আজ জীবনের শেষবেলায় এসে পরিমলবাবুর নিজেকে বড্ড একা মনে হয়। বছর পাঁচেক হলো স্ত্রী গীতাও পাড়ি দিয়েছেন না ফেরার দেশে। ছেলে-বৌমা-নাতনি সবাই নিজের মতো ব্যস্ত।
হ্যাঁ, এই ব্যস্ত শব্দটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল পরিমলবাবুর জীবনেও। সকালে উঠেই বাজার করা, তারপরেই অফিস। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর বাড়ি ফিরে, আবার খাতাপত্র নিয়ে বসা। একটুও সময় ছিল না নিজের জন্য, নিজের আপনজনদের জন্য। এই নিয়ে গীতাদেবী মাঝে মাঝে অনুযোগ করলেও, উনি মেজাজ দেখাতেন—“তোমাদের জন্যই তো এতো খাটি। তোমাদেরকে ভালো রাখাটাই তো সব। “
কিন্তু কোনোদিনও বোঝেন নি, শুধুমাত্র টাকাপয়সা বা জিনিসপত্রের চাহিদা মেটানোটাই সব নয়। জীবনের যে সময়টা উপভোগ করার ছিল, সেই সময়টা তিনি শুধুমাত্র কাজ আর ব্যস্ততার মধ্যেই কাটিয়েছেন। পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথেও তেমন সখ্যতা নেই তাই। এখন ছেলে মাঝে মাঝে বলে, পাড়ার মোড়ে যেখানে বয়স্ক ভদ্রলোকরা বসেন, আড্ডা দেন, সেখানে যেতে। কিন্তু ওনার কেমন যেন বাঁধো বাঁধো ঠেকে। এতবছর ধরে একই পাড়াতে থেকেও, কোনদিনও ওনাদের সাথে মেশেন নি। আজ নিজের একাকীত্বে ওনাদের সঙ্গী হতে নিজেরই লজ্জাবোধ হয়।
একদিন বিকেলে একাই বেরোলেন। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলেন স্টেশন চত্বরে। প্লাটফর্মের একেবারের শেষের বেঞ্চটায় বসে রইলেন। হঠাৎ করেই খুব ঝড় বৃষ্টি শুরু হলো। উনি বসেই রইলেন, বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়। সন্ধে গড়িয়ে রাত নেমেছে অনেকক্ষণ। বৃষ্টি থামার নামই নেই। এদিকে স্টেশনও ফাঁকা হতে শুরু করেছে। ওনার কাছে ছাতাও নেই। আর এতোদূর আসবেন সেটাও ভাবেন নি। তাই সঙ্গে কোনো টাকাপয়সাও আনেন নি। তা না হলে, কোনোরকমে স্টেশনের বাইরে এসে একটা টোটো, অটো বা রিক্সা করতে পারতেন। অগত্যা চুপচাপ বসেই রইলেন। বসে থাকতে থাকতে একটু ঝিমিয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ একটা ডাকে ওনার সম্বিত ফিরলো।
“বাবু, এখানে এমনি করে বসে! বাড়ি যাবেন তো? চলুন পৌঁছে দি।”
চশমার কাঁচটা মুছে নিয়ে, ওটা পরে, ভালে করে দেখলেন সামনে সতীশ দাঁড়িয়ে। উনি অফিসের কাজে আগে যখন বাইরে যেতেন আর রাতের ট্রেনে বাড়ি ফিরতেন, সতীশই তখন ওনাকে ওর রিক্সা করে বাড়ি পৌঁছে দিত।
ওনাকে অমন চুপচাপ তাকিয়ে থাকতে দেখে, সতীশ আবার বললো—“চলুন বাবু! বাড়ি দিয়ে আসি।”
উনি বললেন —“আমি টাকা আনতে ভুলে গেছি রে সতীশ।”
ও বললো—“এ আর এমন কি কথা বাবু। বাড়ি গিয়ে দিয়ে দেবেন খন! চলুন চলুন, রাত অনেক হলো।”
স্টেশনের বাইরে এসে রিক্সায় উঠলেন। সতীশ সেই পুরনোদিনের কথা বলতে বলতে এগিয়ে চললো। একবার ওর ঘরের চাল উড়ে গেছিল ঝড়ে। তখন উনি সতীশকে ওর ঘরে টালি লাগানোর জন্য টাকা দিয়েছিলেন। কথায় কথায় সেটাও বললো ও। শুনেই পরিমলবাবু বললেন —“তোর ওইসব কথা এখনো মনে আছে সতীশ? আমি তো ভুলেই গেছিলাম রে!”
সতীশ বললো—“হ্যাঁ বাবু! সেদিন আপনি আমার যা উপকার করেছিলেন, মরে গেলেও তা আমি ভুলতে পারবো না।”
উনি হেসে বললেন —“ধুর! ও আর এমন কি! তোর ঘরের সবাই ভালো তো?”
