• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবহ শ্রী সুতনু হালদার বিরচিত (পর্ব – ৫)

আলাপন

(আত্মজৈবনিক কাব্যোপাখ্যান)

(২১)
ঘরের উত্তরদিকের জানলা দিয়ে একফালি সাদা মেঘ আমার সঙ্গে প্রতিদিন দেখা করতে আসে। নিয়ম করে দিনে তিনবার।
ভোরবেলা কিশোরী মেঘের আলতো স্পর্শে ঘুম ভাঙিয়ে সে আমাকে মুগ্ধ করে তোলে।
দুপুরে যখন দ্যাখা হয় তখন সে ভরপুর যুবতি, আমরা সেইসময় সাক্ষাৎ প্রেমিক-প্রেমিকা; কপালের হালকা টিপ সূর্যের সমস্ত দস্যিপনাকে চুপ করিয়ে দিয়ে কেমন করে যে নিজের কপালে এঁকে রাখে, সেই বিস্ময় আমার আজীবনের!
আমাদের সান্ধ্যকালীন দ্যাখাটা চর্যাগীতির রহস্যে মোড়া। নিগূঢ় তন্ত্রে আমরা দুজনকে আগামীর সাধন পথ বোঝাতে বোঝাতেই রাত নামত। দুজনের পথ তখন থেকেই ভিন্নতাকে আশ্রয় করে ভাসতে ভাসতে অনাগামীর এক আকাশকে খুঁজতে চলতাম…
গভীর রাতে আকাশের বুকে মেঘেরা ক্রমশই নতুন ভাষায় অনুদিত হয়।
(২২)
এবার কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানো দরকার।
সূর্যের মতো না হলেও ঘোরাটা অন্তত পৃথিবীর মতোই হোক,
সমস্ত ইভ বা আদমটিজিংয়ের শেষপ্রান্তে একটা দাগ থাকে, দেওয়ালের এপার থেকে ওপার অনায়াসে যাতাযাত করতে করতে জোনাকিরা সেসব জেনে যায়…
বর্ণান্ধ বর্ণালির ঘুমন্ত আলোতে লেগে থাকে একটাই পরিযায়ী সম্পর্ক
এইসব না বুঝেই তুমি প্রেমিকা হবে?
কত যুগ ধরে তো রাধিকাকে এইসবই বুঝতে হয়েছিল,
একটা একটা করে দরজা পেরতে পেরতে-
কাহিনী যেমনভাবে আরো গভীর হয়, তেমনই যুবতি হয়ে ওঠে যমুনার তীর।
পঙক্তির পর পঙক্তি সাজিয়ে উদ্বাহ নৃত্যে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন পাঠ করে আজকের যে খচ্চর যুবক, এরমধ্যেই সে জেনে ফেলেছে-
রাধিকারা আজীবন প্রেমিকাই থাকে…
(২৩)
তারথেকে একটু দূরে পিছিয়ে যেতেই ঘোর কুয়াশা!
প্লাটফর্ম প্রেমিকের সুতীব্র দৃষ্টিতে চাতক পাখি…
সামনে জগৎ জোড়া ছেঁড়া ক্যানভাস,
গভীর রাত! গভীরতাহীন চাঁদে আলুলায়িত আলো
আরো দু’এক পা পিছিয়ে আসতেই হ’ল;
এবার এগোনোর প্রস্তুতি…
কুয়াশার চাদরে আমার ছবির রং ছোঁয়া ক্যানভাস,
নিজের বিমূর্ত ছবিতে ফুটে ওঠে আয়নার আর্তনাদ!
প্রতিটা রঙের আত্মজীবনী-
অন্ধকার বল্কলে এক আধটা আলো ছড়িয়ে দ্যায়…
চৈত্রমাস শেষ হয়ে বৈশাখ মাসের টাটকা গন্ধে আমার অক্ষরগুলো বড় বেশি রবীন্দ্র প্রবণ হয়ে পড়ে। এই প্রবণতার চারপাশ হালকা আকাশ দিয়ে ঢাকা। ভোরের আজানের সুরে যে ক’দিন ঘুম ভেঙে যেত, হাতে তুলে নিতাম গীতবিতান। ক্ষুধার্ত একটা অনুভূতি কিছুক্ষণের জন্য সব পেয়েছির দেশে চলে গিয়ে মৃদঙ্গ বাজাত, আমার সকাল গড়াতে গড়াতে রাত হয়ে যেত।
অনুচ্চারিত একটা সুরের উথালপাতাল স্রোত কখনও কখনও আমাকে আস্তিকতার ঢেউয়ে নিমজ্জিত করে ফেলত, আমি যেন অবলীলায় শুনতে পেতাম, ‘কে গো অন্তরতর সে। আমার চেতনা আমার বেদনা তারি সুগভীর পরশে।’
(২৪)
অনেকটা সকাল হাতে পাওয়া গেলে রোদগুলো অক্ষরের ভূমিকা নেয়। গতরাতে ঘুম আসার আগে শুয়ে শুয়ে যেসব শব্দরা মনে এসেছিল তারা পাখির দ্রুততায় উড়ে যায়; পৃষ্ঠাজুড়ে শুধু অন্তত আকাশ…
একা কুম্ভ!
