• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক উপন্যাসে সপ্তর্ষি মণ্ডল (পর্ব – ৪)

অজ্ঞাত

(১৪)
বম ভোলে । মহাকাল নগরী উজ্জয়িন এসে দাঁড়াল ট্রেনটা । এখানেই ওর শেষ স্টপ । ধীরে ধীরে কাঁধে তিনটে ভারি ঝোলা নিয়ে প্ল্যাটফর্মে পা রাখলো সন্দীপন । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে তখন ভোর সাড়ে চারটে বাজে । হালকা আলো অন্ধকারে ঢাকা নীল আকাশ আর মাঝে মাঝে লাল আলোর তরঙ্গ । কাঁধ থেকে ঝোলা গুলো নামিয়ে রাখল সে প্ল্যাটফর্মের মেঝে । তারপর দুদণ্ড জিরিয়ে নিতে বসে পড়লো একটা ফাঁকা বেঞ্চে । যথেষ্ট মানুষের ভিড় প্ল্যাটফর্মে তখন , তবে সকলেই তন্দ্রার কবলে । বসে বসে কোন কাজ না পেয়ে ফেসবুকটাই খুলে বসলো শেষ মেস । নোটিফিকেশনের ভিড়ে তখন তার অনুসন্ধানের একটাই নাম । লক্ষ করলো দ্বিতীয় কবিতায় এখনো তার ছোঁয়া লাগে নি । ততক্ষনে ভোরের আলো বেশ অনেকটাই ফুটে গেছে আর তাই ফেসবুক থেকে বেড়িয়ে আসতে উদ্যত হলো সে । যতই হোক , দায়িত্বের বোঝা তার অনেক । কুলি মজুরের জীবন তাকেও বাঁচতে হয় , তবে সবটাই ছদ্ম ।
বেড়িয়ে আসার আগে উজ্জয়িন এ অবস্থানের খবরটি লিখে নীচে লিখে এলো ,
” সকালের সূর্যটা কেমন নতুন মনে হল ,
যেন পূর্ণ প্রাণ ভরে দিয়ে কেউ ছেড়ে দিয়েছে ।।
আকাশ লাল করে বয়ে চলেছে
তার তরুণ রক্ত ।।
বাতাসে এক খুশির আনন্দ ,
এক অদ্ভুত নেশায় যেন আসক্ত পৃথিবী ,
বাঁচবার নেশা , বাঁচাবার নেশা ,
নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলার নেশা ।।
পুরোনো জীর্ণ পাতা উড়ে গেছে
দখিনা বাতাস বইছে প্রকৃতির প্রতি অক্ষরে ,
সে মহা আনন্দের উৎসবে আমায় যেন
কে টেনে নিয়ে চলেছে , উল্লাসের এই জোয়ারে ।।
পরিচয় হীন , নাম গোত্র জানি না কিছুই ,
তবু তার ধ্বনি আমি শুনতে পাই ,
ঐ পুব আকাশের ওপারে যে পথ রয়েছে ,
ওখানেই , হ্যা গো ওখানেই
আমি রোজ তাকে দেখতে পাই ।।
সে অচেনা , অজানা মুখ আমায় ডাকে রোজ
কত কথা কয় ,
তবে একবার তার মনের পুরো ঠিকানাটা
মন আমার লিখে রাখতে চায় ।।
জানা নেই , কেন এতো দিন পরে
নতুন মনে হলো সব কিছু ,
একি কোন মায়া , নাকি তার ছায়া
যা নতুন করে গড়ছে আমায় ” ।।
কাঁধের ভার ঝুলিয়ে একপা একপা করে বাইরে বেড়িয়ে এলো সে । তখনও শহরটি সে ভাবে জেগে ওঠেনি , তবে কিছু কিছু অটো এসে ভিড় করেছে স্টেশনের সামনে । তাদের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে বললো ,
—– কোই হোটল চলোগে ?
