বাসন লেবে গো বাসন…এই সুরটার সঙ্গে আমাদের আশির দশক বেশ পরিচিত।রোজ একটু বেলার দিকে ঝোলা আর মাথায় ঝুড়ি ভরতি বাসন নিয়ে এক মহিলা ও তার মেয়ে আসত।সুর করে করে সে হাঁকতো বাসন লিবে বাসন?তার বিনিময়ে টাকা নয়,পয়সা নয়।তাকে দিতে হত কতগুলো ছেঁড়া কিংবা পুরোনো রংচটা শাড়ি,শার্ট,প্যান্ট,ধুতি,পাঞ্জাবি, পাজামা,এমনকি বিছানার চাদরও।তখনো আমরা চুড়িদার পরা শুরু করিনি।তাই সেটা দেওয়া যেত না।পাশের ঘরের কাকিমা আর মা দুজনে মিলে বাসন পছন্দ করত তার ঝুড়ি থেকে।তারপর দুজনের মিলিত শাড়ি ও প্যান্ট শার্ট নিয়ে হয়তো তার বিনিময়ে দুটো বাটি,একটা থালা এসব পাওয়া যেত।
বাসনওয়ালির পরনে জরি দেওয়া সিন্থেটিক শাড়ি একটু উঁচু করে সামনে আঁচল দিয়ে পরা।চুলের বেনীতে টারসেল ঝুলতো।লাল নীল হলুদ সবুজ হলুদ কত রকম সে টারসেল।কপালে চুমকি বসানো টিপ,পায়ে মোটা তোড়া।আধা বাংলা আর বেশিরভাগটাই হিন্দিতে কথা বলত।আর এক দুটো কথা বলার পরই বলত কী বলে মাইজি!এরা বেশিরভাগই আসত রাজস্থান বা উত্তর ভারত থেকে।হিন্দি না বুঝলেও এটুকু বুঝতে পারতাম যখন তারা তাদের মুলুকের কথা বলত।সেই সময় তাদের মুখের হাসিটা এতটাই উদ্ভাসিত হত যে মুগ্ধ হয়ে দেখতাম।
একবার মা কাকিমার আলোচনায় শুনেছিলাম এই বাসনওয়ালী মাসিকে তার সোয়ামি ফুঁসলে এনেছিল সেই সুদূর রাজস্থান থেকে শাদি করার স্বপ্ন দেখিয়ে।তারপর এই কলকাতা শহরে এসে কদিন এক বস্তিতে কাটিয়ে পেটে বাচ্চা এনে দিয়ে পালিয়ে গেছে। সে দুঃক করে বলেছিল,খুব ভালোবাসতাম তাকে,বহুত খুশ হুয়া উসকে সাথ কলকাত্তা আ কে।লেকিন উনহে এমনি করবে সমঝে নহি।
আব মেরি লেড়কী কো কে হোগা রাম জানে।
এই রাম জানে কথাটা শুনলেই আমার রাগ হত।যে লোকটা নিজের স্ত্রীকেই সম্মান দিতে পারেনি,পেটে বাচ্চা সহ ছেড়ে দিয়েছিল,সে তোমার বেটির কোন ভালো করবে!রাম জানে রাম জানে! রাম জানে বলেই এই হাল,মাকে একদিন রেগে বলেছিলাম।তখন রামায়ন মহাভারতের চরিত্র গুলো প্রায় মুখস্থ। রাম সবচেয়ে নিষ্ঠুর।তার চেয়ে রাবন ভালো।মন্দোদরীকে ছেড়ে তো যায়নি।কেন যে লোকে রামের পুজো করে!
রাম থেকে মরা ভালো।
পাশের বাড়ির দিদা বলেছিল,মরা থেকেই রাম এসেছে।রাম নাম উচ্চারণ করতে না পেরে বাল্মিকী মরা উচ্চারণ করতে করতে রাম বলেছিল।তাই রাম।
দিদা আরো বলেছিল, রামায়নের উত্তরাখন্ডে বাল্মীকির প্রথম জীবনের একটি কাহিনি পাওয়া যায় । প্রথম জীবনে বাল্মীকি ছিলেন রাজপথের দস্যু । তিনি দস্যুবৃত্তি ক’রেই পরিবার পালন করতেন । একদিন নারদকে লুঠ করতে গেলে নারদ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন,তুমি এত মানুষকে মেরে লুঠ করো।কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছ কি যে তোমার পাপের ভাগী তোমার পরিবার হতে চায় কি-না ।তুমি বাড়ি গিয়ে সেটা জানতে চাও।
তখন নারদের কথা শুনে তিনি তার পরিবারের সদস্যদের এই প্রশ্ন করলে সকলেই জানান যে তার পাপের ভাগী তারা হতে চান না । মর্মাহত হয়ে দস্যু জীবনের পরম সত্য উপলব্ধি ক’রে। তিনি নারদের নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করেন । নারদ তাকে রাম নাম জপ করতে শেখান । দস্যু সাধনায় বসেন এবং ছয় হাজার বছর সাধনা ক’রে। যেহেতু তিনি মরা ছাড়া কিছুই উচ্চারণ করতে পারতেন না,তাই নারদ তাকে মরা বলতে বলেন।সেই মরাই ক্রমশ রাম হয়ে ওঠে।সাধনাকালে তার দেহ বল্মী মানে উইয়ের স্তুপে ঢেকে গিয়েছিল ব’লে তার নাম হয় বাল্মীকি ।
এত বিষয় বুঝতে পারিনি। শুধু মনে হতো এই মাসি কেবল রামের ভরসা করেছিল বলেই এর এত দুঃখ।
তবু মাসির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম।তার একটা কারন ছিল,খালি মনে হত, এ মাসির মেয়ের কী মজা!সারাদিন সে এভাবেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যায়।পড়াশোনা করতে হয় না।স্কুলে যেতে হয় না।কোনো তাড়া নেই বাড়ি ফেরার।আর আমাকে সন্ধে নামলেই বাড়ি ফিরে পড়তে বসতে হয়।পরীক্ষা দিতে হয়।বিরক্তিকর!
সে সময় গো এ্যাজ ইউ লাইক মানে যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগিতায়
আমি প্রতিবারই তাই বাসনওয়ালি সাজতাম।কাঁধে বাবার লুঙ্গি অথবা মায়ের শায়া দিয়ে বানানো ঝোলা,পরনে সেপটিপিন দিয়ে আটকানো মায়ের ব্লাউজ,মা কিংবা কাকিমার সিন্থেটিক শাড়ি,পায়ে হাওয়াই চপ্পল আর মাথায় সবজির ঝুড়িতে থালা,বাসন, গ্লাস…
একসময় প্রতিযোগিতা শেষ হয়ে যেত,তবু আমি ঘুরে ঘুরে সেই অদ্ভুত সুরে বলে যেতাম-বাসন লেবে…এ…বাসন…যতক্ষণ না উদ্যোক্তাদের কেউ এসে বলত,এবার অন্য প্রতিযোগীতা শুরু হবে।তুই বাড়ি যা।রেজাল্ট পরে জানানো হবে।
আমি তখন বিষন্ন মুখ নিয়ে বাড়ির পথ ধরতাম,তবুও ক্লান্ত স্বরে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে বলে যেতাম বাসন লেবে গো বাসন..