• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে তৃষ্ণা বসাক (পর্ব – ৩)

শূন্যকাননের ফুল

৩| কে ফুল ফোটাচ্ছে? কে?

ঘরটা খুব বড় নয়। কিন্তু বড় দেখায়। কারণ কোন আসবাব নেই বললেই চলে। এটা সি.এইচ.র কমিটি রুম। কিন্তু কমিটি রুম বলতে যে ছবি ভেসে ওঠে, গোল বা ওভাল টেবিল, দেওয়াল জোড়া ক্যাবিনেটে সারি সারি ফাইল, একপাশে টেবিলে কম্পিউটার, প্রিন্টার, স্ক্যানার নিয়ে সুন্দরী সেক্রেটারি- সেসব কিছুই এখানে নেই। বদলে দেওয়াল জোড়া স্ক্রিন, যেটা আসলে মেন সার্ভার। সেই সার্ভারের সামনে তিনটে নোডে তিনজন বসে আছে। চেহারায় স্পষ্ট টেনশন। কারণ সার্ভারে ভেসে উঠেছে চিফের আইকন। চিফ এই তিনজনের সঙ্গে গ্রুপ টেক্সটিং করবেন। এভাবেই আর্থেনিয়ার প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়। যে তিনজন বসে আছে, তারা আর্থেনিয়ার পাঁচটি সবচেয়ে হেভি ওয়েট দপ্তরের প্রধান।
-রিও রাবাইতো, এঁরা চার প্রজন্ম আগে পৃথিবী থেকে এসেছেন, দেখেন বহির্গ্রহপুঞ্জ ও প্রতিরক্ষা।
-মধু ম্যানহাটান, সাইবর্গ, দেখেন দুটি দপ্তর- নেটওয়ার্কিং ও জেন্ডার।
-পদ্মাসনা আয়েঙ্গার, হিউম্যানয়েড। ইনি মাত্র এক প্রজন্ম আগে পৃথিবী থেকে এসেছেন, দেখেন পুলিশ ও প্রশাসন।
চিফের কাছে এবং সাধারণ মানুষের কাছেও এঁদের পরিচয়, নোড ওয়ান , নোড টু, নোড থ্রি। খুব কম লোকই এঁদের নাম জানে বা চেহারার সঙ্গে পরিচিত।

