• Uncategorized
  • 0

প্রবন্ধে স্নেহাশীষ চক্রবর্তী

স্পর্শকাতরতা

পৃথিবীর সবচেয়ে স্পর্শকাতর বস্তুটি কী ? বস্তু ? না এটা কোন বস্তু নয় । আবার সব বস্তুর ঊর্ধ্ব রয়েছে সম্পর্ক নামক শব্দটি । বস্তুময় এই পৃথিবীতে সম্পূর্ণ আপেক্ষিক অবস্তু হল সম্পর্ক । পিতা-মাতা, পিতা-পুত্র, মাতা-কন্যা এইসব সম্পর্কগুলোতে জিনতত্ত্ব ( Genetics ) এমন এক আবেগময়তার স্পর্শ দিয়ে রেখেছে যে, এই সমস্ত সম্পর্কগুলো প্রায় অ-ভঙ্গুর । কিন্তু স্বামীর সঙ্গে স্ত্রী’র সম্পর্কে না রয়েছে কোনো জিনতত্ত্ব, না রয়েছে কোনো এমন অবস্তু বা বস্তু, যার শক্ত আঘাতেও এই সম্পর্ককে ভাঙ্গতে পারে । আবার এই স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্কগুলো স্বচ্ছ কাঁচের মতো, উভয়ে উভয়কেই দেখতে পায় অদর্শনের মধ্যেও । এতই স্পর্শকাতর এই সম্পর্ক যে, অতি এক ক্ষুদ্র আঘাতও এই সম্পর্ককে মূহুর্তে ভেঙ্গে খানখান করে দেয়, যা শত চেষ্টাতেও জোড়া লাগে না আর ।
কেন এতো ঠুনকো এই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ? যা সবচেয়ে বলিষ্ঠ হয়েও সবচেয়ে দুর্বল । পৃথিবীর সমস্ত আঘাত সয়েও এই সম্পর্ক বয়ে চলে যুগ থেকে যুগান্তরে, কাল থেকে কালে, দশক থেকে প্রায় শতকের অভিমুখে । পৃথিবীর যাবতীয় আণবিক – পারমাণবিক – রাসায়নিক শক্তিসমূহের সমষ্টির আঘাতেও যা অ-ভঙ্গুর । আবার মাত্র একটা শব্দ ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ ‘র বিন্দুমাত্র স্খলনে মূহুর্তে এই সম্পর্ক ভেঙ্গে চুরমার । দেশ, কাল, স্থানভেদে এই ভঙ্গুরতাকেই হয়ত বয়ে নিয়ে চলে দুটি প্রাণ, কিন্তু তা কি আগের মতো তত শক্তিশালী আর থাকে । থাকে না বোধহয় ।
তাহলে এটা প্রমাণিত ধরে নেওয়া যায় যে, পৃথিবীতে মজুদ সমস্ত আণবিক – পারমাণবিক – রাসায়নিক অস্ত্রসমূহের সমষ্টির আঘাতেও পৃথিবীর বলিষ্ঠতম সম্পর্ক, স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্কে চূর্ণ করা যায় না । দেশর পর দেশ উজাড় হয়ে যায়, তবু দুর্ভিক্ষপ্রপীড়িতের মতো দুটি আত্মা এক আত্মায় পরিণত হয়ে লড়াই করে চলে শুধুমাত্র ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ নামক একটিমাত্র শব্দকে অবলম্বন করে । স্বাভাবিক মৃত্যু ছাড়া দেহের ও মনের এই সম্পর্ককে বিনষ্ট করা যায় না ।
কী এই ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ ? সম্পূর্ণ চেনা বা অচেনা দুটি নারী-পুরুষ যখন নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসে একে অপরকে, যেখানে চাওয়া-পাওয়ার সম্পর্ক গৌণ, একে অপরের মন চিনে নেয় নিজের মতো করে । এই সম্পর্কে উভয়ের শুধু দেওয়ার পালা, নেই কোনো আড়ষ্টতা, আছে শুধু অকৃত্রিম ভাল লাগানো, একের ভাল লাগায় অপরের সে কী স্বর্গীয় আনন্দানুভূতি, যেটা শুধু বোধের অনুভূতি, ভাষা প্রকাশে যা বেরিয়ে আসতে পারে না । এই সম্পর্কে নেই কোনো আবেগ, আছে শুধু কঠিন লড়াই, সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ । অথচ, মাতা-পুত্রের মতো কোনো চেনা সম্পর্ক নেই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে । সম্পূর্ণ-দুটি অচেনা প্রাণ জড়িয়ে ধরে একে অপরকে এবং অঙ্গীকার করে বেঁচে থাকার, বাঁচিয়ে রাখার, আর দিয়ে যায় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে আবার এই একই সম্পর্কের দ্বারা পৃথিবী হয়ে ওঠে বর্ণময় ।
বর্ণময় এই চরিত্র দুটিতে একমাত্র বলিষ্ঠ শব্দ-বন্ধ হচ্ছে ‘স্পর্শকাতরতা’ ও ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’, আবার শব্দবন্ধদুটিই বোধহয় হচ্ছে এর সবচেয়ে বড় শত্রু, যার বিন্দুমাত্র স্খলন মূহুর্তেই দুটি চরিত্রকে নিয়ে চলে যায় এমন দুটি প্রান্তে, যা সমান্তরাল সরলরেখার গতিতে চলতে থাকে ঠিকই কিন্তু আর কোনও দিনও মেলার নয় এই সম্পর্ক । পৃথিবীর সমস্ত সমাজে এবং দেশেই কিন্তু এই সম্পর্কটা একইরকম । যদিও পশ্চিমী দুনিয়ায় খোলামেলা জীবন যাপনের সুবাদে এই সম্পর্কগুলোর গভীরতা এখন অনেকটা শিথিল । কর্ম ও ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে ঐ শিথিলতার জন্ম দিয়েছে । অথচ প্রাচ্যের দেশগুলোতে যথা – ভারত, বাংলাদেশ, ফিলিপাইন্স, থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশে স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্কটা এখনও যথেষ্ট শক্ত বাঁধনে বাঁধা । যার একমাত্র মূলমন্ত্র হচ্ছে ‘স্পর্শকাতরতা’ এবং ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ ।
বেঁচে থাকুক এই স্পর্শকাতরতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা এবং আগামী ভবিষ্যৎকে দিয়ে চলুক সুন্দর সুন্দর আরও সম্পর্ক । এই সম্পর্কের মধ্যের ভুল বোঝাবুঝিগুলো এবং চরমতম আঘাতগুলোও যেন কখনও স্পর্শকাতরতা এবং বিশ্বাসভঙ্গের গণ্ডী না ছাড়ায় । তবেই পাওয়া যাবে বিশ্বজনীন সর্বাঙ্গসুন্দর এক পৃথিবী এবং স্পর্শকাতরতার ঔজ্জ্বল্যে তা থাকুক চির-ভাস্বর হয়ে ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।