• Uncategorized
  • 0

কন্ঠস্বর চয়ন মুখার্জি (পর্ব – ৫)

।। পর্ব পাঁচ ।।

রক্তবীজ, শবরীমালা এবং …….

(১)
দেবীপক্ষের দ্বাদশী। সমস্ত চরাচর ভেসে যাচ্ছিল জ্যোৎস্নায়।
দুই দিন আগে মহামায়া উমা তাঁর পরিবারবর্গ সমেত ফিরে গ্যাছেন কৈলাসে। জনাকীর্ণ দিকশূন্যপুরের প্রান্তর আজ তাই মৌন, নিস্তব্ধ।
বালক নিজের গৃহে নিদ্রাচ্ছন্ন। পাশে পড়ে থাকা বইগুলির পাতা প্রবল হাওয়ার দাপটে আপনা থেকেই উল্টে যাচ্ছিল। আর নিদ্রামগ্ন বালকের অবচেতনে জারিত হচ্ছিলো স্মৃতি। আজকের নয়, বহু বহু যুগ আগের, জন্ম জন্মান্তরের স্মৃতি। বালকের মস্তিষ্কের কোষে কোষে ঝঙ্কার তুলছিল অনেক অনেক কাল আগের এক লুঠেরার শ্রুতপূর্ব কর্কশ চিৎকার-
“তুমি জানো না, আমি কী করতে পারি?”
সোমনাথ মন্দিরের নতমস্তক পূজারির সামনে দাঁড়িয়ে অট্টহাসি হাসছিলেন সুলতান মামুদ।
সন ১০২৫ খ্রিস্টাব্দ। অক্টোবর মাসের ২৫ তারিখ। স্থাণ বর্তমান গুজরাটের পাটন।
পৌত্তলিক হিন্দুদের সমস্ত প্রতিরোধ চূর্ণ হয়েছে। মামুদের ৮৪ হাজার প্রশিক্ষিত সৈন্য এবং ১০ হাজার ধর্মোন্মত্ত গাজীর সামনে সমস্ত হিন্দু প্রতিরোধ খড়কুটোর মতো উবে গ্যাছে। পরাস্ত হয়েছেন লোদররাজ অমরসিংহ, পাটনপতি ভীমদেব।
মূর্খ পৌত্তলিক হিন্দুরা মনে করেছিল, স্বয়ং সোমনাথস্বামী নিজে আবির্ভূত হয়ে মামুদকে সসৈন্যে বধ করে তাঁর অহংকার গুঁড়িয়ে দিয়ে তাঁকে সমুচিত শাস্তি দেবেন। কিন্তু বৃথা আশা। পাটনের সমস্ত দেবালয় পুড়িয়ে অবশেষে মামুদ এসে পৌঁছলেন সোমনাথ মন্দিরের সামনে। তার সামনে তখন ২০ হাজার স্বাভিমানী রাজপুত ও অগুনতি হিন্দু ভক্তের যৌথ বাহিনী।
মন্দিরের পুরোহিত করুণ আবেদন রাখলেন মামুদের কাছে। মন্দিরের সমস্ত ধনরত্ন স্বেচ্ছায় তাঁরা তুলে দেবেন মামুদের হাতে। তাই নিয়ে তৃপ্ত হোন মামুদ।রেহাই দিন মন্দির ও জ্যোতির্লিঙ্গকে। এর সাথে কোটি কোটি ভক্তের বিশ্বাস জড়িয়ে, তাঁকে এইভাবে চূর্ণ করতে, আঘাত দিতে মামুদ পারেন না, মানবতার খাতিরেই পারেন না।
তখনই ক্রুর হাসি হেসেছিলেন মামুদ। “তুমি জানো না, আমি কী করতে পারি?”
“ভেঙে ফ্যালো কাফেরদের এই উপাসনাস্থল। জ্যোতির্লিঙ্গকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেখিয়ে দাও এই অবিশ্বাসীদের যে ওদের আরাধ্য বিগ্রহে প্রাণ নেই, আছে কেবল খড় কুটো ,পাথর।”
যুদ্ধ বাঁধলো। রাজপুত বীরদের তরবারি প্রখর সূর্যের সূর্যালোকে বিদ্যুতের মতো ঝলসে উঠলো। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করতে করতে তারা রণভুমিকে পরিণত করলো তাদের গৌরবময় চিরশয্যাভূমিতে। অনেক পরে ঐতিহাসিক আল কাজ উইনি লিখেছিলেন, রোরুদ্যমান যোদ্ধারা মন্দিরের ভিতরে গিয়ে দেবাদিদেবের কাছে সাহায্য ভিক্ষা করতো এবং তারপরেই বেরিয়ে এসে যুদ্ধ করতে করতেই মারা যেত। কার্তিক মাসে আগুনের আকর্ষণে যেভাবে তার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে কীট পতঙ্গ, ঠিক তেমনই।
৫০ হাজার হিন্দুর মৃতদেহ ডিঙিয়ে মাহমুদ গজনী যখন মূল মন্দিরে পা রাখলেন, তখন খাঁ খাঁ করছে জাগ্রত দেবালয়।
