অল দা নিউ জেন নামে একটি কম্পিউটার গেম আছে যার শুরুতেই খেলুড়েকে প্রশ্ন করা হয় আপনি কে? পুরুষ, নারী না এর কোনটাই না (নাইদার)? উত্তরটি নাইদার হলে কোন সমস্যা নেই, দিব্যি খেলায় ঢুকে পড়া যায়। কিন্তু প্রথম দুটি উত্তর দিলেই গণ্ডগোল। অনন্ত এক লুপে আটকে যেতে হবে অমনি, কিছুতেই খেলায় জায়গা পাবে না খেলুড়ে। মাঠ থেকে ফিরে আসতে হবে মন খারাপ নিয়ে।
এই খেলাটা কিন্তু কেউ নিছক মজা করার জন্যে বানায়নি, এটা একটি তত্ত্বের ফসল, যার নাম সাইবারফেমিনিজম। যাকে বলা যায় ইন্টারনেটের দুনিয়ায় নারীর নিজস্ব স্বর খোঁজার একটি উদ্যোগ। বাস্তব জগতের পিতৃতান্ত্রিক পরিকাঠামোর বিপরীতে একটি বিকল্প লিংগনিরপেক্ষ সম্পর্কের সন্ধান।
সভ্যতার শুরু থেকে বিজ্ঞান-প্রজুক্তির যে অগ্রগতি, তার বিবর্তনের দিকে চোখ রাখলে আমরা দেখব, সেখানে প্রথম কয়েক শতাব্দী জুড়ে কেবল বাহুবলেরই আধিপত্য। দানবিক চেহারার সব যন্ত্র, তা চালাতে প্রয়োজন পুংবল। মেয়েরা সেখানে নন-এন্টিটি। আমাদের শিল্পসাহিত্যেও তাই। যন্ত্র মানেই পুরুষ, যে শারীরিক বলে বলীয়ান, যার হাঁক ডাক প্রতাপ প্রচুর, প্রয়োজনে যে প্রকৃতিকে যথেচ্ছ লুণ্ঠন করতে পিছপা নয়। সে যেন ‘মুক্তধারার’ কারিগর বিভূতি, যার বাঁধ বিপন্ন করে চাষিদের জীবিকা, তবু বিভূতির গর্ব – মানুষের কান্নায় তার যন্ত্র টলে না। আর মুক্তধারার স্রষ্টা তো শিউরেই উঠেছিলেন ভারীশিল্প নির্ভর জাপানের দানবিক চেহারা দেখে। ‘এ তো লোহার জাপান। আঁকাবাঁকা বিপুল দেহ দিয়ে সে যেন সবুজ পৃথিবীটাকে খেয়ে ফেলছে’ । এই কায়িক শ্রম নির্ভর প্রজুক্তির জগতে মেয়েরা এতদিন ছিল ব্রাত্য, উদভাবক হিসেবে তো বটেই, গ্রাহক হিসেবেও। কলের সঙ্গে মেয়েদের বরাবরের তাই ভাশুর ভাদ্দরবউয়ের সম্পর্ক। গিরিবালা দেবীর ‘রায়বাড়ি’-র ঠাকুমা তাই দেশলাই কাঠিকে এড়িয়ে চলেন। হাওয়া কল বাড়ির অন্দরে উঁকি মেরে মেয়েদের আব্রু নষ্ট করছে- এই অজুহাতে হাওয়া কল তুলে দেওয়ার জন্যে মামলা করেন জনৈক গোকুল ঘোষাল।
কিন্তু চিরকাল তো এই ভারি চেহারার শ্রমনির্ভর যন্ত্র টিকল না, ধীরে ধীরে এল মেধানির্ভর প্রযুক্তি। রবীন্দ্রনাথ ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ভবিষ্যতের প্রযুক্তিতে পুরুষালি বলের জায়গা নেবে নারীর ধী ও মেধা, ভারের বদলে আসবে ধার আর ভয়ংকর বিশালত্বের জায়গা নেবে স্বল্প আয়তনের সৌন্দর্জ।
‘একদিন যে জয়ী হবে তার আকার ছোট, তার কর্ম প্রণালী সহজ, মানুষের হৃদয়কে, সৌন্দর্জবোধকে, ধর্মবুদ্ধিকে সে মানে, সে নম্র, সে সুশ্রী, সে কদর্জভাবে লুব্ধ করে না, তার প্রতিষ্ঠা অন্তরের সুব্যবস্থায়, বাইরের আয়তনে না, সে কাউকে বঞ্চিত করে বড় নয়। সে সকলের সঙ্গে সন্ধি করে বড়’
বেগম রোকেয়ার লেখা বাংলা ভাষার প্রথম কল্পবিজ্ঞান ‘সুলতানার স্বপ্ন’ –এর নারীস্থানের সারার মুখে এর প্রতিধ্বনি – ‘ কেবল শারীরিক বল হইলেই কেহ প্রভুত্ব করিবে, ইহা আমরা স্বীকার করি না’
