• Uncategorized
  • 0

“পুরুষ” নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় তপশ্রী পাল

সীমানা ছাড়ায়ে

অফিস থেকে ফিরে একা মন খারাপ করে বসেছিলো ঊর্মি। মাসীর ছেলের বৌভাত, অথচ যাওয়াই হবে না মনে হয়! কতো করে মাসী বলে গেছিলো – কিন্তু একা একা তেঘরিয়া থেকে সেই গড়িয়া যাওয়া কি মুখের কথা? অর্পণের এতো ট্যুর! কোন সময় যদি বাড়ি থাকে! ঠিক দিন বুঝে তিনি ট্যুরে হাওয়া! একা একা এই বড়ো ফ্ল্যাটটা যেন খেতে আসে ঊর্মিকে। আর সারাক্ষণ টেনশন হয়! রাতবিরেতে কোথায় না জানি অর্পণ ঘুরে বেড়াচ্ছে! যদি প্লেন অ্যাক্সিডেন্ট হয়! যদি ও অসুস্থ হয়ে পড়ে! যতো অহেতুক অসহ্য চিন্তা পেয়ে বসে ঊর্মিকে! দুশ্চিন্তা করা ওর একটা রোগের মতো। আর এমন হলেই শুকনো কাশি হতে থাকে। কোথাও স্থির হয়ে বসতে পারে না! তার মধ্যে আবার লোডশেডিং হয়ে গেলো! মোম জ্বালতে ইচ্ছে হয় না। রান্নার লোকটা রান্না করে চলে গেছে। রাত নটা বাজে। অন্ধকারে বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে ছিলো ঊর্মি!
হঠাত নীচে গেটের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো! অন্ধকারে একটা চেনা চেহারা! বাবা ঢুকছে না? হ্যাঁ! তাই তো! বিয়ের পর এখানে বছরখানেক হলো এসেছে ওরা। মেয়ের চিন্তায়, জামাই ট্যুরে গেলেই বাবা ছুটে আসেন সেই বেহালা থেকে। কিন্তু আজ তো বাবার গড়িয়া যাওয়ার কথা বাড়ির আর সবার সঙ্গে! বিয়েবাড়ি ছেড়ে এখানে চলে এসেছে?
তাড়াতাড়ি একটা মোম ধরিয়ে দোতলায় ফ্ল্যাটের দরজা খোলে ঊর্মি। বাবা ধরে ধরে কতো কষ্টে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছেন! দরজার সামনে এসে হাঁফাতে লাগলেন বাবা। এমন সময় আলোটাও জ্বলে উঠলো। বাবা গলগল করে ঘামছেন! তাড়াতাড়ি বাবাকে চেয়ারে বসিয়ে এক গ্লাস জল নিয়ে এলো ঊর্মি! বললো “তুমি সেই ছুটে এলে বিয়েবাড়ি না গিয়ে? মাসী খুব রাগ করবে। ইশ! এতো ঘামছো! সেই তিনখানা বাস চেঞ্জ করে আসা!“
বাবা আস্তে আস্তে বললেন “তুই একা থাকবি – এতো বড়ো ফ্ল্যাটে! তোর ভয় করবে হয়তো! তা ছাড়া কম বয়সী মেয়েদের এখন একা থাকা সেফ নয়। বিয়েবাড়িও যেতে পারবি না। আমার মনটা তোর জন্য ছটফট করলো। তুই না গেলে আমিও যাব না বিয়েবাড়ি! তোর মা আর ভাইকে পাঠিয়ে আমি এখানে চলে এলাম । দাঁড়া জামাটা ছেড়ে নিই। চল বাপে মেয়েতে গল্প হবে অনেক! আজকে তোর গানও শুনবো! অনেকদিন শুনিনি।“
কী আর বলবে? একগাল হেসে ফ্রিজে রাখা মিষ্টি আর আইসক্রিম বাবাকে দিলো ঊর্মি! বাবা খুব খেতে ভালোবাসেন, সেটা জানে ঊর্মি! বাবার এতো প্রেশার, কিন্তু এখনো আইসক্রিম দেখে ছেলেমানুষের মতো খুশী! বললো “এইটুকুতে আমার কী হবে? বেশী করে নিয়ে আয়! যা আছে শেষ করে যাবো আজ! আবার কবে খাওয়া হয় – হয় কি না –“
ঊর্মি চোখ পাকিয়ে বলে “তুমি আর শুধরোলে না বাবা! তোমার না হাই প্রেশার? আর খাওয়া হয় কি না হয় মানে? তোমাকে আরো অনেকদিন বাঁচতে হবে!”
বাবা কেমন মলিন হাসি হাসলো! বললো “না রে, আমার সময় ফুরিয়েছে। আর কথা না বাড়িয়ে গান শোনা! আমার প্রিয় ভজনটা শোনাতে হবে আজ!“
“ও! সেই ‘জগতমে জীবন হ্যায় দিন চার?’ আচ্ছা করছি।“
