• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক T3 অরিজিনাল মিনি সিরিজে নীলাঞ্জন মুখার্জ্জী (পর্ব – ১)

ইংরেজ কখনও এদেশে আসেনি – ১

“ফেলুদা বলে দিল্লি-আগ্রার তুলনায় কলকাতা খোকা-শহর হলেও এটাকে উড়িয়ে দেওয়া মোটেই ঠিক নয়। এখানে তাজমহল নেই, কুতুবমিনার নেই, যোধপুর-জয়সলমীরের মতো কেল্লা নেই, বিশ্বনাথের গলি নেই—এ সবই ঠিক-কিন্তু ভেবে দ্যাখ তোপ্‌সে—একটা সাহেব মশা মাছি সাপ ব্যাঙ বন-বাদাড়ে ভরা মাঠের এক প্রান্তে গঙ্গার ধারে বসে ভাবল এখানে সে কুঠির পত্তন করবে, আর দেখতে দেখতে বন-বাদাড় সাফ হয়ে গিয়ে সেখানে দালান উঠল, রাস্তা হল, রাস্তার ধারে লাইন করে গ্যাসের বাতি বসল, সেই রাস্তায় ঘোড়া ছুটল, পালকি ছুটল, আর একশো বছর যেতে না যেতে গড়ে উঠল এমন একটা শহর যার নাম হয়ে গেল সিটি অফ প্যালেসেজ। এখন সে শহরের কী ছিরি হয়েছে সেটা কথা নয়; আমি বলছি। ইতিহাসের কথা। শহরের রাস্তার নাম পালটে এরা সেই ইতিহাস মুছে ফেলতে চাইছে—কিন্তু সেটা কি উচিত? বা সেটা কি সম্ভব? অবিশ্যি সাহেবরা তাদের সুবিধের জন্যই এত সব করেছিল, কিন্তু যদি না করত, তা হলে ফেলুমিত্তির এখন কী করত ভেবে দ্যাখ! ছবিটা একবার কল্পনা করে দ্যাখ— তোর ফেলুদা—প্রদোষচন্দ্ৰ মিত্র, প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর—ঘাড় গুঁজে কলম পিশছে কোনও জমিদারি সেরেস্তায়, যেখানে ফিঙ্গারপ্রিন্ট বললে বুঝবে টিপসই।‘’
ছোটবেলায় লাইনগুলো প্রথমে পড়ে একটু খটকা লেগেছিল। কারণ ছোট থেকে শিখে এসেছি ইংরেজ শাসন ভারতবর্ষের এক কলঙ্কময় অধ্যায়। তার আগে ভারত ছিল এক সোনে কা চিড়িয়া। ভারতের প্রতিটি মানুষ পেট ভরে খেত, প্রাণভরে গাইত, প্রতিবেশীর সঙ্গে ভাইয়ের মতো বসবাস করত। ভারত – সুখী, সমৃদ্ধশালী একটি দেশকে কিভাবে ইংরেজরা তাঁদের কুরূপা এক রানীর ভাঁড়ার ভর্তি করতে তিলতিল করে শোষণ করেছিল। তবে এ কী কথা? তাও এক এমন সাহিত্যিকের কাছ থেকে যার ডিটেলিংয়ের নজরকে আলাদাভাবে শ্রদ্ধা করা হয়। এ কি এক বিশ্বনন্দিত পড়াশোনা জানা মানুষের শতরঞ্জ কা খিলাড়ি মাপের অভিজাত শ্লেষ? নাকি এই কথাগুলোর মধ্যেও লুকিয়ে রয়েছে এক না বলা ইতিহাসের ভগ্নাংশ?
বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়ে একটু আধটু পড়াশোনা করি। ফাইনানন্সিয়াল সেক্টরে বেচুবাবুর চাকরি ধরি। এই লেখা সেই টুকটাক পড়াশোনা আর পেশাগত অভিজ্ঞতার মিলিত ফসল। দুটো আপাত বিচ্ছিন্ন ব্যাপারকে একটু বুঝিয়ে বলা যাক। ফাইনান্সিয়াল সেক্টরে আমরা প্রায় একটা মডেল ব্যবহার করি। যাকে বলে, সিনারিও অ্যানালিসিস। সাদা কথায় বলা যায় একটা পরিপ্রেক্ষিতকে বার বার বদলে বদলে দেখা। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে দেখা। তার নির্মাণ এবং বিনির্মাণ করা।
বলা হয় ইতিহাস সময়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেয়। মনে হল, দেখাই যাক না সময়ের হাত ধরে সেই ইতিহাসের কাছে পৌঁছে। সদ্যজাত সেই ইতিহাসকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটু দেখি। সময়ের হাত ধরে একটু এগোই, আবার পিছিয়ে আসি, আবার এগোই। দেখাই যাক না ইংরেজ শাসনের আগে এবং ইংরেজ শাসনের ঠিক শুরুর সময় কেমন ছিল সেই সোনে কা চিড়িয়ার হৃৎপিণ্ড। হ্যাঁ হৃৎপিণ্ডই বলব। কারণ অতীতে বাংলা যে কতটা সমৃদ্ধ ছিল ফরসী পর্যটক বার্ণিয়েরের লেখা থেকে তার কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় – ” বাংলায় দু বার ভ্রমণ করে আমার ধারণা হয়েছে দেশটি মিশরের চেয়েও সমৃদ্ধ। জায়গাটি থেকে প্রচুর পরিমাণে রফতানি হয়। সুতি, সিল্ক, ধান – চাল, চিনি, মাখন এখানে প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয় এবং তাদের (অধিবাসীদের) নিজেদের ব্যবহারের পর উদ্বৃত্ত থাকে। এছাড়াও পাওয়া যায় গম, শাক – সবজি, অন্যান্য শস্যদানা, আনাজপাতি, হাঁস- মুরগি। এখানে প্রভূত পরিমানে শূয়োর , মাছ, ভেড়া এবং ছাগলও পাওয়া যায়। এত ধরনের মাছ এখানে পাওয়া যায় যে ভাবা যায় না।”
পাঠককে এই লেখাটি পাঠ করার সময় শুধু একটি ব্যাপারই মনে রাখতে অনুরোধ করব যে, এটি নেহাতই একটি ওয়েবজিনের জন্য লেখা মিনি সিরিজ প্রবন্ধ, নীরস কোন গবেষণাপত্র নয়। বলাই বাহুল্য, ইতিহাসের এই অলটারনেটিভ আঙ্গিকের লেখায় কোন জাতি, ব্যক্তি, ধর্ম, বংশ, রাজ্য, দেশকে কারোকে কোনরকম গ্লোরিফাই অথবা অসন্মান করার কোনরকম চেষ্টা দয়া করে খুঁজতে যাবেন না।
কথা শুরু করা যাক দাসদের নিয়ে। বা বলা ভাল ক্রীতদাসদের নিয়ে। ওই যাদের অপহরণ করে, গায়ের জোর খাটিয়ে, ভয় দেখিয়ে, পাচার করে বা জন্ম, বংশ, বর্ণ ইত্যাদির দোহাই দিয়ে অমানুষিক কায়িক পরিশ্রম, পতিতাবৃত্তি, যৌনাচার ইত্যাদির যে সিউডো- বৈধতা সভ্যতার আদিমযুগ থেকে পচা দগদগে ঘায়ের মতো সমাজের শরীরে লালিত পালিত হয়েছে সেই ভয়াবহ প্রথার শিকার হওয়া মানুষগুলিকে দিয়ে। কালো দাস, আফ্রিকান বা কাফ্রি দাস, নিগ্রো দাস এমন অনেক দাসদের কথা তো শুনেছেন, কিন্তু সাদা চামড়ার দাসদের কথা কি শুনেছেন?