ও তখন বললো—“মেয়েটার বিয়ে হয়েছে বাবু। বৌ দু ঘরে কাজ করে। ছেলেটা আমার পড়াশুনা করতো। এখন টাকার অভাবে সেটা ছেড়ে দিয়েছে।”
উনি বললেন —“না রে, পড়াটা ছাড়তে দিস না। কষ্ট করে হলেও ওকে পড়াস। কিছু টাকাপয়সা আমি দেবোখন।”
এভাবে কথা বলতে বলতে ওনার বাড়ি এসে গেলো। উনি ওকে দাঁড়াতে বলে ভিতরে গেলেন। টাকার ব্যাগটা নিয়ে বাইরে এসে দেখলেন সতীশ চলে গেছে। ও টাকা না নিয়ে চলে যাওয়ায়,খুবই অবাক হলেন উনি। তারপর ভাবলেন কাল সকালেই ওর ঘরে গিয়ে রিক্সা ভাড়া আর ওর ছেলের পড়াশুনোর জন্য কিছু টাকা দিয়ে আসবেন।
ছেলে-বৌমা ওনার জন্য চিন্তা করছিলো দেখে উনি পুরো ঘটনাটা ওদেরকে বললেন। তারপর রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লেন।
ভোরে উঠেই তৈরী হয়ে নিলেন বেরোনোর জন্য। স্টেশনের কাছেই যে বস্তিটা ওখানেই সতীশের বাড়ি।টালির চাল হওয়ার পর ওর আবদারে একবার গিয়েছিলেন উনি। রাস্তায় এসে একটা টোটো নিয়ে সোজা চলে এলেন ওই বস্তিতে। ওর ঘরের সামনে এসে দেখলেন ওর বৌ উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে উনি একটু অবাক হলেন। আগেরবার এসেছিলেন তখন ও একমাথা সিঁদুর পড়েছিল। শাঁখা পলা পড়েছিল। আজ ওর কেমন বৈধব্য বেশ। খুবই অবাক হলেন উনি। ওনাকে দেখে সতীশের বৌ বললো—-“কাউকে খুঁজছেন বাবু?”
ওনাকে যে ও চিনতে পারে নি, সেটা উনি বুঝলেন।
আর চিনতে পারার কথাও নয়। একবারমাত্র একটু সময়ের জন্য এসেছিলেন।
উনি বললেন —“সতীশের খবর নিতে এলাম।”
ওনার কথা শুনে আঁচল দিয়ে নিজের চোখ মুছতে মুছতে ও বললো—“আজ দু মাস হলো বাবু, এক্সিডেন্টে ও… ” কথাটা শেষ হলো না ওর।
ওর কথা শুনে পরিমলবাবুর হাত-পা কাঁপতে লাগলো। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো এক শীতল স্রোত। অলীক আর বাস্তবের মেলবন্ধন ঘটাতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে গেলেন উনি। কাল রাতের ঘটনাটা তাহলে কি? সতীশের অতৃপ্ত আত্মা কি ওনার কাছে কোনো বার্তা পৌঁছাতে চেয়েছিলো? নাহ! ভাবতে পারছেন না আর। দুহাত দিয়ে চোখ-মুখ ঢেকে ফেললেন। মাথা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে কপালে। ওনাকে অমন বিধ্বস্ত দেখে সতীশের বৌ তাড়াতাড়ি একটা টুল এনে বসতে বললো। তারপর ওনার জন্য এক গ্লাস জল এনে দিলো। কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হলেন। তারপর বুঝলেন, কোনো কোনো ঘটনার কোনো ব্যাখা হয় না। সেগুলোকে শুধুই মেনে নিতে হয়। তাই কালকের রাতের কথা কিছুই বললেন না। ব্যাপারটা ওনার কাছেই ধোঁয়াশার মতোই রয়ে যাবে আজীবন। একটু পর সতীশের বৌকে বললেন—“তোমার ছেলে কোথায়? ওকে ডাকো।”
ও ঘরের ভিতর থেকে ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে এলো। ওকে দেখে পরিমলবাবু বললেন —“পড়াশুনাটা আবার শুরু কর বাবা। তোর পড়ার জন্য যা টাকা লাগে আমি দেবো।”
ছেলেটা বললো—“কিন্তু আপনি কে? আর টাকাই বা কেন দেবেন?”
উনি বললেন —“ধর, আমি তোর দাদু। সতীশ আমার ছেলে ছিল।”
ছেলেটা আর ওর মা দুজনেই এসে ওনার পা ছুঁলো। এক স্বর্গীয় আনন্দ উপলব্ধি করলেন উনি। মনে মনে সতীশকে কথা দিলেন—‘তোর ছেলের কোনোদিন কোনো অভাব হবে না আর। তুই যেখানে আছিস, ভালো থাক্!”