বাস্তুসাপ…
মেঘ হতে চেয়েছিলাম বলে আর কোনও আক্ষেপ করি না, কুয়াশার স্বাদ বস্তত নিষ্প্রাণ প্রেমিকার থেকে কোনও অংশে কম কিছু নয়। দুরন্ত মেঘের চপলতায় তোমার লেডি বাটন আরও জীবন্ত হয়ে ওঠে; সব জেনে বুঝেও মেঘ হতে পারিনি।
নদীর ছলনাকে সমুদ্র বেশিক্ষণ মনে রাখে না, নোনাজল নারীত্বকে প্রকৃতির পাঠ দ্যায়।
খড়কুটো থেকে দাবানল নিজস্ব মুদ্রায় ত্রিভঙ্গমুরারি;
সন্ধে থেকে রাত মানুষ ডাকটিকিট হয়ে পূর্ণিমার চাঁদ খোঁজে
(২৫)
ছোটোবেলায় মোমের আলোর নিচে বসে গরুর গাড়ির গাড়ি দেখতাম। বাড়ির সামনের রাস্তাটার নাম ছিল স্বর্গদ্বার, কিছুটা দূরেই ছিল শ্মশান। যেদিন মা মারা গেল, সেদিনও রাতের বেলা আমি মোমের আলোর আশ্রয় চেয়েছিলাম।
ঠিক পাশেই ছিল চাঁদুনি কালী মন্দির। কথিত আছে, আগে নাকি উনিই ছিলেন শ্মশানকালী, তারপর গঙ্গা অনেকটা পিছিয়ে গিয়েছে। গঙ্গার সঙ্গে সঙ্গেই চলে গিয়েছে শ্মশান আর কালী মন্দির। চাঁদুনি এখন পারিবারিক গৃহদেবতা।
আমার ঈশ্বর ভক্তি বিপদে না পড়লে জাগে না! কোনো মন্দির, মসজিদ, গীর্জাতে তাই যাতাযাত কম। কিন্তু শ্মশানে যেতাম, কত লোক থাকত ওখানে; সবাই পরিযায়ী। শুধু আমরা কয়েকজন ছিলাম স্থায়ী। তারপর একদিন বাবাও চলে গেল! সেদিন থেকে আর কোনও মোমের আলো-কে আমার আশ্রয় বলে মনে হয়নি। আর কখনো চাইনি।
চাওয়া-পাওয়ার হিসেবে বারবার ভুল করি। এইযুগটাতে যে এত পরিমাণে যুক্তাক্ষর লুকিয়ে রয়েছে সেটা কে-ই বা বুঝতে পেরেছিল? গোলাপের থেকে ভাঁটফুলকেই চিরকাল বেশি ভালোবেসে গেলাম, তারজন্য কোনো আপশোষ নেই; নীল বসন্তে নীলকণ্ঠের উপাসক যারা আমি আর সেই গোত্রীয় হতেই বা পারলাম কবে?
পারিনি বলেই হয়ত মোমের আলোর নিচে শুয়ে গরুর গাড়ি দেখার সেই দিনগুলো আজও আমাকে নদীর ঢেউয়ের মতো ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াতে গিয়ে আস্ত একটা বিকেলকে অনুবাদ করে দ্যায়…
(২৬)
যখন চৈতন্য আর বোধের বিরোধ ঘটে তখন আমি রক্তাল্পতায় ভুগি; নদীর কাছে যাই, গাছের নিচে বসি। জলের জন্য কাতরানো একটা তৃষ্ণার্ত চাতক অনুভূতি আমার রক্তকোষগুলো চিবতে চিবতে মজ্জায় কামড় দ্যায়! যন্ত্রণার সৌষ্ঠবে পাখিরা ডানা মেলে…
অনেকদিন আগে সুবর্ণরেখার পাড়ে একটি মেয়ে আমাকে মহুয়ার রস খাইয়েছিল। সেই প্রথম। শেষও। আকাশের তারাদের সাক্ষী রেখে আমরা ওই রস দু’জনে ভাগ করে খেয়েছিলাম। সেদিন থেকে আর কখনও মাতাল হইনি। সেই মেয়েটির সঙ্গেই নতুন করে আজ আবার যোগাযোগ হয়ে গেল! আকাশ তখন মেঘলা, তারারাও বেপাত্তা! ঠিক তখনই আমার মধ্যে পুরো সুবর্ণরেখা নদী ঢুকে পড়ল!
