প্রায় বছর তিন হল রিনুরা খবরের কাগজ নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে! প্রতিদিন সকালের বিশ্রীরকমের মানসিক অত্যাচার আর নিতে পারছিলো না ওরা কেউই! ছেলে বড় হচ্ছে,দেশদুনিয়ার হাল হকিকত জানা দরকার; কোথায় কী হচ্ছে না জানলে সে যে পিছিয়ে পড়বে রেস-এ! হয়ত তাই! তবু রিনুরা ‘আর খবরের কাগজ নেবোই না’ ঠিক করলো! তাতে যে অপ্রিয় খবরের স্রোত আটকানো গেল পুরোপুরি, তা নয়; যেহেতু দুনিয়া এখন আক্ষরিক অর্থেই মুঠোয় বন্দী, তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর এবং গুজব, কোনটাই পেতে বিন্দুমাত্র দেরি হয় না! তবু রিনুদের মনে হল, এ মন্দের ভালো! না দেখতে বা জানতে চাইলে অন্তত স্ক্রিনের অন্যপ্রান্তে চলে যাওয়াটুকু রইলো নিজের হাতেই! রিনু আজকাল তাইই করে থাকে! আশেপাশে, এখানে নয় ওখানে, এটা নয় ওটা ঘটেই চলেছে; যার অনেকগুলোই অত্যন্ত পীড়াদায়ক! ভেতরে ভেতরে তোলপাড় করে দেয়; বিবেকের সামনে নিয়ে আসে বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন! নিজের মধ্যে ছট্ ফট্ করতে থাকে বোবা শব্দ! কিন্তু সেসব বলে ওঠা হয় না কিছুতেই….
আসলে ইদানিং পালাতে শিখেছে রিনু! নাকি ইদানিং নয়, বহুদিন ধরেই চলছে এই পালিয়ে যাওয়া?! খেয়াল করে দেখলে বোঝা যাবে যা আমাদের নাপসন্দ, অথবা যা আমাদের কষ্ট দেয়, সুস্থির থাকতে দেয় না, আমরা তার থেকে শতহস্ত দূরে থাকারই চেষ্টা করি! হ্যাঁ, প্রকারন্তরে আমরা পালিয়ে যাই! আর পরিবেশ, প্রতিবেশী, আত্মীয়, বন্ধু, শত্রু সব কিভাবে যেন আমাদের এই পালিয়ে যাওয়ায় মদত দেয়!
সাগরপাড়ে কোন দেশে, ক্ষমতা কার হাতে গেল, আপাতভাবে তাতে তৃতীয় দুনিয়ার বাসিন্দার তেমন কিছু এসে যাওয়ার কথা নয়! কিন্তু সত্যিই কি নয়?! সেই দেশের অর্থনৈতিক-কূটনৈতিক-রাজনৈতিক পদক্ষেপ কি এই তৃতীয় বিশ্বেও প্রভাব ফেলছে না?! খানিক বুঝে, আর অনেকটাই না বুঝতে চেয়ে আমরা এই বিষয় থেকে পালাতে চাইছি! পালাচ্ছিও!
দেশের কোন প্রান্তে, খেতে না পাওয়া গরীবগুর্বো চাষীর দল মিছিল করলো, ক’জন সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লো, কতগুলো নিরন্ন মানুষ নিরুপায় হয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো,আর আমরা?! পাশ ফিরে শুলাম! আরো একবার পালিয়ে গেলাম!
একের পর এক এমন খবর এলো, আর আমরা ভাবলেশহীন মুখে জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকলাম! আমাদের পালিয়ে যাওয়ার ‘লিস্টি’ আরেকটু লম্বা হল!!
কখনও একে, কখনও তাকে দাগিয়ে দেওয়া হল, বলা হল ‘ও আলাদা’, ‘ও অমুক’ ‘ও তুসুক’! ত্যাগ দাও ‘ওকে’! একঘরে করে দাও ‘তাকে’! আমরা প্রশ্ন করলাম না! একবারও ভাবলাম না, তোমার আমার যদি নিজের পথে, নিজের মতে চলার স্বাধীনতা থাকে, তাহলে অন্যরা কী দোষ করলো?! আমরা চুপ করে থাকলাম! আসলে আমরা আবারও নিজের কান বন্ধ করে মনে করলাম ‘কই, কেউ তো কিছু বলছে না!!! সেই পলায়ন মনোবৃত্তি!!!
আমরা এখন শুধুই পালিয়ে পালিয়ে বাঁচতে চাই! অন্যের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনায় দীর্ঘশ্বাস চেপে ভাবি ‘আমার সঙ্গে তো হয়নি!!’ আমরা ভাবতে ভুলে গেছি যে সবসময় এই পালানোর পথ হয়ত পাবো না আমরা! ভাবতে ভুলে গেছি যে হারাধনের দশটি ছেলের এক আমিও পড়ে থাকতে পারি সব গুনতির শেষে! কী হবে তখন????