দু হাজার সালের দিকে একটা বিতর্কিত বই বেরোয়। টু হেল অর বার্বাডোজ – দ্য এথনিক ক্লিনজিং অফ আয়ারল্যান্ড। লেখক সিন ও’ ক্যালাঘ্যান। তাতে অনেক কথা বলা হয়। প্রচুর চাপানউতোর চলে। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়। আইরিশ মানুষদের ধরে ধরে দাস বানানোর কথা বিস্তৃতভাবে লেখা ছিল তাতে। যার সূত্রপাত হয়েছিল রোমান আমলে। তারপর তা চলতে থাকে অটোমান সাম্রাজ্য ও আরব দাস ব্যবসায়ী হাত ধরে। এমনকি ইউরোপের বিভিন্ন দেশও সাদা চামড়ার আইরিশদের ধরে দাস হিসাবে চালান দিত। উচ্চ প্রজাতির গবাদি পশু সৃষ্টি করার মতো আইরিশ (সাদা চামড়া) দাস মেয়েদের সিস্টেম্যাটিক্যালি কালো মানুষদের দিয়ে নির্মম ধর্ষণ চালিয়ে জন্ম দেওয়ানো হত মিশ্রিত রঙের সন্তানদের। জন্ম নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই মিশ্রিত রঙের শিশুরা দাস হিসাবে চিহ্নিত হয়ে যেত মুলাটো (সাদা মা , কালো বাবার সন্তান) নামে, তাদের জন্য সাধারণ কালো দাসদের চেয়ে উঁচু দাম পাওয়া যেত। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই কাজ চালানো হয়েছে। মুলাটো, অর্থাৎ স্প্যানিশ ভাষায় ছোট্ট গাধা। মুলাটো, মানুষ গাধা – বোধহয় এভাবেই এই স্ল্যাং শব্দের জন্ম।
সভ্য সমাজের নিয়ম হল একটা মত এলেই তার বিরুদ্ধ মত আসবে। সেই বই প্রকাশের পর তা আসেও। এ বইয়ের সাথে এক হলোকাস্ট করেছে এমন সব লোকের নাম জুড়ে যায়। কেউ বলে এসব ঘটনা সত্যি, কেউ বলে মিথ। মোদ্দা কথা হল, দাস। এমন এক জিনিষ যার সাথে তার মালিক যা খুশি করতে পারে।। চিন্তা ভাবনাতেও আনা যায় না এমন ব্যবহার তা করা যায়। খারাপ লাগছে তো পড়ে? লাগাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই লেখার সঙ্গে তার যোগাযোগ কী?
আছে, যোগাযোগ আছে। কারণ, ইংরেজরা এই দেশে জমিয়ে বসার আগে পৃথিবীর অন্যতম বড় ক্রীতদাসের বাজার ছিল, মাইন্ড ইট, দেশের নয়, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্রীতদাসের র মেটেরিয়াল পাওয়ার বাজার ছিল এই সোনার দেশের সোনার বাংলা। হতভাগ্য সাধারণ বাঙালি মানুষেরা ছিল সেই দাস ব্যবসায়ীদের টার্গেট। সেই ব্যবসা চলতো হতো সরকারী বা আরও ভালভাবে বললে নবাবী শাসকদের মদতে।
আমার এক বন্ধু এক একটি বড় কোম্পানীর মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ। তার সাথে আমার যখনই আড্ডা হয়, একটা কথা ঘুরেফিরে আসে। সে বলে – বস বাঙালি জেনেটিক্যালি অত্যন্ত সহনশীল কাস্টমার, একবার যা ধরে প্রাণ থাকতে তা ছাড়তে পারে না। বাঙালি ভারতের সবথেকে সহনশীল জাতি। বছরের পর বছর একই জিনিস সহ্য করার ক্ষমতা তাদের মধ্যে অসীম। এই নিয়ে তারা কোন কমপ্লেন করে না।
