• Uncategorized
  • 0

“পুরুষ” নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় সুপ্রিয় চক্রবর্তী

এই দেশ-সেই দেশ

নাগরিকত্ব আমাদের জন্মগত অধিকার।সম্প্রতি নাগরিকত্ব নিয়ে বিস্তরজল ঘোলা হয়েছে, কিছু মানুষ ভয়ে দ্বারস্থ হয়েছেনসরকারের দ্বারা নিযুক্ত কর্তা ব্যক্তিদের, আর কিছু মানুষ তুমুল তর্ক-বিতর্ক করে গেছেন।যদিও করোনা এসে, আমাদের ওই দোলাচলের ম হাত থেকে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে, কিন্ত এটি সাময়িক, দীর্ঘস্থায়ী নয়।
বেশ কিছু মানুষ বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের কথা বলেছেন, কিন্ত তাহাদের কতজন উদ্বাস্তু অর্থাৎ আমাদের সম্বন্ধে জানে, সেই নিয়ে আমার অনেক সংশয়আছে।শুধু একটি অনুরোধ আমার, দয়া করে পরিযায়ী আর উদ্বাস্তুদের সমপর্যায়ে মাপবেন না, এই দুই গোষ্ঠীর সদস্যদের কষ্টের মাপকাঠি এক হলেও, ভৌগোলিক পরিধি আলাদা।
পিতৃদিবসে কি লিখবো, কিভাবে লিখবো, সেটা ভাবছিলাম।মনে হলো নিজের গল্প কিছুটা সংক্ষেপে লিখি, যে গল্পে পরিবারকে বাঁচানোর জন্যে নিজের অভিভাবকের নাম পরিবর্তন করতে হয়েছিল।১৯৪৬ সাল, অবিভক্ত ভারত তখন উত্তাল।বাংলাদেশের বরিশালের একছোট্ট গ্রামে আমাদের বাড়ি, যৌথ পরিবার, আনুমানিক প্রায় তিরিশ সদস্য।বিপুল জমিজমা, নিজেদের দুর্গা মন্দির, বাগান, এবং গ্রামের সব থেকে উঁচু বাড়ি নিয়ে বেশ ভালোইছিলাম।আমার খুড়তুতো ভাই পরাণের দস্যিপনার একমাত্র সাথী আমি,নাবালক হয়েও সে কোনো সময়পাত্রী দেখতে হাজির হয় মন্ডা-মিষ্টির লোভে, আবার কোনোদিন পাশের বাড়ির কলা বাগানে ঢুকে লুকিয়ে থাকে।গ্রামের কেউ কিছু বলেনা আমাদের, কারণ আমরা তাদের ছোট কত্তা (কর্তা নয়, তখন গ্রামের মানুষ কত্তা বলতেস্বচ্ছন্দ বোধ করতেন), গ্রামের সব থেকে ধনী ব্রাহ্মণ পরিবারের সদস্যদেরকেই বাকি বলবে।
রোজ নিয়ম করে দেখতাম জ্যাঠামশাই দালানে বসে জমি-জমার হিসেবে করতেন, খাজনা আদায় করতেন।বহিরাগতদের বাড়িতে প্রবেশ করতে হলে, জুতো খুলে আসতে হতো, এমন কি বাড়ির সামনের নিজেদের দুর্গামন্দির পার করার সময়সব গ্রামবাসী জুতো খুলে হাতেনিয়ে নিতেন।বেশ ছিল সেইদিনগুলো, পাঠশালায় যাওয়ার প্রয়োজনছিলনা, কারণ সবভাই বোনদের জন্য নিযুক্ত ছিলো দুজন মাষ্টার।তাদের ভরণ পোষনের দায়িত্বআমাদের পরিবারের।
একভাগ-চাষী এসে একদিন আমার জ্যাঠামশাইকে বললো, “বড় কত্তা বাড়িটা ছাইড়্যা দ্যান, এরপর আর ভালো দাম পাবেননা, সময় থাকতে থাকতে পালায় যান।”নিয়মমাফিক সেই চাষীনবড়কত্তার কাছে চড় খেলেন, তাকে খোয়াতে হলো তার ভাগের জমি|বেশ কিছুমাস অতিক্রান্ত হলো, চোদ্দো বছর বয়সে বাতাসের উষ্ণতা মাপার ক্ষমতা আমার ছিলনা।প্রথম মাঝরাতে ঘুম ভাঙলো, যেদিন গ্রামের বেশ কিছু ব্রাহ্মণপরিবারের ধানের গোলায় আগুন দেখতে পেলাম।পরের কয়েক সপ্তাহে কিছু মানুষের প্রাণ গেলো, কিছু নারীর অবমাননার সাক্ষীথাকলো আমাদের সেই ছোট্ট গ্রাম।জলপথে নৌকা নিয়ে পাড়ি দিলাম আমরা, সাথে অন্তঃসত্ত্বা মা, দুই ভাই আর এক বোন।বরিশালের গ্রামের মানুষদের তখন নৌকোই ভরসা, কারণ পুরো গ্রাম ছিল সাতটি নদী দিয়ে ঘেরা।সাথে শুকনো খাবার, যা শেষ হতে শুরু করলো আস্তে আস্তে।একের পর এক নদী পেরোতে থাকলাম, দূরত্ব বাড়তে থাকলো আমার গ্রামের সাথে, একসময়এসে সব ঝাপসা হয়েউঠলো।
হালিশহর, বহরমপুর, মধ্যমগ্রাম, হাওড়া, একের পর একস্থান পরিবর্তন করতে হলো, প্রায় একবছর পর এসে পৌঁছলাম কলকাতায়।একবছর কাটলো আহিরীটোলার এক গুদাম ঘরে, পরে উল্টো ডাঙার আর এক গুদাম ঘর।১৯৪৮ সালে, হাওড়ায় থাকাকালীন, একটি উদ্বাস্তু সংশয়পত্র পেলাম,পরিবর্তন হলো অভিভাবকেরনাম, কারণ বাবা তখনো ঢাকায়, আসার চেষ্টা করছেন, চিঠি আসতো অনিয়মিত, চিঠির শেষে লেখা থাকতো – সদ্য ভূমিষ্ঠ ছোট ছেলেকে একবার দেখতে চান।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরোক্ত লেখাটি আমার ছেলের লেখা।উদ্বাস্তুদের কোনো নাম এবং ঠিকানা হয় না, সেই কারণে নিজের নাম প্রকাশকরলাম না।কোনো ধর্মের মানুষদের প্রতিআমার কোনো বিদ্বেষ নেই, কারণ প্রতিহিংসা একটি মানসিক রোগ, যার থেকে জন্ম নেয় টুকরো টুকরো দেশ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।