এসব ভাবনা বাস্তবায়িত হতে সময় লাগল, কিন্তু হল। ধীরে ধীরে যন্ত্রের চেহারার পরুষতা কমে এল, অনেক যন্ত্রই চলে এল মেয়েদের নাগালে। আর এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল কম্পিউটার। সেলাইকল আর টাইপরাইটারের পর মেয়েরা যে যন্ত্রটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে থাকে। প্রথম আধুনিক কম্পিউটার এনিয়াক বসান ছিল কয়েকটা ঘর জুড়ে। অজস্র তার লাগিয়ে তাকে চালাতে হত। ভারি জটিল সেই কাজ। সেখান থেকে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আজকের হাতের নাগালে ডেস্কটপ, ল্যাপটপে পৌঁছন। আর সেই কম্পিউটারের হাত ধরেই এল সাইবার ফেমিনিজম, সাইবার স্পেসের সঙ্গে নারীর সম্পর্ক নিয়ে যে তত্ত্বের উদ্ভব।
যে মেয়েরা এতদিন কেঁদে ককিয়ে এক চিলতে নিজের ঘর পায়নি, তাদের জন্য অপরিসীম গুরুত্ব এই সাইবার স্পেসের। সাইবার শব্দটি প্রথম পাওয়া গেল ১৯৮৪ সালে উইলিয়াম গিবস্নের নিউরোম্যান্সার উপন্যাসে। আর সাইবার ফেমিনিজম শব্দটি প্রথম আনলেন অস্ট্রেলিয়ার ভি এন এস ম্যাট্রিক্স ১৯৯১ সালে সাইবার ফেমিনিস্ট ইস্তাহারে। এর সংজ্ঞা দিলেন ক্যারলিন গুয়ার্টিন-
সাইবার ফেমিনিজম হচ্ছে অস্তিত্ব, লিঙ্গ, শরীর এবং প্রযুক্তির পারস্পরিক সংযোগ ও ক্ষমতার সমী করণের সঙ্গে তাদের স ম্পর্ককে বুঝে নেবার একটি পথ। এর উদ্ভব ১৯৯২ সালে বিশ্বের তিনটি প্রান্তে একই সঙ্গে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া আর ব্রিটেন। কানাডাতে ন্যান্সি প্যাটারসন লিখে ফেললেন সাইবারফেমিনিজম বলে একটি নিবন্ধ, অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে চার সদস্যের ভি এন এস ম্যাট্রিক্স লিখলেন সাইবারফেমিনিস্ট ম্যানিফেস্টো যার উদ্দেশ্য – “to insert women, bodily fluids and political consciousness into electronic spaces.” একই বছরে ব্রিটিশ কালচারাল থিওরিস্ট স্যাডি প্ল্যান্ট পশ্চিমী সমাজে প্রযুক্তির ওপর নারীর প্রভাব নিয়ে কথা বলার সময় ব্যবহার করলেন সাইবারফেমিনিজম শব্দটি।
আর এই যে তত্ত্বটি , তা নেহাত ভূঁইফোঁড় নয়। ৮০ র দশকে সাইবারপাংক সাহিত্যের ছড়াছড়ি আর তাতে বড় বেশি পুরুষালি দাপট। সেই যে ধুয়ো – Toys for boys. এরই প্রত্যুত্তর হল সাইবারফেমিনিজম। আর এর প্রধান প্রেরণা ডোনা হ্যারাওয়ে। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত নিবন্ধ – ‘ আ সাইবর্গ ম্যানিফেস্টোঃ সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড সোশালিস্ট ফেমিনিজম ইন দা লেট টোয়েন্টিন্থ সেঞ্চুরি’ যা এই তত্ত্বের ভিত গড়ে দেয়। এর আরও কয়েকজন রূপকার ছিলেন – অ্যাভিটাল রনেল, স্যাডি প্ল্যান্ট, স্যান্ডি স্টোন প্রমুখ।