ভাবুন একবার, যে মাটিতে পৃথিবীর সবচেয়ে ধুরন্ধর এক পশু জন্ম নেয় যার ক্ষিপ্রতা প্রবাদপ্রতিম, যার শিকারের প্রতি ফোকাস কিংবদন্তী, যার আক্রমণের টেকনিক তুলনাবিহীন, মজার ব্যাপার সেই মাটিতেই যে মানুষেরা এই দু – আড়াইশো বছর আগে জন্ম নিত তারা হত চরম বিশ্বস্ত, পাখির পালকের মতো নরম, শান্ত, ধীরস্থির, মান অপমান ঢোঁক গিলে হজম করে নেওয়া, ‘রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি’ ধরনের ভদ্র সভ্য ক্রীতদাস মেটেরিয়াল, জেনারেশন থেকে জেনরাশন তারা এই ব্যাপারকে সহ্য করেছে, ভুগেছে, সহ্য করেছে, কিন্তু টুঁ শব্দটি করেনি। আবার যখন সময় সুযোগ হয়েছে, তখন তা স্মুদলি ভুলে গিয়েছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিয়ে বাঙালির যতই শ্লাঘা থাকুক , রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার শুধু সুন্দরবনেই পাওয়া যায়, বাংলার অন্য কোথাও নয়।
ছোটবেলায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা দুটি বই পড়েছিলাম। জলদস্যু ও আঁধার রাতের অতিথি। হার্মাদদের বাঙালি দাস বানানোর গল্প। ছোটদের জন্যে লেখা। গল্পের হিরো বিশু ঠাকুর আর ভিলেন এক পর্তুগীজ জলদস্যু সেবাস্টিয়ান। শেষে বিশু ঠাকুর জিতে যান। জিতে তিনি কী করেন? না , বীভৎস জলদস্যু সেবাস্টিয়ানের গালে থাপ্পড় মারেন। ছোটদের জন্য লেখা বলেই বোধহয় স্বনামধন্য লেখক আর এর বেশি লেখেননি।
ফিরে আসি বাঙালির ক্রীতদাসত্বের ইতিহাসে। ইংরেজরা যে দেশ শাসন করেনি, দেশীয় শাসকেরা যে দেশ শাসন করতেন, যে বিশ্বস্ত প্রজাদের কাছ থেকে তাঁরা গুণে গুণে কর নিতেন তাঁদের তাঁরা কতটা সুখে রেখেছিলেন, ব্যাপারটা বুঝতে এটা সাহায্য করবে।
বলা হয় হুসেন শাহের আমলে হার্মাদরা বাঙলায় আসে। মগরাও। চট্টগ্রাম থেকে হুগলি অবধি ছিল তাদের মানুষ শিকারের কাজকারবার। একসময় মগ আর পর্তুগীজরা একসাথেই দাস ব্যবসা করতো। মুকুন্দরাম চক্রবর্ত্তী লিখেছেন –
ফিরিঙ্গির দেশ খান যাহে কর্ণধারে।
রাত্রিতে বাহিয়া যায় হারমাদের ডরে ।
এই জলুদস্যুরা বন্দুক, কামান সব ব্যবহার করতো। বাঙালিরা তখন আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারই জানত না ঠিকমতো। দ্বিজ বংশীদাস লিখেছেন –
মগ ফিরিঙ্গি যত
বন্দুক পালিত হত
একেবারে দশগুলি ছোটে।
বাঙালি সহনশীল জাতি। ‘মগের মুল্লুক’ নামে একটা কথাতেই পুরো ইতিহাসের কাজটা সব সেরে ফেলেছে। আর কিছু জানি আর না জানি, বিভিন্ন ধরনের কথা তৈরি করতে আমরা বরাবরই ওস্তাদ। কিন্তু বাঙলার উপর শুধু মগ নয় আরও অনেকে বিভিন্ন অত্যাচার করেছে। আর সেরকম ভয়াবহ সময়েও এধরনেরই আরও এক মনোরম বিষণ্ণতার ছড়া বাঙালি বেঁধেছে সেসময়। যে ছড়া প্রতিটি বাঙালি শিশু শুনতে শুনতে বড় হয়েছে –
খোকা ঘুমলো,
পাড়া জুড়লো,
বর্গী এলো দেশে-
বাকিটা সকলেই জানে।
বর্গী। তাদের গল্প সবাই জানে। তবে আজকের বাঙালির কি ডিটেলে জানা আছে তারা কি নির্মমভাবে অত্যাচার করতো?
কবি ভারতচন্দ্র লিখেছেন –
লুঠি বাঙ্গালার লোকে করিল কাঙ্গালি,
গঙ্গা পার হৈল বান্ধি নৌকার জাঙ্গলি।
কাটিল বিস্তর লোক গ্রাম গ্রাম পুরি ,
লুঠিয়া লইল ধন ঝিউড়ী বহুড়ী।
পলাইয়া কোঠে গিয়ে নবার রহিল,
কি কহিব বাঙ্গালার যে দশা হইল।
বানেশ্বর বিদ্যালংকার আরও বলেছেন –
সেক – সৈয়দ মোগল পাঠান যত গ্রামে ছিল
বরগির নাম সুইনা সব পলাইল।
কিন্তু এতো গেল সিচুয়েশনের বর্ণনা। আসল ব্যাপারটা তার চেয়ে অনেক পৈশাচিক, অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। কবি গঙ্গারামের কবিতাটিতে এর আসল নগ্ন এবং বীভৎস রূপটা তুলে ধরা হয়েছে –