বাবা চোখে হাত চাপা দিয়ে শুয়ে চুপ করে শুনছেন – বৈরাগী ভৈরবের উদাস সুর ছড়িয়ে পড়ছে! অনিত্য জীবন আমাদের। তাই সততা, ভক্তি, মানবধর্মের সব কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে এই গান! গান শেষ হলে ঊর্মি দেখে বাবার চোখ দিয়ে জল পড়ছে! ছুটে আসে ঊর্মি, বলে “তুমি কাঁদছো?” বাবা শুধু বললেন “তুই বড়ো ভাল গাইলি! গানটা খুব সুন্দর।“
রাত বাড়ে। ঊর্মি বড়ো থালায় করে গুছিয়ে খাবার বেড়ে দেয় বাবাকে। এ বাড়িতে ভাড়া আছে ওরা টেম্পোরারি। কসবার ফ্ল্যাট রেডি হলেই ও দিকে চলে যাবে। অর্পণের বাড়ির কাছে। তাই এখানে আর নতুন ফারনিচার কেনেনি। খাটের ওপর কাগজ বিছিয়ে এক থালা থেকেই খেলো দুজনে, যেমন ছোটবেলায় ঊর্মি শুধু বাবার থালা থেকে খেতে চাইতো।
ঊর্মি বাবা অন্তপ্রাণ ছোটবেলা থেকে আর বাবাও তাকে গড়ে তুলেছেন নিজের সবটুকু দিয়ে। পড়াশোনায় ইঞ্জিনীয়ার হওয়ার সাথে সাথে গানবাজনা, আঁকা, লেখা সবদিকে তুখোড় ঊর্মি। ছোটবেলায় হাতের লেখা ভালো করার জন্য কতো খাতা যে বাবা ছিঁড়ে ফেলেছেন! পরীক্ষায় কোনদিন সেকেন্ড হওয়ার উপায় ছিলো না। ওর পরীক্ষার সময় রাত জেগে থাকতেন বাবা। পরীক্ষার হলের বাইরেও অপেক্ষা করতেন বড়ো পরীক্ষাগুলোর সময়। কাগজ থেকে কেটে রাখতেন সব কম্পিটিটিভ পরীক্ষার ডিটেল, সব চাকরীর পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি। মনে আছে রেডিও স্টেশনে, দূরদর্শন কেন্দ্রেও প্রথম নিয়ে গেছিলেন বাবা। আজ দুজনের আলোচনায় উঠে আসছিলো সেই সব পুরোনো দিনের কথা, কেমন চলছে ঊর্মির চাকরী জীবন, অর্পণের চাকরী। অনেক রাতে ঘুমোতে গেলো দুজনে। ততক্ষণে বিয়েবাড়ি না যাওয়ার দুঃখ ভুলে গেছে ঊর্মি। কোথায় উড়ে গেছে যতো দুশ্চিন্তা আর টেনশন। পরম শান্তিতে ঘুমোচ্ছিলো ঊর্মি। ভোরে হঠাত দরজার বেলের আওয়াজে ঘুম ভাঙলো। এতো ভোরে কে এলো? কাজের লোকের তো আসার সময় হয়নি! উঠে বাইরের দরজার দিকে চললো ঊর্মি।
পাশের ঘরে চোখ পড়লো। বাবা কোথায়! ভোরবেলা উঠেই অনেকসময় বাড়ি চলে যায় বাবা! নইলে অতদূর বেহালা ফিরতে বেশ দেরী হয়ে যায়। মাকে সকালে তরকারী কেটে সাহায্য করে বাবা, রিটায়ারমেন্টের পর থেকেই করছে। মা একা পেরে ওঠে না। বয়স বাড়ছে! কিন্তু অন্ততঃ ঊর্মিকে বলে তো যাবে! এককাপ চা না খেয়ে – একদিন না বাদই পড়তো তরকারী কাটা – ভাবতে ভাবতে আইহোলে চোখ রাখে ঊর্মি! ভাই! এতো সকালে! কী ব্যাপার? দরজা খুলতেই ভাই হন্তদন্ত হয়ে ঢুকে বলে “এক্ষুণি একবার তোকে যেতে হবে!” অবাক হয়ে ঊর্মি বলে “কোথায়? তুই এতো সকালে?” ভাই উৎপল বলে “আর কথা বাড়াসনি! কাল রাত্রে বাবার সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছিলো! মাঝরাতে হসপিটালে ভর্তি হয়েছে! মাথায় প্রচুর ব্লাড বেরিয়েছে! ডাক্তার বলেছে ক্লটিং ও আছে! আসার সময় দেখেছি একটু একটু জ্ঞান আছে – শুধু তোর কথা বলছে! দেরী হলে কোমায় চলে যেতে পারে –অর্পণ কোথায়?“
অবাক অবিশ্বাস নিয়ে ঊর্মি বলে “বাবা তো কাল রাতে আমার কাছে এসেছিলো! আমি একা ছিলাম, অর্পণ তো ট্যুরে! কী বলছিস তুই! আমি মাথা মুন্ডু বুঝতে পারছি না!” বলতে বলতে কেঁদে ওঠে ঊর্মি।
“শোন, বাবা শেষদিনও তাঁর কর্তব্য করে গেছেন!” ভাঙা গলায় বলে উৎপল।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।