লকডাউন কথাটা এই পেত্থমবার শুনল হরিদাস। আটাত্তর বছরের বৃদ্ধ। চামড়া কুঁচকে গেচে । বাঁ চোক ছানিতে নষ্ট। ডান চোকটায় একটু দ্যাখে তাও ঝাপসা। সূয্যি ডুবে যায় যায়।
গামছার খুঁটে কিছুটা মুড়ি বেঁধে লাঠিতে ভর দিয়ে কোমরটা একটু সোজা করে বাড়ি থেকে বের হল হরিদাস। আজ তিনদিন হল ছেলেটা গাঁয়ে ফিরেচে। দিল্লীতে জরির কাজ কত্তো । তারপর কী যে হল, করোনা রোগ এল দেশে। লোক বলল, লকডাউন হয়েচে। ট্রেন বাস অটো সব বন্ধ। দোকান বাজার । গাঁয়ে যাদের বাড়িতে টিভি আচে তারা বলচে, সব দেশে মানুষ মরচে । খুব ছোঁয়াচে রোগ । মহামারী আকার নিয়েচে। হরিদাসের চিন্তা হচ্ছিল বিভুঁইয়ে থাকা ছেলে সনাতনকে নিয়ে।
লোকের ক্ষেতিতে দিনমজুরের কাজ করত সে। বড় মেয়েকে বচর তিনেক আগে বে দে দেছে। তারপরেই সনাতনের মার পেটে ক্যানসার ধরা পড়ল। বচর না ঘুরতি সরকারি হাসপাতালে মারা গেল। জমানো টাকা শেষ হয়ে গেল । সংসার হল অচল । সনাতন বলল, “বাপ্! এবারতো না খেয়ে মরতি হবে। তুমি সাবধানে থেকো। আমি বাইরে যাচ্চি কাজের জন্যি। টাকা পাঠাব।”
এতদূর কাজে গ্যাছিল বোঝেনি বুড়ো । গতকাল সকালে পঞ্চায়েত প্রধান বাড়ি এসে খপর দিল, “তোমার ছেলে যে দিল্লিতে কাজে গেছিলো, ফিরে এইচে। মানে আমাদের সরকার ফিইরে এনেচে। কিন্তুক একন চোদ্দদিন গাঁয়ে ঢুকবে নি ।”
“তা’লে ও থাকবে কোতায়? খাবে কী?” বুড়ো আকুল হয়।
“সে ব্যবস্তা আমরা পঞ্চায়েত থিকে করেচি। গাঁয়ের বাইরে যে বড় শিরীষ গাছটা আচে তার দুটো মোটা ডালে মাচা বাঁধা হয়েচে । ওখানেই ও থাকবে সামনের চোদ্দদিন। খাবার আর জল আমার ছেলেরা গাচের নিচে রেখে আসবে। ও নিচে নেমে খেয়ে নেবে । বলা তো যায় না, যদি করোনা দেহে নিয়ে আসে, তা’লে গেরামের সবাই আমরা মরব। হরিদাসকাকা, তুমি কিন্তু একদম গাচের কাচে যাবে নি ।”
হরিদাসের বুকির মধ্যি হাহাকার করে ওঠে। এতদিন পর ছেলেটা গাঁয়ে ফিরল, বাড়ি আসবে না ! চোকের দেখা দেখব নি একবার ! আজ তিনদিন ধৈর্য ধরে ছিল বুড়ো । কিন্তু আর নিজেকে ধরে রাখতি পারল নে । পঞ্চায়েত প্রধানের নিষেধ ভুলে গেল । মা-মরা ছেলেটা কী খাচ্ছে কে জানে!
হরিদাস সাবধানে হাঁটার গতি বাড়ায়। মুড়ি বাঁধা গামছাটা শক্ত করে ধরে। শেতলা থানের কাছে আসতে দ্যাখে বটগাছের ঘেরবন্দিতে কারা যেন বসে আছে। গলা শুনে মনে হল দলে পুবপাড়ার সহদেব আছে। ও আবার প্রধানের কাচের নোক। হরিদাস প্রমাদ গোনে। তবুও সে বুকে সাহস আনে । যা হবে হবে, ছেলের মুখ আজ দেখবেই । পথের বাঁদিকের বেশি আবছায়াকে আশ্রয় করে। গ্রাম শেষ হতে মণ্ডলদের বড় পুকুর । আর একটু এগোলেই শিরীষ গাছ। দূর থেকে একটা হল্লা ভেসে এলো। —“কে? কে ওখানে?” কারা যেন তেড়ে আসছে।
হরিদাস বিপদ বোঝে। দ্রুত পালাতে যায়। কিন্তু কিছুটা যাওয়ার পর ভাঙা ইটে হোঁচট খেয়ে পুকুরের জলে গিয়ে পড়ে।
“সনাতন বাপ্… “
সনাতন লাফ দিয়ে গাছ থেকে নামে। চিৎকার করে, “বাবা! আমার বাবা জলে পড়ে গ্যাছে। চোখে দ্যাখে না ভালো। জলে ডুবে যাবে । আমি আসছি বাবা!”
সজোরে সনাতনের পিঠে লাঠি পড়ে। সে পালটি খেয়ে পড়ে যায়। ওদিকে ছানিপড়া চোখ আর অশক্ত শরীর নিয়ে হরিদাস মাথা উঁচু করে ছেলেকে দেখার চেষ্টা করে। পারবে কি? না, লকডাউন নেমে আসবে তার জীবনে!