• Uncategorized
  • 0

পুরুষ দিবসে তৃষ্ণা বসাক 

প্রথম পুরুষ

স্নেহের তৃষ্ণা,
সত্যি আমি ডাক দিয়েছি স্মৃতির পদ্মপাতায়, দুঃখজলের টলোমলো আবেগ স্নেহের খাতায় । ভোর না হতে সূর্য রেখা পুবের পানে হাঁটে
 ঘন আঁধার ঘুচিয়ে আসে নিশুত রাতের মাঠে । ঢিলেঢালা পোষাক পরে বুড়ো অনিয়ম
 যাচ্ছে ভুলে কর্তব্য তার এমন মতিভ্রম!
 তাইতো কাজের কঠিন শেকল তকমা আঁটা গায়,
 প্রভাত ফেরি বন্দে ঊষা আলোর বার্তা ধায়।
আজ না হলেও হবেই হবে রাতের পরে দিন কালো মেঘের উল্টোপারে বিজলি আলোর বীণ।
বাবা
১৯৮২ সালে বালিকা কন্যাকে লেখা চিঠি আসলে কবিতা। উত্তর দিতে হত কবিতাতেই। বাবার কোলে বসে লেখার শুরু, রোগ যন্ত্রণা ভোলাতে বিশ্বসাহিত্যের পাঠ দিয়েছিলেন বাবাই, মেয়ের তখন বছর তিন চার হবে। পেশায় চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, নেশায় লেখক , ৩১ বছর আগে ১৯৮৮ সালের ২১ জানুয়ারি অকাল প্রয়াত । মাত্র ৫২বছর বয়স। কী রূপবান পুরুষ তখনো। এই বয়সের কাছাকাছি পৌঁছে বুঝি এটা কোন বয়স না। তখনি চলে গেলেন। আগের দুপুরে নিজের জন্য বানানো সিঙ্গল খাটে শুয়ে শুয়ে আমাকে কালকূটের পৃথা পড়ে শোনাচ্ছিলেন। মা এসে তাড়না দিলেন – ওকে এসব কী শোনাচ্ছ? এতো বাজে বাজে কথা! বাবা বললেন – ওকে তৈরি করে দিয়ে গেলাম।
তৈরি করার শুরু তো সেই জন্ম থেকেই। যখন জানা গেল এক বিশেষ কনজেনিটাল অসুখ নিয়ে জন্মেছি । তার যন্ত্রণা এমন যে চারটে ক্যাম্পোজ খাইয়েও ঘুম পাড়ানো যেত না, তখনি বাবা বুঝতে পেরেছিলেন একদম অন্যরকম খাতে বইবে এ মেয়ের জীবন আর যন্ত্রণা ভোলাতে তাই সচেতনভাবে ঠেলে দিয়েছিলেন শিল্পের দিকে । চেকভ মোঁপাসা টলস্টয় ভ্যান গগ রবীন্দ্রনাথ চার্লি চ্যাপলিন- এদের জীবনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে বলেছিলেন যন্ত্রণা ছাড়া শিল্প সৃষ্টি হয় না। আর এ সমস্তই মুখে মুখে । কারণ মেয়ে যে তখনো অক্ষর পরিচয়ের বয়সেই পৌঁছয়নি। আর এই পরম্পরা চলেছে মেয়ের আঠেরো বছর বয়সে তাঁর হঠাত চলে যাওয়ার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ।
বেদের অপর নাম শ্রুতি কেন তা আমার মতো এত নিবিড় করে কে বুঝেছে? পরে তাঁকে হারানোর পর দেখেছি সাউন্ড অফ মিউজিকের গান থেকে পেলের ম্যাজিক টাচ, শ্যাম থাপার বাইসাইকেল শট থেকে হেলেনের নাচ, শচীন কত্তার গান থেকে গীতা চণ্ডী, প্রেমেন্দ্র মিত্র থেকে বুনো রামনাথ, কথামৃত থেকে অতুল্য ঘোষ – এত বিশাল একটা ভাণ্ডার তিনি আমার জন্য রেখে গেছেন তা আমি নিজে পড়ে করতে গেলে তিন জন্ম লেগে যেত। একবার শীতে প্রবল কাবু দেখে ব্র্যান্ডি খাইয়ে বলেছিলেন – সব কিছু করো কিন্তু হারিয়ে যেও না।
হারিয়ে যাইনি বাবা। প্রতি মুহূর্তে মনে রাখি – যেমন রক্তে ও জলে তিলে তণ্ডুলে লিখেছিলে পিতার পায়ের কাছে বসে আজ ক্ষমাহীন লেখো।
তার শুরু তো তুমিই করে দিয়েছিলে। ইতিহাসের খাতিরে বলতে হয় আমার রচিত প্রথম গদ্য ছিল একটিমাত্র বাক্য – সিমেন্ট কিনে এ বছর আমাদের খুব লস হয়েছে। বয়স তখন সাত বা আট। তুমি একটা খাতা দিয়ে পাঠিয়েছিলে কিছু লিখে আনতে। একটি তিনশো বছরের পুরোনো রথের ওপর বসে লাইন টানা খাতায় সেই বাক্য লেখার পর থেকে তিন দশক ধরে নানা লস বা ক্ষতির খতিয়ান লিখে চলেছি। সবচেয়ে বড় ক্ষতি তো তোমাকে হারানো।
একবার তুমি বলেছিলে ‘সুন্দর বটে তব অঙ্গদখানি, তারায় তারায় খচিত ‘- এই গানটা নাকি রবীন্দ্রনাথ তোমাকে দেখে লিখেছিলেন । তুমি তখন তারায় তারায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলে। বেমালুম বিশ্বাস করেছিলাম সে কথা । আজো করি।
দেখতে পাই তুমি একটা ছোট্ট মেয়েকে প্রথম থেকেই যে মহাকাশের ভর ভার ধারণায় দীক্ষিত করে তার মনটাকে উঁচু তারে বেঁধে দিয়েছিলে, সেই মহাকাশে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছ তুমি তারায় তারায়। আমার চিরতরুণ বাবা, আমার প্রথম পুরুষ, খুব মিস করি তোমাকে, আজো।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।