একটুও ভয় করছে না আর! চেনা ছকের জীবনযাত্রার বাইরে এই যে বন্দীজীবন, চারদেওয়ালের ঘেরাটোপের ভিতর এক অজানা আশঙ্কা, অনিশ্চিত আগামীকে সঙ্গী করে বেঁচে থাকা, সে যতটা দূর্বিসহ হবে বলে ভাবা গেছিল, ততটা লাগছে না আর! নাকি দ্রুত অভিযোজনক্ষমতায় সেটুকুও রপ্ত হয়ে গেল এ’কদিনে! কে জানে! মোটকথা হল প্রাথমিক ভয়টা নেই আর।
উল্টে, ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তার পাশাপাশি কিছু ছোটো ছোটো ভালোলাগার মুহূর্তও এসে জায়গা করে নিচ্ছে রোজ। একছাদের নীচে যাদের সঙ্গে বসবাস নিত্যদিনের, আত্মজন যারা, তাদের মুখের প্রতিটা রেখা, আনন্দে ও দুঃখে রঙ বদলে যাওয়া, চোখের ভাষা এসব তো অজানাই ছিল এতদিন! আজ এই দীর্ঘ অবসরে সেসব যেন নতুন হয়ে ফিরে আসছে! আধছেঁড়া বাঁধনগুলো কি এভাবেই মজবুত, পাকাপোক্ত হয়ে উঠবে আবার? সম্পর্কের ভাঙনগুলো কি মেরামত হবে এই অবসরে? সন্তান কি চিনবে, জানবে বাবা-মায়ের শরীরের গন্ধ?
সেই যে অনেককাল আগে, যখন মানুষের ছুটে চলা ছিল না উল্কার মত, ঘরের মানুষ সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বেলে অপেক্ষায় থাকতো প্রিয়জনের, আর সেই মানুষ ফিরে এলে গোল হয়ে বসে সুখ-দুঃখের কথা হত দু’দন্ড, যাপনসুখের ছায়া পড়তো সুখী দেওয়ালে, সেইসব দিনে, সন্ধ্যায় এভাবেই কি সংসার বুনতো মানুষ? এভাবেই কি ভাতের গন্ধে ‘ম ‘ম করতো গৃহকোণ?
ওদিকে আকাশের রঙ ঘন নীল হয়ে উঠছে দিনে দিনে। বুক’ভরে শ্বাস নিলে ভিতরে বহুদূর অবধি ছড়িয়ে যাচ্ছে টাটকা সতেজ বাতাস! কোষে কোষে বুঝি মাতন লাগছে এখন! এমন নিস্কলুষ বাতাস তো তারাও পায়নি আগে! ঘোড়দৌড়ে সওয়ার হতে হতে নিজের চারপাশটাই বদলে দিয়েছে মানুষ। উন্নয়নের নেশায় মেতে গরল বানিয়ে ছেড়েছে আকাশ-বাতাস। জঙ্গল কেটে ভাগিয়েছে জন্তুজানোয়ার, পাখি। আদিবাসীর পায়ের তলা থেকে নির্বিচারে কেড়ে নিয়েছে জমি।
তারপর একদিন আচমকা থমকে গেছে সব। একটা অচেনা, অজানা ভয়ে কেঁপে উঠে দৌড়ে গিয়ে ঘরে সেঁধিয়েছে মানুষ! এক লহমায় থেমে গেছে সভ্যতার রথের চাকা! রাতারাতি শিকড়ের কাছাকাছি ফিরে গেছে মানুষ। জনশূন্য পথঘাট, বাজার, ঝাঁ চকচকে মল, কলকারখানা, অফিস, খাঁ খাঁ করছে সব কোনো জাদুমন্ত্রে!
কোথাও সাড়াশব্দ নেই! দেশকালসীমানা নির্বিশেষে খালি হয়ে গেছে সব! প্রাণভয়ে সিঁটিয়ে থাকা কোটি কোটি মানুষের গলার আওয়াজটুকু যেন শুষে নিয়েছে কেউ!
অন্যদিকে যেন বুকে বল পেয়েছে উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া পাখিরা, জন্তুজানোয়াররা! পা টিপে টিপে ফিরে আসছে তারা। নির্জন দুপুরে, নিশুতি রাতে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা, শুঁকে ফিরছে হারানো মাটির গন্ধ!
বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে? হয়তো না। সত্যিই এক অভূতপূর্ব সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে মানুষ! এক বিচিত্র দোলাচলে আটকে গেছে গোটা একটা সভ্যতা। সবার অলক্ষ্যে কখন যে রিফ্রেশ বাটনটা চেপে দিয়েছে প্রকৃতি, আত্মমগ্ন, হ্যাং হয়ে যাওয়া মানুষ টেরই পায়নি! বিস্মিত, বিমূঢ়, হতচকিত অবস্থায় ঘরে ফেরার কথাই মনে হয়েছে সবার আগে। আপাতঃ নিরাপদ কুঠুরিতে।
এখনও ফিরছে অনেকে। হঠাৎ থমকে যাওয়া বর্তমানকে পিছনে ফেলে, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে আঁকড়ে এখনো ঘরে ফিরছে লাখ লাখ মানুষ! খিদে তেষ্টা ভুলে, পায়ে হেঁটে চলেছে মানুষের মিছিল। কোনো রাজা-উজিরে আর বিশ্বাস নেই তাদের, ভরসা নেই কোনো অভয়বাণীতে। একটাই চিন্তা, ফিরতে হবে নিজের নিজের ঘরে, প্রিয়জনের বাঁধনের আওতায়।
বহুকাল আগে ঘর বাঁধতে শিখেছিল মানুষ। স্নেহ, প্রেম, ভালোবাসা দিয়ে বাঁধতে শিখেছিল সংসার। তারপর কালে কালে, সভ্যতার এগিয়ে যাওয়ার নেশায় বেরিয়ে পড়েছিল সব ছিঁড়ে। একে একে আলগা, অসার হয়ে গেছিল সেইসব বাঁধন! আজ ফের সেই শিকড়ের কাছেই ফিরে যাওয়ার পালা।
এক ক্ষুদ্র, নগণ্য ভাইরাস আজ ঘরমুখী করেছে কোটি কোটি মানুষকে, চিনিয়ে দিয়েছে অওকাত। আটশো কোটি মানুষ নিজেকে বেঁধে ফেলছে ঘরের ভিতর। সুখদুঃখের গল্প করছে বহুকাল আগের মত। সন্তান খেলছে বাপ-মা’য়ের সঙ্গে, বুড়ো মা-বাবার ঘুমন্ত কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে লায়েক ছেলেমেয়ে, পড়শীর চাল-ডাল-নুনের খবর নিচ্ছে কড়া নেড়ে, ভূখা মানুষের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছে কেউবা!
বিনানোটিসে দু’দন্ড অবসর দিয়েছে প্রকৃতি। ঘরে ফেরার, নিজেকে খোঁজার, শুধরে নেওয়ার। পারবে কি মানুষ এই অবসরের সদ্ব্যবহার করতে? সুযোগটুকু কাজে লাগিয়ে নিজের ভিতরের ফাঁকফোকরগুলো মেরামত করে ঘুরে দাঁড়াতে? সময় বলবে। অথবা সময় এলে মানুষই বলবে হয়ত।