মুড়িমুড়কি -তে সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
হারানিধি
সেদিন হঠাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে গেল… তারপর থেকেই খুঁজে যাচ্ছেন মানব বাবু।
বাঙালির যা হয় আর কী—প্রথমে বৌয়ের আঁচলে লুকোনো আছে কিনা দ্যাখা।
মাথা চুলকিয়ে বললেন,
“এই মানে… খুঁজছিলাম..”
“এই সাত সকালে?”.
“এটা সকাল? বেলা তো হয়ে এলো! আর কী খুঁজছি বলা যাবে না” মিন মিন করে বললেন বুঝি।
“নেশা টেশা করছ নাতো? নেশার জিনিস?”
কাছে এসে গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করলেন গিন্নি।
“আরে নাহ! আমি কী সেরকম লোক!”
মানব বাবু গতিক সুবিধের নয় দেখে আস্তে আস্তে কেটে পড়লেন ঘর থেকে।
কোথায় গেল? গালে হাত দিয়ে ভাবতে শুরু করলেন….
” সেই ছোট বেলা থেকেই জিনিসটা নিয়ে ঘুরতাম, কলেজ জীবনেও তো সেটাকে বেশ কয়েকবার ব্যবহার করেছি…
কিন্তু চাকরিতে ঢোকার পর ওটার আর দরকার পড়েনি।
তারপর বয়স যত বেড়েছে সংসারের দায়িত্ব, সমাজের চাপে….
ওটাকে রেখে দিয়েছিলাম।
মাঝে মাঝে যৌবনের পোকা মাথায় কামড়ালে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতাম…আবার ঝেড়ে পুছে রেখে দিতাম. তবে বাইরে বের করার সাহস আর করতাম না।
তারপর আস্তে আস্তে একদিন ভুলেও গেলাম…
আর মনেও হয় নি ওটার কথা। বেশ ছিলাম।
আর তাছাড়া দরকারই বা কী?”
কিন্তু সেই যে, কী বলে… ঘুণপোকা!
কুরকুর ঘ্যানঘ্যান করেই চলেছে মাথার ভেতর।
বাবার কাছে গেলেন, বুড়ো ঝিমোতে ঝিমোতে বলল
“সে তো কবেকার কথা! তোর ছোটবেলায় তো তোকে দিয়ে দিয়েছি, মনা।”
মহা মুসকিলে পড়লেন মানব কুমার!
মাথার পোকাটা আবার নড়তে শুরু করেছে যে!
দু এক জন বন্ধুকে জিগ্গেস করতে, তারাও ফিস ফিস করে বলল,
“আরে আমিও খুজছি… কোথায় যে গ্যারেজ করলাম একদিন।”
কাগজের আপিসে কাজ করে ইস্কুলের বন্ধু—প্রকাশ.. প্রকাশ গুপ্ত।
ডবলহাফ চা আর গোল্ড ফ্লেক সিগারেট খাইয়ে বলল: “খেপেছিস তুই? নাকি স্বার্থপর হয়ে গেলি, মাইরি? ভেবে দ্যাখতো, সত্য কব্বে মরে ভূত হয়ে গ্যাছে… অই ব্যাটাচ্ছেলে শান্তি “এই আসছি” বলে সেই যে উধাও হয়ে গ্যালো তো গ্যালোই… আর আমরা তো শালা
“কাগুজে বাঘ”!
ছাড় তো। যত্ত হিপোক্রিসি।”
জিনিসটা দামি ছিল। মানবের মন কিছুতেই যেন মানে না।
শুধিয়েছে, রাস্তায় খুঁজেছে, কিন্তু খোঁজার রাস্তা কেউ বাতলাতে পারেনি।
থানায় গিয়ে বলতে, ডিউটি অফিসার বলল,
“আগে বলুন, ব্যবহার করার পারমিশন আছে?
অনুমতি পত্র দ্যাখান………. যান যান কাটুন তো, নয়তো দেব ঢুকিয়ে…..”
হাতের রুল না শিক লাগানো ফটক—কোনটা দেখাল বুঝতে না পেরে আরো ঘেঁটে গেল বেচারা মানব…. সরেও পড়ল।
রাস্তায় এক গুঁফো নেতাকে পাকড়াও করে প্রবলেমটা বলতে, হেসে বললেন,
“ভাই, এতো বাঙালির আমাশার মতই ক্রনিক রোগ, সকলেরই হারায়।
শুধু আমাদের মত কিছু লোকদের হারায় না।
আমাদের জমা রাখতে হয় । “
আমি তখন হেলাবটতলা ব্র্যাঞ্চে পোস্টেড। শুনেছিলাম মানববাবু নাকি আমার বাড়িতেও ঢুঁ মেরেছিলেন। আমাকে না পেয়ে, টেবিলের ওপরে রাখা শিবরাম চক্কোতির ‘ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা’ বইখানা নিয়ে গিয়েছিলেন সেদিন।
কিছুদিন আগে সেই মানববাবুর সঙ্গে দেখা। খালাসিটোলায়।
‘খোঁজার’ ভূত ঘাড় থেকে নেমেছে মনে হল। ছোলা সেদ্ধ—পাঁপরভাজা চিবুতে চিবুতে এক ঢোঁক জলতরঙ্গ গলাঃধকরণ করে Pun-উন্মুখ হাসিমুখে বললেন—“উফফ, চক্কোতি বামুন বলে কতা—উনি ঠিকই তো বলেছেন! মাঝে মাঝে একটু নাড়াচাড়া না করলে ওই বস্তুটিকে Nurture করা হয়না। একদণ্ডও তাকে হেলাবো না খেলাবো না—অথচ চাইবো ঈশ্বর বাঁড়ুজ্জে হতে—ইল্লি আর কী!
সেই সুযোগেই তো মেরুকরণ করতে পেরেছে লোকগুলো।
আহা, কী লিখেছে তোমার ভিয়েন সম্রাট! কেন যে আগে পড়িনি! এদিক ওদিক খুঁজে কি হবে? কালি, দেরি, ফুঁকো—কোন দাদা-ই খুঁজে দেবে না। আমারটা আমাকেই খুঁজে নিতে হবে, ভাইটি।
আর দেরি নয় রে, এবার চল হাতে হাত ধরি। মানদণ্ড বেহাত হয়ে গেছে। পানি না জল… নাকি পানীয় জল—ছাড়ো ওসব পাণিনির নক্কা ছক্কা। এখনো দণ্ডপাণি না হলে… এরপর থেকে single use plastic এর মাল লাগিয়ে দেবে জন্মদাতা। চলো, মাথা উঁচু করে এগিয়ে পড়ি—মেরুজিন হতেই হবে।
আজ শিবরাম স্যার জীবিত থাকলে সকাল বিকেল রাবড়ি নিয়ে প্রণাম করে আসতাম হে।”
শিবরাম রিনিকে না পেলেও,
আমার ঈশ্বর, তাঁর পৃথিবী আর ভালবাসার গল্প শুনিয়ে মানববাবুর মেরুদন্ডের খোঁজটি যে দিয়েছেন—সেটাই বা কম কিসে?