যদিও উজ্জয়িনের রেলস্টেশনে বসেই সে মনস্থির করে ফেলেছিল যে পূর্বত্রুটি সে অনুসরণ করবে না আর । চাকরির প্রথম দিন থাকার একটা পাকা পোক্ত ব্যবস্থা করে নেবেই । ভোপাল তাকে যথেষ্ট শিখিয়েছে । আজ তার ব্যবহার করবে সে ।
—— মন্দির কে পাস লে চলু
অটো ওয়ালা প্রশ্ন করলো সন্দীপনকে ।
সন্দীপন দুচোখ পাকিয়ে উত্তর দিলো ,
—– নজদিক মে কহি সস্তা নহি হোগা ।
—– মিলেগা না সাহাব । আপন একদম নজদিক মে সস্তা হোটেল লে চলতে হ্যায় আপকো । পর দো-শ লাগেগা , ভাড়া ।
সন্দীপন এই দীর্ঘ পথ যাত্রা করে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে , তাই ওই ভাড়াতেই রাজি হয়ে গেল ।
—– ঠিক হ্যায় , চলো ।
এই বলে সে অটোর ভেতরে উঠে বসে পড়লো ।
(১৫)
ঘড়িতে তখন দশটা বেজে দশ । হোটেলের রুমে স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে সন্দীপন বেড়িয়ে পড়লো পি ডাব্লু ডি র দিকে । অফিসটা এমন কিছু দূর নয় তার হোটেল থেকে সেটা আলি স্যারকে ফোন করে আগে ভাগেই জেনে নিয়েছিল সে । হোটেলের কামড়ায় তালা মেরে সে বেড়িয়ে এলো হোটেল থেকে । অটোর অভাব নেই , তাতে চেপেই প্রস্থান করলো আলি স্যারের অফিসের দিকে ।
—– আন্দার আউ ।
হাসি মুখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো সে ।
ডিভিজানল একাউন্টেন্ট লুকমান আলি নিজের কাজে ব্যস্ত ছিল । মাথা ঝুকিয়ে তিনি কিছু কাগজ পড়ে দেখছিলেন । আওয়াজ শুনে , মাথা না তুলেই মিষ্টি স্বরে উত্তর দিলেন ,
—– আন্দার আ কে ব্যয়ঠো । দো মিনিট ।
সন্দীপন আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে পড়লো । লুকমান আলি নিজের কাজ শেষ করে মুখ তুলে তাকালো তার দিকে । বেশ ফর্সা আর উচ্চতাও ৬ ফুটের কাছাকাছি হবে । এক মুখ হাসি নিয়ে বলে উঠলেন ,
—- বোলিয়ে । কেয়া সেবা কর সকতা হু ।
সন্দীপন নিজেকে সংযত করে উত্তর দিলো ,
—– স্যার । মেরা নাম সন্দীপন দত্ত হ্যায় । ডি.এ নিউ এপয়েনটেড ।
লুকমান এতক্ষণ তাকে সেভাবে গুরুত্ব না দিলেও এবার মুখ তুলে দেখলো এবার । তারপর হাত বাড়িয়ে অভিবাদন জানিয়ে বললো ,
—– আচ্ছা তো আপ হ্যায় …. তুমহারা পোস্টিং তো উস ডিভিশন মে থে ন ।
সন্দীপন ঘাড় নেড়ে উত্তর দিলো ,
—– হাঁ স্যার … লেকিন উহা কে বারে মে মাঝ কুছ নহি পতা । আপ অগর ….
তার কথা শেষ হতে না হতে লুকমান নিজের আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললো ,
—- চলো ।
তারপর সন্দীপনকে সঙ্গে নিয়ে নিজের প্রাইভেট কারে তারা উপস্থিত হলো ভূ জল ডিভিশনে । উপস্থিত সকলে নতুন একাউন্টেন্টকে যেভাবে স্বাগত জানালো তা সন্দীপন কোনদিন কল্পনাও করে নি । আলী স্যার এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো ,
—— স্যার । ইনকা নাম সন্দীপন ডট হ্যায় । ইহা পোস্টিং হুয়া হ্যায় । কাম সারে ম্যায় হি করুঙ্গা , এস ইউজুয়াল । ইহে বস শিখেঙ্গে ।
——- ইহা তো কাম হি নহি হ্যায় । শিখেঙ্গে কেয়া ।
