সাপ্তাহিক প্রকল্পশ্রীরিয়্যাল ধারাবাহিকে প্রকল্প ভট্টাচার্য (পর্ব – ৬ ।। প্রথম ভাগ)
by
·
Published
· Updated
নাম: পরিমলবাবুর পরিবারকথা
পর্ব ৬: সমাজসেবা
মুখ্য চরিত্র: পরিমলবাবু (বয়স পঁয়ষট্টি, ক্লার্কের চাকরি করে রিটায়ার করেছেন) পরমা (পরিমলবাবুর স্ত্রী, বয়স পঞ্চান্ন, গৃহবধূ) প্রসূন (ছেলে, বয়স ত্রিশ, আইটি ফার্মে চাকরিরত) জুঁই (পুত্রবধূ, বয়েস পঁচিশ, স্কুল টিচার) প্রীতি: (মেয়ে, বয়স পঁচিশ, কলেজে পড়ে) প্রিয়ম (নাতি, বয়েস সাত বছর, ক্লাস টু)
পরিমল- যাক, তাহলে প্রমীলা আসার পর গৃহশান্তি ফেরত এসেছে।
প্রসূন- তা যা বলেছ বাবা। এইজন্যই ওদের কাজের মানুষ বলা হয়। ওদের ছেড়ে কোনো কাজই ঠিকমতো হয় না।
পরমা- খালি আমায় খোঁটা দেওয়া, না? বুঝবে, বুঝবে, যেদিন আমি থাকবো না, সেদিন বুঝবে!
পরিমল- কী মুস্কিল! এখানে আবার তোমাকে কে খোঁটা দিল!
পরমা- আমি সব বুঝি!
প্রসূন- নাঃ, মনে হচ্ছে মায়ের মুডটা আজ অফ। অন্য কথা হোক। আচ্ছা প্রীতি, তোর সেই বন্ধুর খবর কী রে? অনেকদিন আসে না!
প্রীতি- কে রে দাদা? আনন্দ?
পরিমল- সত্যি তো! অনেকদিন আনন্দসংবাদ পাইনি! একি, এমন রসিকতা করলাম, কেউ হাসলে না যে!
প্রিয়ম- রসিকতা মানে কী দাদু?
পরিমল- রসিকতা মানে হলো গিয়ে, ওই কী যেন, হ্যাঁ, জোক!
পরমা- রসিকতা হলো এমন জোক, যেটা শুধু যে বলে সেই হাসে। আর কেউ না।
পরিমল- এই যাঃ, এইরকম বলতে নেই!
প্রিয়ম- হিহিহিহি
পরিমল- এই তো, প্রিয়মও হেসেছে! দেখলে! এবার বাকিরাও হাসবে।
প্রীতি- উফফ বাবা, তোমার এইসব রসিকতা খুব পুরোনো।
জুঁই- কিন্তু সত্যি, আনন্দদার কী খবর গো?
প্রীতি- ও মাঝে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিল, পরীক্ষার পর কাজকর্ম নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে।
পরিমল- ও বাবা, ও আবার পড়াশোনাও করে নাকি!
প্রীতি- বাবা, আনন্দ মেডিক্যাল পড়ছিল, এখন পাশ করা ডাক্তার।
পরমা- অ্যাঁ! ডাক্তার! মানে, সত্যিকারের!
প্রসূন- কখন পড়তো রে? সারাক্ষণ তো এখানে ওখানে ঘুরতো দেখতাম!
প্রীতি- না রে, ও সবকিছু করতো পড়াশোনার ফাঁকে।
পরিমল- দাঁড়া দাঁড়া! মানে ওই ক্রেডিট কার্ড, স্কুল কোওর্ডিনেটর, সব করতো ডাক্তারি পড়তে পড়তে!
প্রীতি- হ্যাঁ বাবা। ওর একটু রোগ আছে, সমাজসেবার। তাই একগাদা দায়িত্ব ঘাড়ে চাপায়, তারপর সামলাতে পারে না আর লোকেদের গালাগাল খায়।
পরিমল- এই যাঃ, আমি মজা করেছি বটে কিন্তু গালাগাল দিইনি কখনো!
প্রীতি- ওঃ কাম অন! তুমিও দেখছি মায়ের মতো সবকিছু তোমাকে বলা হচ্ছে ভেবে নিচ্ছ। বুঢঢা হয়ে যাচ্ছ তোমরা।
পরিমল- এই, কাকে বুঢঢা বললি রে? বুঢঢা হোগা তেরা বাপ!
প্রীতি-বাপকেই তো বললাম!