সাইবার ফেমিনিস্ট শিল্পী ফেইথ ওয়েল্ডিং বললেন “If feminism is to be adequate to its cyberpotential then it must mutate to keep up with the shifting complexities of social realities and life conditions as they are changed by the profound impact communications technologies and techno science have on all our lives. It is up to cyberfeminists to use feminist theoretical insights and strategic tools and join them with cybertechniques to battle the very real sexism, racism, and militarism encoded in the software and hardware of the Net, thus politicizing this environment”
আসলে যখন নব্বইয়ের দশকে কয়েকটি মার্কিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের গণ্ডি ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল ইন্টারনেট, তখন হাতের নাগালে কম্পিউটার ছিল যেসব মেয়েদের তারা নতুন এই ক্ষমতা-জংগ্মতার গুরুত্ব বুঝতে পারলেন। হাতে হাতে ধরাধরি করে তাঁরা হয়ে উঠলেন সাইবার-সহচরী। তবে এ ধরা স্পর্শাতীত আলিঙ্গনের মতোই। একই সঙ্গে আন্দোলন শুরু হল কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ব্রিটেনে। এর প্রথম আন্ত র্জাতিক আলোচনা চক্র হল ১৯৯৭ সালে জার্মানিতে।
‘মেয়েমানুষের বিদ্যাচর্চা পাপ হতে পারে না, কারণ মা সরস্বতী নিজেই মেয়েমানুষ’ বলেছিল ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’-র সত্যবতী। তবু চিকনের উল্টোকাজের অন্দরের অন্ধকার দূর হতে চায় না। কি এদেশে , কি বিদেশে। এদেশে যদি কাঁথাকানি আর হাতাখুন্তি, ওদেশে তবে মোজা বোনা, পিয়ানো বাজানো আর পুডিং বানানো। শার্ল্ট ব্রন্টির জেন আয়ার ভেবেছিল এইসব তুচ্ছ কাজেই কি শেষ হয়ে যাবে মেয়েদের জীবন?
এই হাতাখুন্তি আর উল কাঁটা থেকে ব্ল্যাকবেরি, মাউস – এই উল্লম্ফন কিন্তু একদিনে হয়নি। এর পেছনে রয়েছে দু-দুটো বিশ্ব যুদ্ধ, ইন্টিগ্রেটেড চিপ্সের উদ্ভাবন, দূর- যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতি এবং নব্বইয়ের দশকে তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ফোরণ, যার ফলে পার্সোনাল কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল ইত্যাদি অনেক সস্তা হয়ে হাতের নাগালে চলে এসেছে। যে মেয়েরা সুবর্ণলতার মতো পাশের বাড়ির বৌটার মুখটুকুও না দেখে বই চালাচালি করেছে দেওয়ালের ছোট্ট ফোকরের মধ্যে দিয়ে, তাদেরই বকুল-উত্তর প্রজন্মের কাছে কখন যেন কম্পিউটারের সীমায়িত চতুষ্কোণ বিকল্প বিশ্ব হয়ে গেছে। সাইবার স্পেস তাদের দিয়েছে নিজস্ব জায়গার উষ্ণতা, এতদিন কোন গ্যাজেটই যা দিতে পারেনি।
নেট ব্যবহারে ইউএসএ ও কানাডায় সার্বিকভাবে এগিয়ে আছে মেয়েরা, বয়সের বিচারে ২৫-৪৯ বছর বয়সী মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে ইন্টারনেটে বেশি সময় কাটায়। ২৫-৩৪ বছর সীমার মেয়েরা ৫৫ % সময় কাটায় নেটে। তবে ছেলেরা যেখানে অফিসিয়াল কাজকর্ম সারে, মেয়েরা বেশি আগ্রহী সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এ। আর বিপদটা