পঞ্চান্ন বছরের বৃদ্ধ এক্সিকিউটিভ হেসে উত্তর দিলো । পাশাপাশি ডিভিজানের অল ইন ওয়ান সোলাঙ্কি কে উদ্দেশ্য করে বললো ,
—– সোলাঙ্কি জি । আব আপ কো ইয়ে জিম্মেদারি ভি লেনা পরেগা ।
সোলাঙ্কি মুচকি হেসে যা উত্তর দিলো তার থেকে পরিষ্কার তিনি কিছু রাগ আজ উগড়ে দিতে সক্ষম ,
—– এস ইউজুয়াল স্যার । মাই রেস্পন্সিবিলিটি । আপন তো ইসি কাম কে লিয়ে বনে হ্যায় সাহাব । ইয়ে ভি লে লিয়া ।
অফিসের প্রথম দিন আজ । তাই সন্দীপনও বিদায় নিলো আলি স্যারের পিছু পিছু , উদ্দেশ্য , ঠিকানা অন্বেষণ ।
সারাদিন ঘুরে বেড়িয়েও সন্দীপনের উদ্দেশ্য অপূর্ণই থেকে গেলো । অধিকাংশ ভাড়া ঘর যুতসই নয় আর যেগুলো পছন্দ হয়েছিল সে সব ব্যাচেলরকে ঘর দিতে রাজি নয় । উদাস অবস্থায় হোটেলে ফিরতে সন্দীপনের জীবনে রাত নেমে এলো । একটা চায়ের অর্ডার দিয়ে সোজা নিজের রুমে ঢুকে পড়লো সন্দীপন ।
(১৬)
আজ রাতে সন্দীপনের মন ঘরে একটুও বসছে না । মায়ের সাথে একটু আগেই কথা হয়েছিল তার । কিন্তু সাগরের জলে যখন উত্থাল পাতাল লেগে থাকে তখন ভাসমান জাহাজের সময় হয় না নিজের লোকের সাথে মিশে যাওয়ার । অবশেষে হোটেলের কামড়ায় তালা মেরে বাইরে বেরিয়ে আসে যুবক । আকাশের নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন , তারপর রিসেপশনে প্রশ্ন করে সে ,
—– মন্দির কিধর হ্যায় ?
লোকটি হাসি মুখে উত্তর দেয় ,
—– ডায়ে সিধে যাকে ফির ডায়ে জাইয়ে , মন্দির মিল জায়েগা ।
সন্দীপন দুপা সবে এগিয়েছে , পিছন থেকে হোটেলের লোকটি আবার ডেকে উঠলো তাকে ,
—– ইতনে রাত কো মন্দির ! আরতি দেখনা হ্যায় ?
সন্দীপন অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো ,
—— আভি আরতি !
—– আভি নহি । রাত ১০ বজে শুরু হোতা হ্যায় ।
উত্তর দিল ভদ্রলোকটি ।
সন্দীপন আর কোন উত্তর না দিয়ে বেড়িয়ে এলো এবার । শান্ত শহরের বুকচিরে এগিয়ে চলা শীতল হাওয়ার উপলব্ধি তার মনকে উৎফুল্ল করে তুলছে বারবার । এক অচেনা আনন্দে হারিয়ে যেতে মন চাইছে বারবার যখন , তখন নির্জন পৃথিবী ভেদ করে বেজে ওঠা শব্দে নতুন করে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে আবার । বোম ভোলের গর্জন সরিয়ে মোবাইলের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে হয়েছে তার । চেয়ে দেখে রিম্পা ফোন করেছে এত জন্ম পরে হঠাৎ ।
—– বল রে শয়তান । হঠাৎ কি মনে করে !
সন্দীপন হাসতে হাসতে বলে উঠলো ।
—— তোর ছবিটা ফেসবুকে দেখে ফোনটা করলাম । কোথায় তুই ?
বেশ অবাক হয়েই উত্তর এলো রিম-এর দিক থেকে ।
—– বোম ভোলে । বোম বোম ভোলে ।
চিৎকার করে উঠলো সন্দীপন । তারপর শান্ত গলায় উত্তর দিলো সে ,
—– কেন রে । দুক্কু হচ্ছে । প্রেমিক হাতছাড়া হয়ে গেলো , এবার তোর কি হবে ।
রিম ও একরাশ ন্যাকামি মেরে সাথে সাথে উত্তর দিলো ,
—– আহা ! যেন তুই ছাড়া ছেলে নেই ইহ লোকে । মিস বিশ্বাসকে বিয়ে করার জন্য লাইন পড়ে আছে । বুঝেছিস ?