প্রসূন- হাহাহাহাহা! বুঝলি প্রিয়ম, এটা হল রসিকতা।
জুঁই- আবার এইসবের মধ্যে প্রিয়মকে টানছো কেন? উলটে এই কথাটা তোমায় একদিন শোনালে ভালো লাগবে?
পরিমল- আচ্ছা আচ্ছা। বুঝেছি। তাহলে আমি আনন্দ ছেলেটাকে যে রকম ভাবতাম, আসলে ও সে রকম নয়। ধারণা বদলে গেল তো ওর সম্পর্কে!
পরমা- তুমি আর তোমার ধারণা। ছেলেটাকে ভালো করে না দেখেশুনে…
পরিমল- আরে, মানছি তো, ভুল হয়েছে! এবার কী করা যায় বলো সবাই!
পরমা- এক কাজ করা যাক। এই রবিবার ওকে দুপুরে বাড়িতে খেতে ডাকি। হাজার হোক, ছেলেটা ডাক্তারি পাশ করে গেল!
প্রসূন- খুব ভাল আইডিয়া! প্রীতি, ফোন লাগা এখনই!
প্রীতি- দেখি পাই কি না। কোথায় কোথায় যেন গ্রামেগঞ্জে ঘুরছিল… কী সব এক্সপিরিয়েন্স…
পরমা- কেন রে, আবার কী হলো?
প্রীতি- সে সব নাহয় ওর মুখেই শুনো… হ্যালো, আনন্দ? তুই কি শহরে আছিস? গ্রেট। শোন, এই রবিবার দুপুরে তোর নেমন্তন্ন আমাদের বাড়ি। কী? না না, কোনো অকেশন নয়, এমনিই। তোর ডাক্তারি পাশ করার অনারে, আর তোর সমাজসেবার এক্সপিরিয়েন্স শোনবার জন্য… হ্যাঁ, চলে আসিস, এই এগারোটা নাগাদ, ওক্কে? পরে কথা বলব, বাই!
—————- (রবিবার, খাওয়ার টেবিলে)
আনন্দ- আহা, কাকীমা, কতদিন পর এইরকম খাঁটি বাঙালি রান্না খাচ্ছি! মন ভরে গেল।
পরিমল- বাবা আনন্দ, কিছু মনে কোরোনা, আসলে আমি জানতামই না তুমি ডাক্তারি পড়ছ!
আনন্দ- কাকু, এতে আপনার কোনো দোষ নেই! আমার কলেজেত অনেক প্রফেসরও জানতেন না যে আমি ডাক্তারি পড়ছি! এত কম ক্লাশ করেছি, যে…
(সকলের হাসি)
প্রিয়ম- কাকু, এটা কি রসিকতা ছিল?
জুঁই- এই! কতোবার বলেছি বড়দের কথার মধ্যে কথা বলবি না!
আনন্দ- আহা বৌদি, বাচ্চা ছেলে! না মিস্টার প্রিয়ম, এটা দুর্ভাগ্যক্রমে একটা সত্যি ঘটনা ছিল।
পরমা- আর একটু ভাত দিই বাবা?
আনন্দ- ওরে বাবা, একদম না! এমনিতেই হাঁসফাঁস করছি, তার ওপর আমাকে আবার এখনই ছুটতে হবে!
প্রীতি- কোত্থাও যাবি না, বোস চুপ করে। তোকে কি এমনি এমনি ডেকে খাওয়ালাম নাকি! তোর গল্পগুলো শুনবো তো এবার!
আনন্দ- আহা, আমার আবার গল্প!
প্রসূন- ভাই, ওসব বিনয় টিনয় ছেড়ে শুরু কর তো শুনি!
পরমা- হ্যাঁ বাবা, শুনি তোমার অভিজ্ঞতা।
পরিমল- আজকালকার ছেলেরা তো সমাজসেবার নাম শুনলেই পালিয়ে যায়! তাদের মধ্যে তুমি তো উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হে! নাও, শুনি তোমার অভিজ্ঞতা।
আনন্দ- কাকু, সত্যি বলতে কি, ছোটবেলা থেকেই আমার সমাজসেবা করবার ইচ্ছে। বাবাকেও দেখতাম অন্যের কাজকর্ম নিয়ে সারাদিন চিন্তা করতে, আমারও আছে সেই রোগ। না, বরং বলি, ছিল।
জুঁই- ছিল কেন বলছেন? এখন নেই?
আনন্দ- বৌদি, নিশ্চিত হয়ে বলতে পারিনা যে এখনও আছে।
প্রসূন- কেন, কী এমন ঘটেছে শুনি?