সেখানেই। সাইবার পর্নোগ্রাফির ফাঁদ শুধু নয়, টুইটার ফেসবুকে বডিশেমিং, ট্রোলিং –এর প্রধান লক্ষ্য মেয়েরা। সেলিব্রিটি থেকে সাধারণ গৃহবধূ –কে এর শিকার নয়? তবে এর থেকেও বড় বিপদ মনের। সাইবার স্পেসের সুবিধেগুলোই অনেকসময় বিপদ ডেকে আনছে। এই প্রথম এমন একটা মঞ্চ পেয়েছে নারী, যেখানে তার লিঙ্গ পরিচয় গৌণ। সে নারী না পুরুষ, বৃদ্ধা না যুবতী, ধনী না নির্ধ ন, শ্বেতাঙ্গ না কৃষ্ণাঙ্গ – সমস্ত ধরনের আত্মখর্বকারী পরিচয় গোপন রেখে সে এখানে শুধু একটা আইকন। নিজেকে আড়াল রেখে সে খেলে যেতে পারে মায়ার খেলা। এ খেলার রোমাঞ্চ আছে, কিন্তু মুশকিল হল বাস্তব অবাস্তবের টানাপোড়েনে তৈরি হচ্ছে নানা জটিলতা, বিভ্রান্তি এমনকি মনোবিকলনও। ডিজিটাল পার্সোনালিটি নারী পুরুষের প্রেম ও যৌনতায় নিয়ে আসছে প্রত্যাশা ভঙ্গের ঝুঁকি। সম্পর্ক ভাঙছে। ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে সামাজিকতা, টান পড়ছে সংস্কৃতির শিকড়ে। তবে এর চেয়েও বড় সমস্যা সাইবারস্পেসের ব্যাটালেপনা নিয়ে। অন্য প্রযুক্তিগুলোর মতোই সাইবার স্পেসও বড্ড বেশি মাচো।
এর পুরুষ পক্ষপাতিত্ব নিয়ে শেরি টার্কল বলেছেন
“The hackers would deny that there is a macho culture, the pre occupation with winning and of subjecting oneself to increasingly violent tests make their world peculiarly male in spirit, peculiarly unfreiedly to women”
প্রায় এক কথা বলেছেন ক্যান্ট্রোউইজ-
“Computer culture is created, defined and controlled by men. Women often feel about as welcome as a system crash.”
কেবলই জয় আর দমনের এই পুং ইচ্ছে কি মেয়েদের এখনো সাইবার স্পেসে অনেকটাই ব্রাত্য করে রাখেনি? অধিকাংশ কম্পিউটার গেমে নারী যৌন প্রতিমা ছাড়া আর কিছু নয়। দিন দিন তাকে ঘিরে ট্রোলিং ও আরও বিভিন্ন সাইবার ক্রাইম বাড়ছে। সাইবার দুনিয়ার দখল নিতে গেলে শুধু ইউজার নয়, আরও অনেক বেশি নারী-উদ্ভাবক চাই। মানে by the women for the women to the women.
এই মুহূর্তে ইন্টারনেট ব্যবহারে ইউ এস এ আর কানাডা ছাড়া আর কোথাও নারী সংখ্যাগরিষ্টতা পায়নি। উদ্ভাবকের সংখ্যা তো অতি নগণ্য। আর এই সময়ে সাইবারফেমিনিজম আন্দোলনও কেমন স্তিমিত হয়ে পড়েছে মনে হয়। কিন্তু এখনি তো দরকার ছিল নতুন তরঙ্গের। তেমন কিছু চোখে পড়ছে না কেন?
ভার্জিনিয়া উলফ বলেছিলেন লেখক হতে গেলে নিজস্ব রোজগার ও নিজস্ব ঘর চাই মেয়েদের। এখন জন্মালে তিনি নিজস্ব নেট কানেকশনও যোগ করতেন এই তালিকায়। তাঁর আরও একটা কথা মনে পড়ছে।
Women have served all these centuries as looking glass possessing the magic and delicious power of reflecting the figure of man at twice its natural size.
পুরুষকে দ্বিগুণ মাপে প্রতিফলিত করতে অভ্যস্ত সেই নারী কি আজ আবার সাইবার-মুক্তমঞ্চের নামে আটকে যাচ্ছে না নতুন আরও জটিল এক আয়নায়?