মাঠ ঘেরিয়া বরগী দেয় তবে সাড়া ,
সোনা রূপা লুটে নে এ আর সবছাড়া।
কাটে হাত কাটে নাক কান,
একি চোটে কাটে বধএ পরাণ।
ভাল ভাল স্ত্রীলোক যত ধইরা লইয়া জাএ ,
অঙ্গুষ্টে দড়ি বাঁধি দেয় তার গলাএ।
একজন ছাড়ে তার আর জনা ধরে,
রমনের ভরে ত্রাহি শব্দ করে।
এই মতে বরগি কত পাপ কর্ম কইরা,
সেই সব স্ত্রীলোক যত দেয় সব ছাইড়া।
তবে মাঠে লুতিয়া বরগী গ্রামে সাধা এ।
বড় বড় ঘরে আইসা আগুনি লাগা এ।
কিন্তু মগ বা বর্গীর বহু আক্রমণের বহু আগে থেকেই বাঙলার উপর এক কদর্য আক্রমণ হয়ে চলেছিল। তা হল বাংলার ছেলেদের খোজা বানানোর শাসকদের সমর্থিত ব্যবসা। বাংলা থেকে প্রচুর অল্পবয়স্ক ছেলে ধরে তাদের খোজা বানিয়ে চালান করা হতো সারা পৃথিবীতে। ইউরোপ থেকে আরব, মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে মুঘল সম্রাট, সকলের বিকৃত কামনা চরিতার্থ করার জন্য সবচেয়ে প্রিয় বস্তু ছিল এই অল্পবয়েসী বাঙালি খোজা। একটি দুটি নয়, শোনা যায় সুলতানি আমল থেকে সামান্য একজন আমীরও কয়েকশো খোজা রাখতেন, যার মধ্যে বেশিরভাগই হতো বাঙালি অল্পবয়েসী ছেলে।
কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই সেটা শেষ নয়। খোজা বানানো ছাড়া, বাংলার ক্রীতদাসরা কোথায় কোথায় যেত জানলে পাঠক চমকে উঠবেন। তথ্য বলছে ষোলশ বাহান্ন সালে কেপ অফ গুড হোপের ডাচ সেটলমেন্টের অধিকারী বাটাভিয়া থেকে একটি বাঙালি রমনীকে বেছেবুছে খরিদ করেছিলেন। যে জাহাজ থেকে তিনি তাকে কিনেছিলেন সেই জাহাজ খোলভর্তি করে মা, বাপ ছেলে, মেয়ে শুদ্ধ দাস পরিবার নিয়ে যাচ্ছিল।
ষোলশ পঞ্চান্নর মে মাসে ওই কেপ অফ গুড হোপেন এক ডাচ ম্যান অন্য একটি বাঙালি দাস রমনীকে বিয়ে করে। সে সময় ওই দ্বীপে প্রচুর ডাচ আসছিল। বিভিন্ন প্রয়োজনে নারীর চাহিদা ছিল তুঙ্গে। কোন ডাচ রমনী তো আর সেই নতুন গড়ে ওঠা কলোনিতে থাকতে আসবে না। কমাস পর আবার একটি বাঙালি ক্রীতদাস রমনীকে বিয়ে করে আর এক ডাচ ম্যান এবং এভাবে চলতেই থাকে। ডাচ ম্যান ও বাঙালি ক্রীতদাসী উওম্যানের মিলনে জন্ম নিতে থাকে নতুন কলোনির মেম্বাররা। ভরে উঠতে থাকে একটি উপনিবেশ, যার প্রকৃত অধিবাসীরা কোনদিনই জানল না যে তাদের মায়ের দিকের শিকড় পুবদেশের এক তিমিরাচ্ছন্ন ছোট্ট রাজ্য অবধি ছড়িয়ে থাকল।
সতেরোশ থেকে আঠরোশ শতকে যখন এশিয়ার অন্য কোন জায়গা থেকে দাস সংগ্রহ করা যাচ্ছিল না, তখন এই বাংলা থেকে একচেটিয়া দাস সংগ্রহের ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে। ডাচ ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজগুলো বাংলা থেকে যাওয়ার সময় খোল ভরে বাঙালি দাস নিয়ে যেত এবং কেপ অফ গুড হোপে চড়া দামে বিক্রি করত। যখন ডাচ জাহাজগুলির আর বাঙালি ক্রীতদাস জাহাজে ভরার ক্ষমতা থাকত না, তখন ডেনমার্ক আর ব্রিটিশ জাহাজগুলি তাদের সাহায্য করত। যাওয়ার পথে তারা কোন ডাচ ট্রেডিং পোস্টে বা বাটাভিয়ায় সেই জীবন্ত কাঁচামাল নামিয়ে দিয়ে যেত, অসহায় বাঙালিরা অপেক্ষা করত বুভুক্ষু কেপ অফ গুড হোপের উপনিবেশের খাদ্য হওয়ার জন্য।
