সবাই শিল্প সাহিত্যের রস বুঝেননা; কেউ কেউ বুঝেন। শিল্প সাহিত্য সঙ্গীতের রস না বুঝলে জীবন কোথাও আটকায়না। জীবন একটা চাকার মতো বৃত্তের মধ্যেই ঘুরপাক খায়। অনেকটা কলুর বলদের মত। চোখ দুটি অন্ধ করা/ বেঁধে দেওয়া তারপর একটা জোয়াল কাঁধে একই বৃত্তের চারিদিকে চলা। আর যারা শিল্প বুঝেন, তারা একটা ভাবনাকে ধাপে ধাপে উন্নত অবস্থা- যেখানে অধিক স্বচ্ছন্দ, আনন্দ, ও স্বাধীনতা র দিকে এগিয়ে যান। শিল্প হল সামাজিক চলিত জীবনের মোড়ক পরানো চর্চা। ভাবনাকে, সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এই চর্চা করতে গিয়ে মানুষ- যারা শিল্পী- তারা কিছু মাইল ফলক বা মাইল স্টোন এর মত কিছু বস্তু নির্মাণ করেন। এই নির্মাণ গুলিই শিল্পকৃতি বলে আখ্যাত হয় ইতিহাসে স্থান নেয়।
বুদ্ধিদীপ্ত মানুষেরা, মেধাবী চর্চাকারী মানুষেরা সবসময় জীবনকে অধিক স্বাধীনতা ও স্বাচ্ছন্দ্য দিতে চায়।
তারা প্রতিটি দিন জীবন যাপনের চর্চা করে। সমাজের অভাব অনটন, প্লেগ মহামাড়ী, উন্নতি অবনতি, যুদ্ধ সমস্ত কিছুই চর্চার মাধ্যমে দেখে, মংগল ও সুন্দর বা শান্তি । শিল্প সাহিত্য,নাটক সংগীত নৃত্য এগুলি তারই একটা অংশ। সবাই গান করেনা, কেউ কেউ করে। সবাই নাটক সৃষ্টি করেনা কেউ কেউ করে। সবাই গল্প লেখেনা, কেউ কেউ ছবিও আঁকে। সমস্ত লোকসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ, যদি ধরি শিল্পসংস্কৃতির চর্চা কারী তাহলে ধরুন, ছবি আঁকে, শিল্প সৃষ্টি করে তার এক দশমাংশ। বাকী নয় ভাগ অন্যান্য মাধ্যমের শিল্প সৃষ্টি করে। যথা, নাচ গান নাটক, কবিতা ইত্যাদি।
এবার শিল্প চর্চা অনেকেই করে সবাইকে শিল্পী বলা যাবেনা। কারণ যতক্ষন না আপনি কোন নতুন দর্শন বা উপলব্ধি জীবনের গভীর উপলব্ধি বোধ থেকে আহরণ করে এনে দর্শক বা শ্রোতাকে দিচ্ছেন। ইংরাজীতে ‘আর্ট’ বলে একটা শব্দ- যার মানে হল , কল্পনার সচেতন ব্যবহারে কোন বস্তু উৎপাদন, ও উদ্দেশ্য থাকে এটা দর্শকের চোখে সুন্দরতার ভাবনা বা অর্থবহতা দেবে। তার সাথে রূপ সৃষ্টি, শব্দ বা কথারা থাকবে।
(The conscious use of the imagination in the production of objects intended to be contemplated or appreciated as beautiful, as in the arrangement of forms, sounds, or words.)