সন্দীপন তার উত্তর শুনে হা হা করে হাসতে লাগলো ।
রিম্পা রাগ করে ফোন কেটে দিলো তার ।
(১৭)

সংগ্রামের মধ্যে বড় হয়ে ওঠা জীবন সুখী হয় না কোনদিন । জীবন ধারায় ভেসে চলতে হয় প্রতিটা দিন , প্রতিটা মুহুর্ত তাদের । সন্দীপন ভোপাল ছেড়েছিল যে ঘরের সন্ধান বুকে নিয়ে , উজ্জয়িনের বুকে তার সমাপ্তি তো হল ; তবে পেয়িং গেস্ট । গৃহহীন বিধবাটি , যাকে সে মা বলে ডাকে , ভেবেছিল নিজের সাথে নিয়ে আসবে , নিজের কাছে রেখে দেবে ; তা আর পূর্ণ হলো কই ?
মাকে তার বাপের বাড়িতে রেখে আসার কারন ছিল একটাই । ছোট বোন একলা থাকে , যদি এতে তার কিছু সুবিধা হয় ; কিন্তু সবটাই যে উল্টে গিয়ে পাল্টে যাচ্ছিল । পান থেকে চুন খসলেই নেমে আসতো অশান্তির ঝড় এই বিধবার জীবনে । সেদিন বৃষ্টি মুখর এমনই এক সন্ধ্যায় মায়ের গলাটা বেশ নাড়া দিয়ে গেছিল সন্দীপনকে ,

—– ফ্ল্যাট পেলি কোথাও বাবু ?
সন্দীপন কিছুক্ষন চুপ থেকে উত্তর দিলো ,
—– আবার কিছু হয়েছে ?
—- না বাবু কিছু হয়নি তো , জিজ্ঞাস করছিলাম ।
মা ধীর স্বরে উত্তর দিলো ওপাশ থেকে ।
সন্দীপন কিছুই বুঝতে পারছে না । তার মন কেন জানা নেই বারবার বলছে যে কোন কিছু ঠিক নেই । ঠিক এমনই এক মুহূর্তে পিছন থেকে একটা চিৎকার স্পষ্ট শুনতে পেল সে । গলাটা যে মাসির তা বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় নি তার । চিৎকার করে বলে চলেছে সেই কন্ঠস্বর ,
—– লাগা , লাগা । ছেলের কাছে ভালো করে লাগা । আমি কি বুঝি না কিছু এখানে কেন এসেছিস । নিজের ঘর বাড়ি স্বামী সব কিছু গিলে রাক্ষুসীর এখন বাপের বাড়ির ওপর নজর পড়েছে । গিলতে এসেছে এখানে ।
মায়ের কণ্ঠস্বরে বারবার সে শুনে চলেছে একই অনুরোধ ,
—– রুমি , চুপ কর । চুপ কর এবার । তুই যা ভাবছিস তা ঠিক নয় ।
সন্দীপন এসব কিছু শুনে চলেছে আর দুচোখের জলে ভেসে চলেছে এক অজানা পারের দিকে । এভাবেই আধ ঘন্টা পেড়িয়ে গেলে সে হ্যালো হ্যালো করে সাড়া দেওয়ার চেষ্টা করে ফোনের এপাস থেকে , কিন্তু কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে ফোন কেটে গেছে । এরপর বেশ কয়েকবার রিং ব্যাক করলেও মা আর ফোন তোলে না । হতাশ হয়ে ঘরের মাটিতেই চুপটি করে বসে পড়ে সে । ভারি উদাস মন ধুয়ে যাচ্ছে আজ ক্রমাগত দুই চোখের জলে আর অন্যদিকে ফেসবুকে লেখা হচ্ছে নতুন এক স্ট্যাটাস —-
” ফেলে আসার খোঁজে পেড়িয়ে যায় পথ , ঠিক ওই ঝর্ণার মতোই — একদিন নদী হয়ে হারিয়ে যাবে সব । ফেলে এসেছি কত স্বপ্ন না পাওয়া শত শত , ফেলে এসেছি রূপের পাহাড় মেঘে ঢাকা সূর্যের মত । ফেলে এসেছি কত ছোঁয়া যা ভালোবাসা হতে পারতো আজ । ফেলে এসে বন্ধু পরিবার , শুধুই আপন করেছি পরোয়া কাজ ।
এখন ওদের দিকে দেখি আর হাসি লাগে ভারি । ওরাও একদিন দেখবে ফেলে আসা পথ আর হয়তো আমারই মতন হাসবে বারবার ।
সেদিন সব একই থাকবে , শুধু , আমি প্রকৃতি হবো আর ওরা আমার মতোই মৃত্যুলোভি ইনসান ” ।

( চলবে )

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।