সেখান থেকে পালাবার চেষ্টা করত না কি কেউ? অবশ্যই করত। বর্তমান গবেষকরা নথিপত্র ঘেঁটে জানাচ্ছেন এক হতভাগ্য ক্রীতদাসের কাহিনী। জানা গিয়েছে। ১৭৩০ সালে সে চেষ্টা করেছিল এক বাঙালি মুসলিম ক্রীতদাস। কিন্তু সে বিফল হয় এবং ধরা পড়ে। তাকে ফিরিয়ে এনে তার প্রভুরা তাকে ক্ষমা করে দেয়। ক্ষমা করার আগে বীভৎস ভাবে চাবুক মারা হয়, সারা শরীরে ছ্যাঁকা দেওয়া হয়, দিনের পর দিন হাতকড়া দিয়ে বেঁধে রাখা হয় এবং দীর্ঘ ২৫ বছরের জন্য শিকল দিয়ে বেঁধে কঠোর পরিশ্রমের সাজা দেওয়া হয়।
যদি ক্ষমা না করা হতো তবে তাকে কোন গাড়ির চাকার সঙ্গে বেঁধে গাড়ি চালিয়ে হাড় গুঁড়িয়ে অতি যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুদন্ড দেওয়া হতো। কেপ অফ গুড হোপসের ডাচ সেটলমেন্টের পুরনো নথিপত্রগুলি একালের গবেষকেরা একটি একটি করে উদ্ধার করেছেন। তারা জানাচ্ছেন, সেই ভবিতব্য পেয়েছিল পালাতে চাওয়া অন্য বহু বাঙালি ক্রীতদাস। আর এই ঘটনা শুধুমাত্র কেপ অফ গুড হোপসে নয়, সাউথ আফ্রিকা, মরিশাস, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং পৃথিবীর যেখানে যেখানে যে যে দেশ উপনিবেশ স্থাপন করেছে সেখানে সেখানে খেলা খেলা বিয়ের জন্য বুভুক্ষু পুরুষদের প্রিয় ছিল বাঙালি ক্রীতদাসী, কায়িক পরিশ্রমের জন্য সবচেয়ে সহজলভ্য ছিল বাঙালি পুরুষ ক্রীতদাস।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এই যে চুরি করে, ধরে বেঁধে, বন্দী বানিয়ে বিদেশীরা দাস সংগ্রহ করত, তখন এই বাঙ্গালা মুলুকের শাসক স্বাধীন বা মোগল অধীনস্থ নবাবরা কী করতেন?
উত্তর, তারা তখন ওই দাস পাচারের জাহাজগুলির কাছ থেকে ট্যাক্স সংগ্রহ করতেন। সেই ট্যাক্স যেত দিল্লিতে সুলতানদের রাজপুতদের সঙ্গে যুদ্ধ করার রসদ যোগাড় করতে, একটি পরিপুষ্ট হারেম বজায় রাখতে ও অন্যান্য তৎকালীন দেশোদ্ধারের জরুরী কাজে। সেই রক্তাক্ত ট্যাক্স সংগ্রহ করার জন্য এ দেশীয় নবাবরা বিভিন্ন উদ্ভাবনী পদ্ধতি ভেবে বার করতেন, মৌজ করতেন এবং আরও অনেক কিছু করতেন যার বিবরণ আসতে চলেছে।
তবে সোনার দেশের সোনার মানুষেরা এসব কিছু মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি। বোধহয় তাঁরা ভেবেছিলেন পুরনো কথা যত ভুলে যাওয়া যায় ততই ভাল। তারা বরং সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন, কবিতা, ছড়া, গান টান লিখেছেন। সেই ঐতিহ্য আমরা আজও বহন করে চলেছি। হ্যাঁ, তবে গালাগাল মনে রেখেছি। অবশ্য সেদিনকার নয়, তার অনেক অনেক পরের ঘটনা। ১৯৫০, ৬৪, ৭১ আমাদের শিখিয়েছিল একটা খুব ইন্টারেস্টিং খিস্তি। জেনোসাইডেও কীভাবে লিঙ্গবৈষম্য করা যায় তা আমরা দেখিয়েছি। ‘খানকি মাগি’ – অসীম যন্ত্রণার এই কথাটা আজও কী সুস্পষ্ট, সুন্দরভাবে আমরা মনে রেখে চলেছি ও তা ব্যবহার করছি। অথচ এক জাতি যে তার নারীদের রক্ষা করতে পারেনি তার ইতিহাস ভুলে গিয়েছি।
তথ্যসূত্র: 
পূর্ববঙ্গ গীতিকা, আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন
এশিয়ান টাইমস, লন্ডন, নভেম্বর ১৯৯০
উইকিপিডিয়া

ক্রমশ… 

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।