মোটামুটি এটাই আন্তঃর্জাতিক দৃষ্টিতে শিল্পের আধুনিক সংজ্ঞা।
যে বস্তুটি আপনি এত এত ভাবনা চিন্তা করে বানালেন, নির্মাণ দিলেন, সেই বস্তুটি একটি উপলক্ষ মাত্র। আপনার ভাবনা বা আবিস্কৃত গল্পটি হল শিল্প। নির্মিত বস্তুটি দর্শক দেখে সে বানাতেই পারে অনায়াসে। কিন্তু আপনি যে দর্শন বা উপলব্ধির কথা বলে বস্তুটি নির্মাণ করলেন,সেই দর্শন বা উপলব্ধি হল আসল সম্পদ।সেটি কেউ নকল করতে পারবেনা।
যেমন ধরুন ‘দাদাইজম’ ১৯১৫ সালে (Zürich, Switzerland)যে ভাবনাটা নিয়ে এল , যে যুক্তি গ্রাহ্যতা, নান্দনিকতা ইত্যাদি শৃঙ্খলা ভেঙ্গে, মানুষের প্রকাশ কে আরো মুক্ত করে এনে দিল। এরকম প্রতিটি শিল্প আন্দোলন, কোন না কোন নতুন ভাবনা সমাজকে দিয়েছে। সমাজ ধাপে ধাপে এগিয়েছে।
আগে মানুষ অনেক বস্তু ভেঙ্গে গেলে ফেলে দিত। যেমন ধরুন খবরের কাগজ। এখন সেগুলি রিসাইকেল মানে পুনরায় এটাকে ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সমাজ সবসময় চর্চা করে, মানুষের জীবন কী করে উন্নত ধাপে নিয়ে যাওয়া যায়। এই চর্চাগুলি করে বুদ্ধিদীপ্ত বা মেধাবী লোকেরা নানা মাধ্যমে। কেউ সাহিত্যে, কবিতায়, নাটকে, ছবি বা ভাস্কর্যে। কোন গৎবাঁধা সা রে গা মা নয়। বরং নিজেকে প্রকাশ করার জন্য সরগমকে নিয়ে খেলা করা। যারা যন্ত্র সঙ্গীত শুনেছেন, পন্ডিত রবি শঙ্কর বা খেয়াল সম্রাট বড়েগোলাম প্রমুখদের – তারা বুঝতে পারবেন গৎবাঁধা সা রে গা মা মুখস্ত করা আর সা রে গা মা নিয়ে খেলা করার পার্থক্য।
জীবন কেমন চলছে, প্রকৃত শিল্পীর ছবি দেখে বা ভাস্কর্য দেখে বলা যায়। জীবনকে আনন্দ যেমন দিতে হয়, ভাবনাও দিতে হয়, এমনকি সমালোচনাপূর্ণ আধার বা চিন্তাও দিতে হয়। তবেই শিল্প সমকালীন ও পূর্ণতা পায়।
গত শতাব্দীগুলি পশ্চিমের- ইউরোপ ও আমেরিকাতে এই চর্চাই নিরন্তর চলছে। এশিয়াতে আফ্রিকাতে একই বৃত্তে ঘোরপাক খাচ্ছে বলেই আমাদের কোন উন্নতি হয়নি। সাংস্কৃতিক উন্নতি না হলে, মেধার বিকাশ ঘটেনা। মেধার বিকাশ ঘটে তখনই যখন তিনবা সাত জন প্রতিনিয়ত সময় করে, চর্চা করে উন্নতি ঘটাবার জন্য। আমাদের দেশে, খবরের কাগজ আর টিভি সাধারণের চর্চার বিষয়গুলি ধরিয়ে দেয়, যা থেকে দেশের অন্ধকার বাড়তে থাকে।
কলকাতায় তিন চারটি আর্ট কলেজ আছে, ডিপ্লোমা ধরলে হয়ত আরো কিছু সংখ্যা বাড়বে। কিন্তু সেগুলিতে শিল্প চর্চা হয়না। পঠন পাঠন হয়। পঠন পাঠন আর চর্চা আলাদা বস্তু দুটি। পঠন পাঠন হল, নির্দিষ্ট সিলেবাস, শিক্ষকেরা ছাত্রদের শেখান। চর্চা হল অনির্দিষ্ট বস্তু নিয়ে অর্থবহ আলোচনা।
আমি মনস্থ করেছিলাম, পার্থপ্রতিম দেবের শিল্প উপস্থাপনা করব বলে। কিন্তু উপরের কথাগুলি না বুঝে পার্থপ্রতিম দেবের কাজ বোঝা কঠিন।
পার্থপ্রতিম দেব। জন্ম ১৯৪৩, সিলেট , বাংলাদেশ। তিনি শান্তিনিকেতন, কলাভবন থেকে পাশ করে বরোদা থেকে পোস্ট ডিপ্লোমা করে (post diploma from Faculty of Fine Arts, M.S. University of Baroda) রবীন্দ্র ভারতীতে শিক্ষকতা করেন। অধ্যক্ষ বা ডীন ছিলেন। তার অনেক ছাত্র ছাত্রী। একজন পন্ডিত মানুষ। রবীন্দ্রভারতীর জার্নালে অনেক প্রবন্ধ ও নন্দলাল বসুর উপর লেখা প্রকাশ করেন। ‘৭৪ সাল থেকে তিনি নিয়মিত গ্রুপ শোতে তার কাজ প্রদর্শণ করে আসছেন। একক প্রদর্শনীও করেছেন।
ভারতে যে কয়জন সমকালীন শিল্পী আছেন, দেশ বিদেশে আলোচিত হয় তার মধ্যে তিনি একজন।
আমি যে বিষয়গুলি এই দীর্ঘ নিবন্ধটি লিখেছি, তা শুধু আমাদের বাংলা শিল্প প্রেমী ও ছাত্র ছাত্রীদের কাছে শিল্প কী তা বোঝাবার জন্য। আর আমার বক্তব্যের সম্পূরক ছবি হিসাবে আমি পশ্চিমী বিখ্যাত শিল্পী দিতে পারতাম। তা না করে পার্থপ্রতীম দেবের কিছু কাজ দিচ্ছি, যে অনেকে অনুপ্রাণিত বোধ করবেন। পার্থপ্রতিম দেব আমাদের কাছে এক আলোক বর্তিকা। তাকে আমরা নিঃসন্দেহে অনুসরণ করতে পারি। তার ভাবনার ছায়া হয়ে শিল্পকে বুঝতে পারি। পার্থপ্রতীম দেব একজায়গায় বলেছেন, (the connotation of visual creativity does not hold on to any ‘ism’ or style, but is an outcome of spontaneous playfulness happening as a process of introspection and submission.) ‘দৃশ্যকলা, বা দৃস্টিগ্রাহ্য সৃষ্টি কোন ইজম বা স্টাইল বলেনা, আপনি যখন কিছু ভেবে নির্মাণে হাত লাগাবেন, স্বতঃস্ফুর্ত খেলতে খেলতে নির্মাণটি পরিণতি পাবে।’
কথাটা বলা সহজ, কিন্তু স্বতঃস্ফুর্ত খেলা তারাই খেলতে পারে, যারা গভীর জীবনবোধ জানে, আর খেলতে খেলতে খেলাটাকে আংগুলের ডগায় তুলে এনেছে। এই খেলাতে নাম লেখাতে হলে, পড়াশুনা ও চর্চা আবশ্যিক। একটা ছাঁচ বানিয়ে অনেক ছবি আঁকা নয়। প্রতিটা ছবিতেই নতুন কথা বলা।
পার্থপ্রতিম দেব। দেখবেন, তার উজ্জ্বল মুখটিতে সবসময় একটি মজা বা খুশীর ছাপ। খুবই রসিক বোধের মানুষ। তার ছবিতে সেই রস ও মজা প্রতিফলিত। তিনি তার কালি কলমের ড্রয়িং বা ক্যানভাসের পেইন্টিয়ে, সমকালীন সামাজিক জীবনকেই নানা রস/ মজা, ইংরাজীতে যাকে আমরা হিউমার বলি তাই দেখিয়েছেন। তার প্রতিটি কাজই নানা খেলা বা মজা বুদ্ধিদীপ্ততার সাথে মিশে থাকে। কখনো দাদাইজমের ছোঁয়া থাকে। ফেলে দেওয়া জিনিসের মধ্যে তিনি কিছু ভাবনা জুড়ে সুন্দর বা গল্প সৃষ্টি করেন। পশ্চিমের শিল্প – দাদাইজমের বা পোস্ট মডার্ণ আর্টের মিশেল প্রভাব তার কাজে লক্ষনীয়। সর্বোপরি, তিনি এক স্বাধীন সত্বা, তার শিল্প সমকালীন ভারতীয় শিল্পে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে। এবং তার সৃষ্ট বস্তু এতটাই গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বড় বড় মিউজিয়াম বা গ্যালারীতে সেগুলি সংগ্রহিত হয়েছে। ভারতের National Gallery of Modern Art, New Delhi and the Delhi Art Gallery, New Delhi. তাছাড়া দেশবিদেশের শিল্প গবেষণার ছাত্র ছাত্রীরা তার শিল্প ভাবনা নিয়ে চর্চা করে।
ঋণ স্বীকারঃ নানা অনলাইন গ্যালারী থেকে পার্থপ্রতিম দেবের ছবি নেওয়া হয়েছে।
টেকটাচটক একটি ভালো উদ্যোগ। চলতে থাকুক। সুযোগ পেলে ফের পড়া যাবে। লেখাও যেতে পারে।