আনন্দ- ঘটেছে তো অনেক কিছু। এক এক করে বলি? ডাক্তারি পাশ করে ভাবলাম, শহরে তো চিকিৎসার যথেষ্ট সুযোগ, বরং গ্রামে গিয়ে চেম্বার খুলি। টাকাপয়সা সকলে না দিলেও চলবে, মানুষ আগে সুস্থ হোক!
পরিমল- আহা, আহা! দেখেছ, কী সুন্দর ভাবনা!
আনন্দ- কাকু, কিন্তু প্রথম দিন যা হল, তা যদি আপনি শোনেন…
পরমা- আরে আমরা তো শুনতেই চাইছি!
প্রীতি- বেশী বোর না করে বলেই ফেল না!
আনন্দ- আচ্ছা। আমি ঘটনাটা অবিকল যেমন হয়েছিল, তেমনই বলছি। প্রথমদিন চেম্বারে বসেছি। আমার বন্ধুর গ্রাম। নতুন জায়গা, লোকজনকে বিশেষ চিনিও না। তারপর…
(ফ্ল্যাশ ব্যাক)
-ডাক্তারবাবু আছেন নাকি?
-হ্যাঁ আসুন, বসুন। কী হয়েছে?
-আর হওয়ার কি বাকি রইল! জানেন, পই পই করে বলেছিলাম অমন করিস না রে করিস না। শুনলো আমার কথা! তাই আমাকেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে আসতে হল।
-আপনার পায়ে ব্যথা?
-আরে না না, সে বয়সকালে একটু হয়। এলাম ওই সুবীরটার জন্যে।
-সুবীরবাবু কি এসেছেন আপনার সঙ্গে?
-আরে, সে আসলে তো হয়েই যেত! একটা কথাও কি শোনে! জানেন, ওর যখন দশ বছর বয়স ছিল, নেড়া ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে উঠেছিল। কত্তোবার বারণ করলাম, শোনেনি। ব্যাস, তারপর যা হওয়ার… কেউ বাঁচাতে পারলো না…
-বাঁচাতে পারলো না মানে! উনি মারা গেছেন?
-বালাই ষাট, মরবে কেন! সবকটা ঘুড়ি ভো-কাট্টা হলো! আমরা কেউ তো নেড়া ছাদে উঠিনি যে ওর ঘুড়ি বাঁচাবো! তখন থেকেই ও এইরকম।
-ওঃ, তা এখন উনি কেমন আছেন?
-কেমন আবার, নির্বিকার! নদের নিমাই এর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে! আরে, মাথায় ঢুকলে তো!
-না, মানে, ওনার কী হয়েছে জানতে পারলে…
-কিছুই হয়নি। উনি দিব্যি আছেন, যতো জ্বালা হয়েছে আমার।
-কোথায় জ্বালা? এদিকে আসুন, জিভটা দেখি।
-জিভ? না না, জিভে জ্বালা হোক শত্তুরের! জিভে জ্বালা করলে আমি এতক্ষণ আপনার সাথে বকে যেতে পারতাম?
-তা আপনার হয়েছেটা কী?
-এখনো হয়নি, তবে হবে। শরীর আনচান করবে, পেট খোলসা হবে না, ভুটুভাট করবে।
-ওঃ হো! এগুলো কি প্রতিদিনই হয়?
-হয় না, তবে হতেই পারে। যে কোনো দিনই।
-হুমমম। কতোদিন থেকে হচ্ছে?
-তা বছর দুয়েক টের পাচ্ছি।
-দু বচ্ছর! কোনো ডাক্তার দেখান নি!
-না, নিজেই একটা কাগজ পড়ে নিই, সেরে যায়।
-কাগজ… মানে? প্রেস্ক্রিপশন?
-আরে না না, খবরের কাগজ। সেটার জন্যেই তো!
-খবরের কাগজ!!! সেটার থেকে আবার কী অসুখ!
-আরে সক্কালবেলা খবরের কাগজটা পড়ে যা সুখ, সেটা হাতে না পেলে অসুখ করবে না! তা আমি ঐ সুবীরের কাগজটাই পড়তাম এতদিন। সে ব্যাটা আজ থেকে দিল কিনা কাগজ বন্ধ করে! কতোবার বলেছিলাম, ওরে কাগজটা বন্ধ করিস না, না পড়লেও, কত্তো কাজে লাগে… শুনলোই না কথা! তা আমি আর কি করি, চলে এলাম আপনার চেম্বারে। ডাক্তারবাবু, একটু আজকের কাগজটা দেবেন, পড়ি?