“নাও, ওঠো দেখি। এটা পরে নাও চট করে।”
আমগাছের উপর কাঠবেড়ালীটাকে দেখে সবে মাত্র কি যেন একটা ভাবতে যাচ্ছিলাম পেছন থেকে শরীরের দুপাশে বিভিন্ন ধরণের খোঁচা অনুভব করলাম। ভাবনা ভুলে পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখি নন্দিতা, হাতে কালো সূতোয় বাঁধা একটা তাগা। তাই দেখে আঁতকে উঠে বললাম, “এটা আবার কি?”
“তেত্রিশ কোটি মিলে তো তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি পোক্ত করল না। তাই এই আমার তেত্রিশ কোটি এক নম্বর চেষ্টা।”
তা বটে, যদি সংস্কৃতে কোটি শব্দের অর্থ রকম হয়, তবে কর গুনলে তাও তেত্রিশ প্রকার পরীক্ষা নিরীক্ষা চলেছে বটে ভাগ্য ফেরানোর। তাই এই তাগা, কার মাধ্যমে কোন এক দরগার থেকে আনিয়েছে। পাশের বাড়ির নীলু নাকি বলেছে ভোরে আজান শুনে এসে সকালে ঘুম থেকে উঠলে পরাতে। তাই এই আয়োজন। জ্যোতিষ অনুসারে তেত্রিশ রকম প্রচেষ্টার মধ্যে আপাতত বোধ হয় আর কোনোটিই বাকি নেই। রত্ন, ধাতু, কবচ, আংটি, মাদুলি, শেকড় বাকর কিছুই বাকি নেই আর। মধ্যে সন্ধ্যে হলে ঘর অন্ধকার করে ধুনো ঝাড়া শুরু করেছিল বটে, শ্বাসকষ্টের দরুণ সেটা আপাতত স্থগিত রয়েছে এইটুকুই যা বাঁচোয়া। এখন তেত্রিশ ছাপিয়ে অন্য শাখার প্রচেষ্টা। দরগা, গুরুদ্বার, গুম্ফা – এমন অনেক প্রতিষ্ঠানও আছে, আমাদের ভাগ্য এদের প্রত্যেকের সঙ্গেই গভীর ভাবে জড়িত। এত প্রচেষ্টা কখনই বৃথা যেতে পারে না। তা সেই মতো নানা গয়নাগাটি পরার সৌভাগ্য মাঝে মাঝেই হয়ে থাকে যেহেতু তাঁর পিতৃদেব মাত্র একটি চুনীর মাধ্যমে প্রবল প্রতিপত্তি বিস্তার করেছেন। কিন্তু আমার ভাগ্য ফেরানোর ক্ষেত্রে আদর্শ পরশপাথরটি খুঁজে না পেয়ে তিনি বড়ই নাজেহাল। মাঝে শুনেছিলাম ফেং শুই মতে আমার একখানি দাঁতও বাঁধিয়ে নিতে হবে, যাক সেই পর্ব এখনও ধামাচাপা পড়ে রয়েছে।
এই জ্যোতিষ প্রসঙ্গে আমাদের জগাদার অভিজ্ঞতা ভয়ঙ্কর। পাড়ায় তখন পল্টু কদিন বাইরে ঘুরে কি এক আচার্য পদবী নিয়ে ফিরে এলো। বাজারে তার ছোট চেম্বার। কদিন বাদে জগাদা তার কোনও এক পরামর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে চেম্বারের দিকে যাওয়া শুরু করলো। সারাদিন ধরে নানা ব্যবসা সামলে সন্ধ্যের পর এই যাতায়াত নিয়মিত হলো। সামনের চায়ের দোকানে বসে আমরা লক্ষ্য করতাম জগাদা ঢুকলেই পল্টুকে চেম্বার থেকে বেরিয়ে পাশের পানের দোকানের দিকে যেতে জল, চানাচুর, সিগারেট প্রভৃতি নিয়ে আসার কারণে। তারপর আমি কোনও কারণে বেশ কয়েকদিন এলাকায় ছিলাম না। মাস ছয়েক বাদে কাকার চায়ের দোকানে একদিন বসে দেখি পল্টুর চেম্বার বন্ধ। কারণ জিজ্ঞেস করায় শুনলাম পল্টু নতুন অফিস নিয়েছে, অনেকে কাজ করে সেখানে। পল্টুর এই হ্যানো উন্নতির কথা শুনে আশ্চর্যই হলাম। জগাদার খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম তার বাড়িরই নিচের তলায় পল্টুর নতুন অফিস, তার উপর তলায় বাবা-মায়ের সাথে পল্টু থাকে। আর জগাদা বৌ ছেলে মেয়ে নিয়ে অন্য পাড়ায় এক বাড়ি ভাড়া নিয়ে আছে মাসদুয়েক হলো। তার নিজস্ব দুটি লরি বেচে চারটি অটোরিক্সা কিনেছেন। পল্টু তাকে নাকি কথা দিয়ে রেখেছে ছেলে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলেই তাকে নিজের কোম্পানিতে ঢুকিয়ে জীবন গড়ে দেবে।” এছাড়াও পল্টু জগাদার দুটি লরি সমেত আচার্য ট্রান্সপোর্টেরও মালিক।