জ্যোতির্লিঙ্গটিকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেওয়া হলো। মন্দিরে স্তূপীকৃত সোনা রূপোর সবটাই হস্তগত হলো সুলতানের। তারপরে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো গোটা মন্দির। আগুনের লেলিহান শিখা পুরোপুরি গ্রাস করলো সোমনাথ স্বামীকে এবং সেইসঙ্গে কোটি কোটি ভক্তের বিশ্বাসকে। ধ্বংস হলো সোমনাথ। খড়কুটোর বিগ্রহে প্রাণ নেই, দেবতা নেই, মামুদ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন পৌত্তলিক হিন্দুদের।
নিজের বিছানায় ধড়মড় করে জেগে উঠলো বালক। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গ্যাছে। বিগত জন্মের স্মৃতি তার পিছু ছাড়েনি, অবচেতনায় বারবার ফিরে আসে। এর হাত থেকে তার মুক্তি নেই, নিস্তার নেই। পালানোর উপায় নেই।
(২)
দিনে দিনে বালক বড়ো হয়। কৈশোরে পদার্পণ করে।
আজও তার স্বপ্নে হানা দেয় পূর্বজন্মের ঘটনাবলী, মস্তিষ্কের প্রতি কোষে তান্ডব করে বেড়ায়। বালক ভুলতে পারেনা সেই নিষ্ঠুর হাসি। মামুদের নয়, আরেক জনের, আরেক জন্মে, আরেক স্থাণে।
” তুমি জানো না আমি কী করতে পারি?”
নালন্দার সামনে দাঁড়িয়ে ক্রুর হাসি হাসছিলেন ইখতিয়ারুদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি। তাঁর সামনে নতমস্তকে দাঁড়িয়েছিলেন নালন্দায় বৌদ্ধ ভিক্ষু।
“বলো কাফের, এই দূর্গে কি পবিত্র কিতাব আছে?’ গর্জে উঠলেন বখতিয়ার। ঠোঁটের কোণে নিষ্ঠুর হাসি। উত্তর তাঁর আগেই জানা।
“না”- মাথা নাড়ালেন ভিক্ষু। আর সঙ্গে সঙ্গেই বখতিয়ারের তরবারির এক কোপে তারধড় আর মুন্ড বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল ।
“জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও অবিশ্বাসীর আবাসস্থল।”
নালন্দা পুড়তে লাগলো।খড়, পুঁথির শুকনো তালপাতা অগ্নিতে ইন্ধন জুগিয়ে অমানিশা মুছে চড়চড় করে ফাটতে লাগলো।জ্বলতে লাগলো বাঙালির দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য। একদিন দুদিন নয়, তিনমাস ধরে।
কিশোর কাঁদছিলো। পূর্বজন্মের স্মৃতি আর কতদিন তাকে এইভাবে ধাওয়া করে বেড়াবে?!
(৩)
“তুমি জানো না আমি কী করতে পারি?”
সন ২০১৮। ২১ শে অক্টোবর । আজও দেবীপক্ষের দ্বাদশী।
বালক আজ যুবক। তার শরীরে মত্ত হাতির বল। আজও সে দুঃস্বপ্ন দেখে। একইরকম স্বপ্ন, শুধু মুখগুলো পাল্টে যায়।
সে দ্যাখে, মামুদ বখতিয়ার আজও হেসে চলেছে। কিন্তু তাদের মুখ পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। তাদের জায়গায় আসীন এক নারী, সুন্দরী লাস্যময়ী নারী। সে হাসতে হাসতে বলছে,
“ধ্বংস করে দেবো তোমাদের যত সংস্কার। মন্দিরে ঢুকে বিগ্রহের সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হবো আমি। দেবালয়ে স্থাপণ করবো কন্ডোমের মেশিন, প্রতিষ্ঠা করবো অজাচারস্থল। আইয়াপ্পার কল্পিত পবিত্রতা, ব্রহ্মচর্য তছনছ করে দেখিয়ে দেবো বিগ্রহের মধ্যে প্রাণ নেই, দেবতা নেই, আছে খড় কুটো পুতুল।”
“তুমি জানো না আমি কী করতে পারি ?”-
থমকে গেলো নারী। একথা তো সে বলেনি। তবে কে ? কে বললো এই কথা?
