদয় আছে কী নেই জানার দায় নেই। আর আছে সোস্যাল মিডিয়া, ডিসট্যান্স শব্দ যার অভিধানে নেই। কত অচেনা অদেখা বন্ধুদের লাভ সাইন আর দারুণ, ছুুুঁয়ে গেলো ইত্যাদি ফেসবুক মন্তব্যে বুক ভরে নিশ্বাস নেয় মানুষ, অনুভব করে পৃৃৃথিবীর মহাযজ্ঞে তারও আহ্বান আছে। একটা ভার্চুুয়ালের দেয়াল জুড়ে শত শত আনন্দঘন মুুুহূর্ত, ছবির মতো বাড়ি, সিনেমার মতো জীবন কী সুন্দর ঝুুলে থাকে ! জীবনে আছে অথচ জীবন নেই !
ইদানীং অরণিকার জীবন অনেকটাই হালকা করেছে এই বাইরের জগত। আজ হঠাৎ একটা ছোট্ট ভাইরাসের ভয়ে —
দুটোই মেকি তবু বাইরের অরণিকা অনেক বেশি হালকা স্বাধীন উড়ানে। দীর্ঘ চলন ওর দর্শন বদলে দিয়েছে। জীবনে যখন শ্বাশ্বত বলে কিছু নেই আলগা করো বাঁধন। এত নানা রকম মানে বুঝতে যেও না জীবনের। এই সিদ্ধান্তে পৌছে অরণিকার হালকা লাগছে খুব, চোখ বন্ধ হয়ে আসছে —
চোখ খুলতে পারছে না অরণিকা। গুনগুন ভেসে আসছে — কোয়ারেনটিন — আজ বাড়ি যাবার দিন — ছেলে তো বিদেশে — লক ডাউন ইস্! এলেন দুজনে আর —
অরণিকা ধড়ফড় করে উঠে বসে, ছুটে যায় তূর্যর ঘরে, ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়েও থমকে গেলো, এখন তো তিন মিটার দূরত্ব মাপার দিন ! নিজের ঘরে ফিরে আসতে আসতে অনেক যুগ পর এই প্রথম তিন মিটার অনেকটা দূর মনে হলো অরণিকার। কত অসহ্য একটা হালকা ফুলকা জীবন নশ্বরের এই মায়ানগরে, মনে হতে লাগল তার ।