সেন্ট্রাল হাব বা সি.এইচ.র যাবতীয় জনসংযোগ করে থাকেন মিকি টকিহাউস নামে একজন মহিলা। ইনি একজন হিউম্যানয়েড। আর্থেনিয়ায় নয়, এঁকে পৃথিবীর একটি সংস্থা বানিয়ে অনেক টাকায় আর্থেনিয়ার কাছে বিক্রি করেছে। এঁর কেনাবেচায় নাকি ব্যপক দুর্নীতি হয়েছে বলে বিরোধীরা প্রায়ই হইচই করে থাকে। বিষয়টি মিকি কেলেংকারি বা মিকিংকারি নামে বিখ্যাত। তাতে অবশ্য মিকির কোন হেলদোল নেই। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে তিনি অক্লান্তভাবে স্পেস মিট থেকে চ্যানেল ডিসকাশন, পথসভা থেকে হাই -ফাই সেমিনার- ঝোলে ঝালে অম্বলে অকাতরে কথার ফুলঝুরি ফুটিয়ে চলেন। তাঁর দায়িত্ব ইমেজ বিল্ডিং এর, কিন্তু নিন্দুকেরা বলে মিকি যতই কথা বলেন, সি.এইচ.র ইমেজ ততই ধসে যায়। কেউ কেউ বলে মিকিকে দেখলেই নাকি তাদের গায়ে চাকা চাকা অ্যালার্জি বেরিয়ে যায়। মিকির কানে সেসব যায় বলে মনে হয় না। তিনি অনর্গল কথা বলে যান, তাই তার ল্যাব-দত্ত নামের সঙ্গে এই টকিহাউস পদবী জুড়ে গেছে। এমনিতে এদের কোন পদবী হয় না, একটা কোড নাম্বার থাকে শুধু।
আর চিফের নাম ধাম কেউই জানে না। এমনকি নোড ওয়ান, নোড টু, নোড থ্রি কেউই না। সারাদিন চ্যানেলে চ্যানেলে মিকির গুণ কীর্তন করে বেড়ানো মিকিও না। চিফের গলার আওয়াজও কেউ কখনো শোনেনি। সম্ভবত গলার স্বর কাউকে জানতে দিতে চায়না বলেই, সমস্ত মিটিং হয় নেট টেক্সটিং করে, যেখানে প্রত্যেককে লিখে লিখে নিজের মতামত পেশ করতে হয়। মতামত শব্দটা অবশ্য একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। কারণ কে না জানে, আর্থেনিয়ার সেন্ট্রাল হাবে কারো কোন নিজস্ব মতামত দেবার স্বাধীনতা তো দূরের কথা, মতামত দেবার ক্ষমতা পর্জন্ত নষ্ট হয়ে গেছে। কেউ কেউ এও বলে যে চিফ টিফ বলে আসলে কেউ নেই। অন্ধকার জালটা সরালে দেখা যাবে সব ফাঁকা, কেউ কোথাও নেই, বহু বছর ধরে, হয়তো আর্থেনিয়ার জন্মলগ্ন থেকেই একটা প্রোগ্রাম সেট করা আছে, এবং কী কী সিচুয়েশন আসতে পারে সেসব ইনপুট ফিড করাই আছে, সেই ভাবেই প্রোগ্রাম কাজ করে যাচ্ছে। তার মানে কিছুই বদলায়নি, চিফ একই আছে, নতুন মুখ, নতুন রক্ত টক্ত সব বাজে কথা, একটা প্রোগ্রামই কাজ করে যাচ্ছে, কাজ করেও যাবে বছরের পর বছর ধরে, হয়তো আর্থেনিয়া ধ্বংস হওয়া অব্দি।
বারবার আমি সমর্থন করলাম , আমি সমর্থন করলাম লিখতে লিখতে হাত ব্যথা করছিল রিও রামাইতোর। তিনি একবার আড়চোখে মধু ম্যানহাটান আর পদ্মাসনা আয়েঙ্গারের দিকে তাকালেন। পদ্মাসনা খাঁটি যন্ত্রমানব, কিন্তু মধু, ও তো মানুষই , শরীরে যতই একগাদা চিপস বসানো থাক, রক্ত তো মানুষেরই, চিফের এই নির্দেশগুলোয় ঘাড় গুঁজে ডিটো দিতে দিতে ওর সেই রক্ত গরম হয়ে উঠছে না? আর বিষয়টি তো এলেবেলে নয়। আর্থেনিয়ার রাজধানী, খাস ওলালা শহরের বুকে একটি মেয়ের ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড। যেখানে অষ্টপ্রহর নজরদারি ক্যামেরা থাকার কথা। ফুটেজ চাইলে বলা হয়েছে, ওইসময় নাকি ক্যামেরাটি মেরামতি চলছিল, কোন ছবিই তোলা হয়নি।
চিফের আইকন ফুটে উঠলে তিনজন নড়েচড়ে বসল। তিনজন মানে রিও রাবাইতো, মধু ম্যানহাটান আর পদ্মাসনা আয়েঙ্গার।
পর্দায় ফুটে উঠল
-শুভ দিন
ওমনি তিনজন মরি বাঁচি করে লিখল
-শুভ দিন চিফ
-শুভ দিন চিফ
-শুভ দিন চিফ
তখন আবার চিফের ডায়লগ বক্সে লেখা ফুটল
-কীসের শুভ দিন? একটা মেয়ে এভাবে শহরের খাস জায়গায় এভাবে ধর্ষিতা হল, আর আপনারা বলছেন শুভ দিন? অপদার্থের দল সব! খুব অশুভ দিন, আর্থেনিয়ার ইতিহাসে এটা একটা কালো দিন।
বিমূঢ ভাবে তিনজনে লেখে, কিছুটা শ্লথ ভঙ্গি এবার
-অশুভ দিন চিফ। আর্থেনিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে কালো দিন।
এটা লেখার সময় তিনজনের মনেই উঁকি মেরে গেল, শহরের কেন্দ্রে আগে না হলেও, রেপ অনেকদিন ধরেই আর্থেনিয়ায় জলভাত। তার জন্যেই ট্রাফিক মোড়ে মোড়ে এত প্রচার, স্কাই গ্রাফিতি বোর্ডে এত প্রোপাগান্ডা, তারপর ওই নিউট্রালাব্রিয়াম, সোনার পাথরবাটির মতো ব্যাপার। নিউট্রালাব্রিয়াম ঘিরে মানুষের মনে যে পরিমাণ ক্ষোভ জমা হয়েছে তা বিলক্ষণ জানেন এই তিনজন। কিন্তু চিফকে সেসব বলা যাবে না। বললে শুধু চাকরি চলে যাবে তাই নয়, আর্থেনিয়া থেকে ভিটেছাড়া হতে হবে।
মধু আর রিও পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে, পদ্মাসনা এদের তিনজনের মধ্যে অনেকটা সুস্থির, হয়তো আয়েঙ্গার পদবীর সঙ্গে সঙ্গে তামিল স্থৈর্জও বহন করছে শরীরে, সে দেখা গেল একমনে চিফের পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষা করছে। তাছাড়া পুলিশ প্রশাসন দেখে বলে এই ঘটনায় তার দায়িত্ব আর টেনশন দুটোই বাকি দুজনের থেকে বেশি।
চিফ এবার যা লিখলেন তাতে সবারি পিলে চমকে গেল (যদিও পিলে নেই, তবু ওই আর কি!)।
এ কি লিখেছেন চিফ? ধাঁধা না হেঁয়ালি?

‘যে জন শূন্যে ফোটায় ফুল,
তাকে চিনতে কোর না ভুল
দোষী সে-ই জন
শীঘ্র করো অন্বেষণ।’
ভালো করে পড়ার আগেই চুঁ চুঁ চুঁক করে শব্দ হল, পরদা অন্ধকার। বোঝা গেল চিফ বিদায় নিয়েছেন, আজকের মতো কনফারেন্সিং শেষ। ঢক ঢক করে জল খেলেন মধু। রিও বললেন ‘আমি জাস্ট ভাবতে পারছি না আমাদের চিফ একজন কবি’
‘আরে ইতিহাস পড়ে দেখ, সব দেশের সব কালের অটোক্র্যাটরাই কবি।
ওমনি তর্ক জমে উঠল মধু আর রিওর। শুধু পদ্মাসনা কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন ‘ আর্থেনিয়ায় ফুল ফোটাচ্ছে! কে?’

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *