সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে বিতস্তা ঘোষাল (পর্ব – ২)
কু ঝিক ঝিক দিন
২.
তখনো সাদা অ্যামবাসাডরে করে রামপুরহাট যাওয়া শুরু হয়নি আমাদের। বিশ্বভারতী অথবা হাওড়া রামপুরহাট এক্সপ্রেস কিংবা শিয়ালদা রামপুরহাট লোকালে করেই আমাদের মামার বাড়ি যাওয়া।এই যাওয়ার দীর্ঘ পথে কয়লার ইঞ্জিনের কু ঝিক ঝিক শব্দর পাশাপাশি অনিবার্য ভাবে কয়লার কুচি ঢুকে জ্বালা করা লাল চোখ ফাও ছিল।পুচকা খাবার শেষে যেমন একটা ফাও পুচকা না পেলে মন ভরে না,ঠিক তেমনি দুধারের বদলে যাওয়া দৃশ্যাবলীর পাশাপাশি ওই কয়লার কুচি ছিল ফাও।
ট্রেন যাত্রার আরেকটা আকর্ষণ ছিল ঝালমুড়ি। নারকেলের এক পাতলা টুকরো করে কাটা ফালি,আর মশলা দিয়ে মাখানো মুড়ি..আহাঃ সে যেন ফাইভস্টার হোটেলের খাবারকেও হার মানায়।মুড়ি শেষ হতে না হতেই ঘুগনি।একটা শালপাতার বাটিতে এত্তো খানি মটর সেদ্ধ, তার উপর নুন,কাঁচা পেঁয়াজ,লেবু, কুঁচনো কাঁচালঙ্কা আর ধনেপাতা…মায়ের হাতের রান্না করা ঘুগনি যা পাড়ার সবাই চেটেপুটে খেত,তার তুলনায় ঢের ভালো।এছাড়াও বুড়ির চুল সাদা, গোলাপি, ছোলামাখা এমনকি শসা বিটনুন,লঙ্কাগুড়ো দিয়ে.. এ-সব যেন বিয়েবাড়ির ভুড়িভোজের থেকেও বেশি অমৃত।তা বিয়েবাড়িতে হতটাই বা কী!সকাল সকাল লুচি অথবা মুড়ি,তার সঙ্গে হলুদ না দেওয়া বাটি চচ্চড়ি,আর বোঁদে।আর বোঁদে বলতেই সেই পুরোনো ছড়া…যদি খেতে চাও বোঁদে চলে যাও ছাগলের পোঁদে…।এ ছড়া শোনার পর থেকে বোঁদে খাবার আর এতটুকু শখ ছিল না।দুপুর হতেই ভাত,মুসুরডাল, বেগুনী,ঝোল ঝোল আলুপোস্ত,মাছ আর দই।হ্যাঁ, রাতের মেনুতে বৈচিত্র্য থাকত বইকি!সাদা ভাত তখন হয়ে যেত প্রচুর মিষ্টি দেওয়া পোলাও,না পল মানে মাংস দেওয়া অন্ন নয়,প্লেন কিসমিস,কাজু দেওয়া পোলাও,মুগের ডাল মাছের মাথা দিয়ে,তার সঙ্গে মাছ,আর অতি অবশ্যই পাঠার মাংস।সে মাংস বাড়িতেই একটা পর্দা টানিয়ে কাটা হত।সেই দৃশ্য দেখার পর আর খাওয়ার ইচ্ছে থাকত না।তবু বাড়ির বড়োদের বকুনির ভয়ে মুখে তুলতেই হত।আর শেষ পাতে দই,মিষ্টি, পান।তখনো আইসক্রিমের চল হয়নি।
তা এসব জিনিসের তুলনায় ট্রেনের খাবার যথেষ্ট ভালো এবং মজার।একবার আমার পাশে বসে যাওয়া এক মামা বলেছিল,ভাগনী এসব খাবার কেন ভালো লাগে বলোতো!এতে নাকের জল,কলের জল, চোখের জল এমনকি…আমি আর শুনতে চাইনি।বমি এসে গেছিল।অবশ্য তাতে খাবার খাওয়ার কোনো বিরতি ঘটেনি।কি মেশাচ্ছে আমি তো দেখতে পাচ্ছি না।
তবে এই যে রামপুরহাট গামী ট্রেনে বসা মাত্র মামারবাড়ি যাচ্ছি শুনেই সব মামা আর মাসি হয়ে যেত,এই বিষয়টা খুব মজার লাগত।
আমার যে এত মামা মামী মাসি আছে কেমন হঠাৎ করে জেনে যেতাম।অনেক সময়ই তারাই আমার দেখভাল ও খাওয়ার তদারকি করত।মা নিশ্চিন্তে জানলার দিকে মুখ করে বাকি দুই বাচ্চাকে সামলাতে ব্যস্ত থাকত।
অবশ্য এই মামার বাড়িতে যাওয়ার সবচেয়ে বেশি সুযোগ আমিই পেতাম।একান্নবর্তী পরিবারের বড় বউ আমার মা চার দেওর,বাবার বন্ধু, তারাও দেওর,আর একচিলতে ঘরে আমাদের তিনবোনকে সামলাতে সামলাতে নাজেহাল হয়ে যেত।তখন কোনো মামা যদি এসে যেত,তবে তারসঙ্গে আমার মামার বাড়ি যাওয়া আটকায় কে!অবশ্য ঠাকুরমার বাড়িও এভাবেই আমি ঘন ঘন যেতাম।
যাহোক,এসব ছাড়াও আরও কিছু কারন ছিল এই ট্রেন যাত্রার।বোলপুর ঢোকার আগে থেকেই ট্রেনে উঠত বাউল।তারা হাতে একতারা , পায়ে ঘুঙুর,নিয়ে গান জুড়ত।তোমায় হৃৎ মাঝারে রাখব…, কিংবা এমন মানব জমিন রইল পড়ে আবাদ করলে ফলতো সোনা,অথবা খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়.. আবার সাধের লাউ বানাইলে মোরে বৈরাগী.. এসব শুনে আমিও তাদের পিছন পিছন নাচতে নাচতে এক বগি থেকে আরেক বগি ঘুরতাম,যতক্ষণ না তারা নামার আগে আমাকে নিজের বগিতে সিটে ফিরিয়ে দিয়ে যেত।তখন আমি কাঁদতে বসতাম।আহা!কী ভালো হতো আমি যদি বাউল হতা! পড়াশোনা করতে হতো না।কেমন গান গেয়ে গেয়ে ঘুরে বেড়াতাম বিশ্ব সংসার। বলতাম-
মন আমার গেল জানা।
কারো রবে না এ ধন জীবন যৌবন
তবেরে কেন এত বাসনা;
একবার সবুরের দেশে বয় দেখি দম কষে
উঠিস নারে ভেসে পেয়ে যন্ত্রণা।।
না,আমার বাউল হওয়া হল না।আমার মানব জনম বৃথা গেল।ফলল না সোনা।