নন্দিতা গলায় তাগাটা বাঁধতে লাগল। এই দেখে আমি হাতের থেকে কবচটা খুলতে গেছি, নন্দিতা বাধা দিল। বলল, “ওটা খুলছ কেন? কিচ্ছু খুলবে না।”
বুঝতে পারলাম আমার শরীর এবার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আস্ত একটা নিদর্শন হতে চলেছে। এই সব পজিটিভ শক্তির মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অনেক জটিল বিষয় হলেও নেগেটিভ শক্তিদের, মানে অপদেবতাদের মধ্যে কিন্তু তা নেই। তারা সবাই মিলে মিশে থাকে। তাদের সম্প্রীতি রক্ষার একটা গল্প শুনেছিলাম বীরেনদার থেকে।
কোনও এক কাজে বীরেনদা মালদার এক গ্রামে পৌঁছেছিলেন বীরেনদা। ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেছে, গাড়ি ঘোড়া সব বন্ধ। অগত্যা রাস্তার থেকে কোনও লিফট পাওয়ার জন্য বীরেনদা ঠিক করলেন তিনি সামনের দিকেই এগোবেন। গ্রামের সবাই নিষেধ করলো ওই রাস্তায় যেতে, রাতের বেলায় রাস্তায় অপদেবতারা চলাচল করে। তখনও সেই গ্রামে ভূত-আত্মায় বিশ্বাস করে। বীরেনদা এই সব বুজরুকি কানে না তুলে এগোতে লাগলেন। ঘন্টাখানেক এগিয়েছেন, সব কটি গাড়িই তাকে না দেখার ভান করে চলে গেছে। হঠাৎ তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন সামনের থেকে কেউ এগিয়ে আসছে মানুষের মতো। তিনি তড়িঘড়ি এগিয়ে গেলেন সেদিকে, অন্তত জানতে পারবেন সামনের লোকালয় আর কত দূরে।
খানিকটা এগোনোর পর বিকট একটা আওয়াজ পেলেন সামনের থেকে। খানিক এগিয়ে আবছা আলোয় দেখতে পেলেন কেউ একজন রাস্তার ধারে মাটিতে উবু হয়ে বসে পরিত্রাহী চিৎকার করে চলেছে, “লা ইল্লা ইল্লিল্লা, মহম্মদ রসূল ইল্লা।” আওয়াজ শুনে তিনি ভাবলেন গ্রামের কেউ হয়ত রাস্তার মাঝে বিপদে পড়ে প্রার্থনা করছে। মানুষের বিপদে মানুষই থাকে ভেবে এগিয়ে গেলেন তার দিকে। কিছুটা এগোতেই হঠাৎ সামনের লোকটা তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে ‘রাম রাম’ বলতে বলতে উল্টোদিকে দৌড়। বীরেনদাও ছুটে গিয়ে কোনওক্রমে তাকে ধরে জানতে পারলেন যে সেই লোকটি গ্রামেরই লোক, মুসলমান। এই দিন রাত্রে পাশের গ্রামে মেয়ের বাড়ি থেকে কোনও গাড়িঘোড়া না পেয়ে ফিরছিলেন। রাস্তাটির বদনাম সম্পর্কে সেও অবগত এবং তাইতে উলটো দিক থেকে বীরেনদাকে আসতে দেখে ভয় পেয়েছে। বীরেনদা তার ভয় ভাঙায় ও সেই লোকটিও গ্রামে ফিরে সেই রাতের মতো বীরেনদাকে তার বাড়িতেই আশ্রয় দেয়।
গলায় তাগাবাঁধা শেষ হয়েছিল। নন্দিতার কথায় তা পরম ভক্তি ভরে দুই চোখে ছোঁয়াতেই সে বলল, “এবার চুমু খাও।” তার আদেশ অমান্য করার ক্ষমতা আমার নেই। এই অসময়ে তার দিকে এগোতেই আমার মুখটা ঘুরিয়ে তাগার দিকে নির্দেশ করে বলল, “আমায় না, এটায় খাও। সুযোগ পেলেই খালি ছোঁক ছোঁক। এই তোমার গলায় বেঁধে দিলাম, এবার থেকে প্রতিদিন সকালে ঠিক এইভাবে প্রার্থনা করবে।” প্রার্থনাতে আমি খুব বিশ্বাস করি, যার জন্যে আমার প্রতি নন্দিতার এই প্রার্থনা রাখার প্রতিশ্রুতি দিলাম। নইলে কে জানে, আমার অবস্থাও দক্ষিণ আফ্রিকার সেই যাজকের মতো হয় কিনা যে তখনকার বর্বোরোচিত