যুবক। জন্ম জন্মান্তরের স্মৃতি বয়ে বেড়ানো যুবক। আজ , এতযুগ পরে, এতকাল পরে সেও হাসছিলো।
“খবরদার”- গর্জে উঠলো লাস্যময়ী। ” তুমি সভ্য, শিক্ষিত যুবক। তুমি গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক। আদালত, প্রশাসনকে তুমি অবজ্ঞা করতে পারো না।”
“কে সভ্য, কে শিক্ষিত”- আবার হাসতে লাগলো যুবক। ” ভালোভাবে চেয়ে দ্যাখো তো!’
সবিস্ময়ে দেখতে লাগলো নারী। তাঁর সামনে বসে থাকা অবয়বটি যুবকের, কিন্তু মুখ অবিকল মামুদের মতো, হাত অস্বাভাবিক লম্বা, হাঁটু অব্দি বিস্তার করা যায় এমনই তার দৈর্ঘ্য।আজানুবিলম্বিত। অবিকল বখতিয়ারের মতো ।
“তুমি পারো না। এ হতে পারে না। অসম্ভব।”- বিড়বিড় করতে লাগলো নারী।
“পারি। বিলক্ষণ পারি। তুমি , তুমিই তো আমাকে শিখিয়েছো পারতে। প্রতিবার আমি তোমার কাছে ছুটে গেছি সাম্যের আশায়, সুবিচারের আশায়। মিনতি করেছি, আমার উপাস্যকে হাস্যস্পদ কোরো না।আর প্রতিবার তুমি আমাকে তাচ্ছিল্য করেছো, ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করেছো আমার উপাস্যকে নিয়ে।পরাজিত জাতি বলে খিল্লি করেছো আমাকে নিয়ে। তোমার বর্শার খোঁচায় আমার শরীরে রক্তপাত ঘটেছে বারবার। কিন্তু একটি জিনিস তুমি টের পাওনি। “
“কী? কী টের পাইনি আমি?”- বললো নারী। সে ভীত সন্ত্রস্ত।
“যতবার আমার শরীর থেকে রক্ত ঝরেছে, ততবারই সেই রক্ত মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে জন্ম দিয়েছে অজস্র রক্তবীজের। জন্ম নিয়েছে মামুদ, বখতিয়ার। তুমিই তাদের জন্মদাত্রী। তোমার থেকে পুষ্টি গ্রহণ করেই তারা বেড়ে উঠেছে। তোমারই ব্যঙ্গ থেকে প্রোটিন আহরণ করে আমার মাংসপেশী সুপুষ্ট হয়েছে। আজ নিজেরই তৈরি ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকে দেখে তুমি আজ ভীত কেন? এতো তোমার প্রাপ্য। “
“পূর্বপুরুষের উন্নত সংস্কৃতি স্মরণ করে দ্যাখো। এ তোমার ঐতিহ্য নয়। তুমি পারো না, মানবিকতার খাতিরেই পারো না।”- বৃথা আস্ফালন করতে লাগলো নারী।
“আমার পূর্বপুরুষ কি নিজেকে বাঁচাতে সমর্থ হয়েছিলেন? সোমনাথ বেঁচেছিলো ? নালন্দা বেঁচেছিলো? মানবতার মূল্য কী যদি তা মানবকে বাঁচাতে না পারে?”- মিটিমিটি হাসতে লাগলো যুবক।
” বিজিত জাতি তো বিজয়ীর থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করে , শিক্ষা নিয়ে নিজেরা বিজয়ী হয়ে উঠতে চায়। এই তো শাশ্বত নিয়ম। কোন কোর্টের জাজমেন্ট তার ব্যত্যয় ঘটাবে?”- আবার বলে উঠলো যুবক।
না , শুধু যুবক নয়। এতক্ষণে নজরে এলো নারীর। যুবকের চারপাশে জড়ো হয়েছে অসংখ্য মামুদ, অসংখ্য বখতিয়ার। রক্তবীজের মতো। মন্দির ভাঙতে নয়, মন্দির বাঁচাতে। আইয়াপ্পার পবিত্রতা রক্ষা করতে। তাদের দেহ হিন্দুর। কিন্তু মস্তিষ্ক সুদূর মরুভূমি থেকে ধেয়ে আসা এক লুঠেরার।
শুক্লপক্ষের দ্বাদশীর চাঁদের দিকে তাকিয়ে একযোগে হেসে উঠলো মামুদ, বখতিয়ারের দল। তারপর, চরাচর কাঁপিয়ে তারা চিৎকার করে উঠলো,
“ফাইট শবরীমালা, ফাইট।”

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।