‘শিয়রে শমন’ এই দুটি শব্দই যথেষ্ট মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে ফেলার জন্য । অতীতে ভারতে বহু রোগ মহামারীর আকার ধারণ করেছে ও বহু মানুষের অসময়ে যে মৃত্যু ঘটেছে এ বিষয় নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই । তবে আধুনিককালে যন্ত্রসভ্যতার যুগে এখন ভাইরাস ঘটিত রোগগুলি এক দেশ থেকে আর একদেশে ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা অতি প্রবল, কারণ নব্য এই বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবী এখন মুষ্টির মধ্যেই । যন্ত্রের একটা ‘ক্লিক’ মুহূর্তে আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে এক দেশ থেকে আরেক দেশে, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে । মানুষে মানুষে সংমিশ্রণ আজ একেবারে ‘জল-ভাত’ ।
আজ থেকে সত্তর থেকে একশো বছর আগে ‘মেডিকেল সায়েন্স’ যখন আজকের তুলনায় কিছুটা পিছনে তখন দেশের ভিতরে ওষুধপত্রের যোগান না থাকা, নির্দিষ্ট রোগের ওষুধ না থাকা, বিভিন্ন কারণে ‘আজকের দিনে সাধারণ রোগ হয়ে যাওয়া কলেরা / যক্ষ্মাও ছিল মহামারী । সেখান থেকেই মনে হয় ‘স্বচ্ছ ভারত’ শব্দবন্ধ দুটির আগমন, আর বেশ কিছু কাজ হয়তো হয়েওছে এই বিষয়ে ।
একটি দেশে সরকার আছে, আর সরকার দেশবাসীর সুরক্ষার জন্যই কাজ করেন, এটাই তো ‘কল্যাণকামী রাষ্ট্র’ ব্যবস্থার মূল সম্পদ । দেশের লোককে আতঙ্কিত না করে সজাগ করে রাখাটা মনে হয় অনেক বেশি জরুরী । যদিও লিখিতভাবে সরকার সজাগই করছেন, ভারতীয় ব্যবস্থাতেই মনে হয় এটা সম্ভব যে সরকারি নির্দেশ যখন সজাগ করার জন্য আসে তখন আমরা হয়ে উঠি আতঙ্কগ্রস্ত । হয়তো এর একমাত্র কারণ, স্বাধীনতা-পরবর্তী থেকেই দেশ বা দেশের সরকার জনমানসে এমন ধারণা তৈরি করেই উঠতে পারেননি যে, কোন নির্দেশে সজাগ হবেন আর কোন নির্দেশে আতঙ্কিত হবেন ! আসলে ভারত সরকারের পিছনে বা ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলোর সরকারের পিছনে তাই হয়তো ‘বাহাদুর’ ( ব্যঙ্গার্থে নয় নিশ্চয়ই – কে জানে ? ) শব্দটি যুক্ত হয়েই আসছে, কবে থেকে কে জানে ।
রাজনৈতিকভাবে সামাজিক দর্শন বা আর্থসামাজিক দর্শন করতে চাইলে – সরকার বাহাদুরই বটে । বিশেষ করে আজকের প্রেক্ষাপটে । পাঁচ বছর পূর্ণ ক্ষমতা চালনার পরে পূর্ববর্তী ‘বাহাদুর’ সরকার নতুন করে জনমতের ভিত্তিতেই সরকার গঠন করেন । এটা একদিকে যেমন সত্য সত্যই বাহাদুরি ঠিক উল্টে-পাল্টে দেখলে বর্তমান সরকার বীরত্ব দেখানোর জন্য নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েই ঐতিহাসিক ‘নাগরিকতা প্রদান আইন’ প্রণয়ন করে ফেললেন এক লহমায় । দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৭৩ বছর পরে দেশের মানুষকে নাগরিকতা দিতে চাইলেন বিশেষ করে চাইলেন ‘অ-মুসলিম’ নাগরিকদের স্বার্থে । সরকার বাহাদুরের চিন্তার ভাজ পড়ছিল, কারন পরিসংখ্যানবিদরা জানান দিচ্ছিলেন যে ভারতে আগামী তিন চার দশক পরেই নাকি সংখ্যার বিচারে অহিন্দুরা ( আমি বলি অ-সনাতনরা ) সংখ্যা লঘিষ্ঠ হয়ে পড়বে । কে জানে, কোন ক্যালকুলেটরে এই হিসেব করা হয়েছে! কারণ, সত্তর বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরেও যেখানে অমুসলিম আরো পরিস্কার ভাবে বললে হিন্দুরা ( সনাতনপন্থীরা ) গত সেন্সাস ( ২০১১ ) অনুযায়ী প্রায় আশি শতাংশের কিছু কম আর মুসলিম মাত্রই ১৫ শতাংশের কিছু কম । কোন মায়াবলে বা কোন ক্যালকুলেটর যে এই সংখ্যাকে মাত্রই দুই তিন দশকে উল্টেপাল্টে দেবে সেটি মাথায় ঢুকল না । সরকারের বাহাদুরিই বটে ।
শুরু হল সাড়া ভারত জুড়েই তীব্র আন্দোলন । আন্দোলনে বাহাদুর সরকারের কোনো উপায়ান্তর নেই দেখে শুরু হল পাল্টা আন্দোলন । মনে পড়ে যাচ্ছে ষাটের দশকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসের কথা । পাকিস্তান সরকার বাহাদুর যখন দেখেছিলেন যে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাঙ্গালী জাতি-সত্তার তীব্র লড়াইকে কোনোভাবেই রোধ করা যাবে না, তাই তখন শুরু হয়েছিল ‘গুপ্ত বুদ্ধিজীবী’ হত্যা । সেখানে সহযোগী ছিল রাজাকার বাহিনী ও মৌলবীতন্ত্রের ধারক বাহকরা । আসলে সরকারী বাহিনী আর তার সাথে যদি যুক্ত হয় রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য সরকার অনুমোদিত দলের ক্যাডার বাহিনীর আক্রমণ ‘মাথায় ছোটো বহরে বড়ো’ সন্তানেরা তখন হয় তল্পিবাহক হয়ে পরে নচেৎ সংখ্যায় নগন্য হয়ে পরায় সেই আন্দোলন চলে যায় ‘লাশ কাটা ঘরে’, যেখান থেকে কোনো শব্দ আর বাইরে আসবে না ।
নাগরিকতা আইন, শাহিনবাগ আন্দোলন, নির্ভয়া কাণ্ডে যুক্ত অপরাধীদের ফাঁসি স্থগিতের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে বন্ধ করে দেখুন আমরা কেমন করে নতুন আন্দোলন শুরু করছি এখন – মেয়েদের ‘মাসিক’ বা ‘পিরিয়ডের’ সময়কালে মেয়েদের ঘরে আটকে রাখো, বেরোতে দিয়ো না, কারন তারা অশুচি । একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে ফিরে চলেছি অন্তত মানসিকতায় সেই মধ্যযুগেই । সরকার তো বাহাদুর বটেই । কি বলেন পাঠক আপনারা ?
সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় দেখুন আন্দোলনরত পরিবারগুলোকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে, আন্দোলনরত কেন্দ্রীয় সরকার বিরোধী দলগুলোর সরকারকে রীতিমতো ভয় দেখিয়ে ( পুলিশ কমিশনারকে গ্রেপ্তার করা হবে না এই আশ্বাসবাণী, যুবরাজকে সি বি আই দিয়ে ঘাটানো হবে না এই আশ্বাসবাণীতে ) সরকারগুলোকে নিজের করে নেওয়া – নতুন ভয় মধ্যপ্রদেশের কমলনাথের সরকারের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সরকারকে সংখ্যালঘিষ্ঠ সরকারে পরিণত করে সরকারের পতন ঘটিয়ে দেওয়া হবে । কানাইয়াকুমার, ঐশী ঘোষরা দেশদ্রোহী – এইটুকু ভয়েই চুরি পরে ফেলেছেন ইয়েচুরির দল, যদি তাদেরকেও দেশদ্রোহী মামলায় জেলে নেওয়া হয়, তাই ? আসলে বেনিয়ার দেশে কমিউনিজম করা নায়কেরা যে বিলাসব্যসনেই ব্যস্ত থাকবেন এটাই স্বাভাবিক, ভাগ্যিস প্রমোদবাবু, সরোজবাবু, ডাঙ্গেরা আজ বেঁচে নেই – হয়তো ওনারা এই কমিউনিস্ট রূপ দেখলে দলটাই থাকত না, তুলেই নিতেন হয়তো তারা । ব্যাস – বাহাদুর সরকারের বাহাদুরিতে পক্ষ এবং গদি আঁকড়ে থাকার লোভী বিপক্ষও কেমন করে যেন স্তাবকে পরিণত হয়ে যায় । সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ !
দেশবাসী যাতে নতুন করে আন্দোলনে জড়িয়ে না পরে তাই এই ‘করোনা ভাইরাস’ বা ‘Noval Corona Virus’ আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়ে মানুষকে ঘরবন্দী করে দেওয়া । অথচ, এই লেখা লিখছি সময় পর্যন্ত প্রায় ১৩০ কোটি দেশবাসীর মধ্যে মাত্রই ৬২ জনের দেহে এই ভাইরাস ধরা পড়েছে । সূত্র – https://www.businesstoday.in/latest/trends/coronavirus-outbreak-india-italy-iran-china-total-confirmed-cases/story/397950.html সময় BusinessToday.In New Delhi Last Updated: March 11, 2020 | 12:39 IST ।
মাভৈ সরকার বাহাদুর । পিছিয়ে চলুক আমার দেশ, মহান দেশ ভারতবর্ষ – হয়তো গোচরে অগোচরে আমরা রয়েই গেলাম বেঁচেবর্তে – কিন্তু এই ফাঁকে বিক্রি হল কোটি কোটি ‘ফেস মাস্ক, কোটি কোটি স্যানিটাইজার বোতল, সাথে হয়তো আনুষঙ্গিক আরো অনেক কিছু । বেনিয়ার দলকে পাইয়ে দেওয়াটাই তো আজকের সরকারের বাহাদুরিতা – সুতরাং দুই হাত তুলে আমরা চলুন নাচি – সরকার বাহাদুরই বটে । ‘দড়ি ধরে মারো টান’ বলা যত সহজ ফ্যাসিস্ট আক্রমণে ততটাই সহজ মৃত্যুকে বরণ করা । সকলে আতঙ্কিত হয়ে থাকুন বসে ঘরে – আমি দীন-দরিদ্র মানুষ এক, আমি রইলাম রাস্তায় – ফ্যাসিস্ট সরকারের হাতে মরা আর ‘করোনা’ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা পড়া দুটোই তো মৃত্যুই ।
অমোঘ কালের নিয়মে বয়ে চলুক সময় – আমি চল্লুম মৃত্যুকে আহ্বান করতে আতঙ্কিত হয়ে ঘরে বসে না থেকেই রাস্তাতেই ।