আকাশ ভেঙে বৃষ্টি এসেছিল, স্ট্রিটলাইটের জং পড়া আলোর আনুগত্য তখন নীরবতা বোঝেনি! ওদের মজ্জায় লুকিয়ে থাকতে থাকতে নিরুদ্দেশে চলে গিয়েছিল আজানুলম্বিত মেঘরাশি। আমার মধ্যেও নদীভাব জেগে উঠল। তৃষ্ণা দূর হলে বুঝতাম মেঘেরা বরাবরই বাউণ্ডুলে স্বভাবের হয়। ওরা তাই রক্তাল্পতায় ভোগে না।
শ্যামাপোকাগুলো মিথ্যে প্রতিশ্রুতির শিমুলগাছের নিচে পাখিরডাক শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে। নিছক দুধেভাতে হয়ে পড়ে থাকা স্বপ্নগুলো বাস্তুসাপকে ঘরকুনো ভেবে আনন্দ পেলে বাতাসে মর্মরিত হয়, ‘আমার বেলা যে যায় সাঁঝবেলাতে…’
(২৭)
এরপর একটু একটু করে নিজের পাঁজরের হাড় ছাড়াচ্ছি দেখে কেউ হাতে মুখ ঢাকল, কেউ বা ঠোঁট কিংবা নাক; চোখ ঢাকতে সবাই ভুলে গেল!
বুকের ভেতর পুরো ফাঁকা করে একটা আস্ত আকাশ ঢুকিয়ে রাখলাম! আকাশের বাক স্বাধীনতা বৃষ্টিকে জন্ম দিল; ওরা গণতান্ত্রিক হয়ে উঠলে আমরা উদাস উদাস ন্যাকামোতে মাতলাম।
অতএব আমরা রাজনীতি ভুলে জ্যোৎস্নায় হাড় জোড়া লাগা পাতা বুকে বাঁধব বলে নিজেরা অমাবস্যা হতেও দ্বিধা করলাম না!
এইভাবেই প্রতিটা দিন আজকাল চলে যাচ্ছে! দুপুরে একটু রোদ গায়ে মাখতে মাখতেই মন চঞ্চল হতে উঠছে। তার থেকে মুক্তির উপায় জানি না। সূর্যের সমস্ত তেজে পুরো গ্রীষ্মকালটাকে চুবিয়ে রাখতে ভয় হয়। প্রতি সোমবার এখানে শিবের পুজো হয়। সামনেই জলেশ্বর মন্দির। মন্দির সংলগ্ন মাঠে চড়ক হত, ছোটোবেলায় নেশার মতো একটা টানে চড়ক দেখতে যেতাম। ওইসময় যারা গাঁজা খেত তাদের শরীর শিশিরে ভেজা থাকত। চোখে আঁকা থাকত জ্যোৎস্না। সন্ন্যাসীদের দেখতাম। ওদের মানত ছিল।
শুধু শিব কেন? কোনো ধর্ম বা তাদের আরাধ্য কোনো কিছুই আমাকে কখনও টানেনি। আজও টানে না। কিন্তু পাঁজরের হাড়ে গাজনের সন্ন্যাসীদের যে বিশ্বাস ঢালা থাকত সেই বিশ্বাস ওদের বুকের কতদূর অবধি প্রবেশাধিকার পেত সেটা তখন বুঝিনি, কিন্তু আজ বুঝি।
গভীর অরণ্যে নিমগ্ন পথিকের অনেক অধিকারই বুকের মধ্যে আস্ত মেঘ হয়ে জমা থাকে, হৃদপ্রকোষ্ঠকে নিরালায় হয়ত কয়েকটা হুজগে জীবাশ্ম মাতিয়ে রাখতেও ভালোবাসে। আর ঠিক তখনই আকুতিভরা কণ্ঠে মন, মনে করিয়ে দ্যায় অমোঘ এক রাবীন্দ্রিক উচ্চারণ, ‘যে-কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে/ তোমার আনন্দ রবে তার মাঝখানে…’

(চলবে)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।