আফ্রিকায় খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচার করতে করতে সেরেঙ্গেটি পৌঁছে গিয়েছিল। পথে যেতে যেতে দেখল তার রাস্তার সামনে এক প্রকাণ্ড সিংহ তাকে দেখে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছে। প্রভু যীশুর এই হ্যানো মাহাত্ম্য দেখে যাজক ভাবলেন যে সিংহটা বোধ হয় তাকে দেখে ভয় পেয়েছে। সে সিংহটাকে অভয় দিয়ে বলল, “বাছা খ্রীষ্টের শিশু, তুমি প্রার্থনা করছ কেন? আমি একজন যাজক, তোমায় মারব না। এই আফ্রিকায় যারা পশুহত্যা করতে আসছে, তারা সব নরাধম, ঈশ্বরের কুলাঙ্গার সন্তান। তুমি আমাকে দেখে ভয় পেও না।”
যাজকের কথা শুনে সিংহটি উত্তর দিলো, “আমি জানি মহামতি, আপনি তা পারেন না। আমি শুধু লাঞ্চের আগে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনাটা সেরে নিচ্ছিলাম।”
তাই প্রার্থনাকে আমি বড়ই সমীহ করি। তার উপর নন্দিতার আদেশ। না মানলে কোনদিন গোঁসা করে বাপের বাড়ি চলে যাবে আর ডিভোর্সের হুমকি দেবে। আমার অবস্থা এখন পুরাকালের আদমের মতো, তার আর ইভের প্রেমকাহিনি শুনেছিলাম। কোনও এক সুন্দর বিকেলে ইভ আদমকে প্রশ্ন করেছিল, “আমায় তুমি ভালোবাসো?” উত্তরে আদম জানিয়েছিল, “উপায় তো নেই আর।”
দশচক্রে ভূতেও নাকি ভগবান হয় শুনেছিলাম, কিন্তু আমার গত তেত্রিশ চক্রের ছেষট্টি রকম আদেশের দরুন যে চারিদিকে বিধিনিষেধের বলয় তৈরি হয়েছে, সেই চক্রব্যুহে বসে আমার বাংলাদেশের ভাই ফৈজল মিঞার কথা মনে পড়ে।
একদিন কুশল জিজ্ঞেস করতে ফৈজল ভাইকে ফোনে ধরতে শুনি ভাইজান বেজায় খাপ্পা। কারণ জিজ্ঞেস করতে বললেন, “আরে ভাইজান আর কয়ো না, তোমার ভাবীর কথায় আলেম বানাতে পোলাটারে মাদ্রাসায় ভর্তি করেছিলাম।”
আমি বললাম, “তাতে অসুবিধে কি? তোমাদের তো অমন রীতি। ভাবী আবার ভুল করলো কী?”
“ভুল বলে ভুল? কী বিপদে আমি পড়েছি ভাইজান হারুণরে আলেম বানায়ে।” ফৈজল ভাই আক্ষেপ শুরু করলেন, “গতকাল হারুণ রে লয়্যা আমি বাজারে যাচ্ছি। পথে খানিক বাথরুম চাপায় ওরে দাঁড় করায়ে এক ঝোপের মধ্যে গিয়েছি। তাই দেখে হারুণ কয়, ‘ক্কিবলার দিকে দাঁড়ায়ে মোতা হারাম।’ তা মাদ্রাসার থেকে শিখেছে, তাই তার কথা শুনে একটু ঘুরে দাঁড়ালাম। তাই দেখে কয়, ‘উত্তরে মুর্দার মাথা দেয়।’ তাও মান্যি করে আমি আরও ঘুরে সবে শুরু করবো কি, সে বলে, ‘ক্কিবলার দিকে পিঠ দিয়ে করা মাকরুহ।’ পোলাডারে আলেম বানায়ে আমি কি অহন শান্তিতে মোতবারও পারব না?”
এর কিই বা উত্তর দিই? ফৈজল ভাইয়ের উপর করুণা চেয়ে সেদিন ফোন রেখে দিতে বাধ্য হই। তার সাম্প্রতিক কোনও খোঁজ আপাতত আমার কাছে নেই। চেয়ার থেকে উঠে পড়লাম, দেহের চারিদিকে টুং-টাং-ঝুন-ঝুন আওয়াজ হাঁটতে চলতে। তাই নিয়ে এগিয়ে গেলাম জানলার দিকে, নন্দিতা ফিরলে এর যা হোক একটা কিছু বিহিত করতে হবে। আজ তাকে বুঝতেই হবে আমার কষ্টগুলো।
বাইরের রাস্তায় পোস্টম্যানের সঙ্গে নন্দিতা কথা বলছে। আমার দিকে চোখ পড়তেই এক গাল হাসি নিয়ে পোস্টম্যানকে বিদায় দিয়ে একটি খাম সমেত এগিয়ে এলো আমার দিকে।
হাসির কারণ জানতে সে বাদামী রঙয়ের খামটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো। প্রেরকের উপর চোখ পড়তেই দেখলাম সেখানে লেখা, ‘ABP Pvt. Ltd.’