চলচ্চিত্র পিংক: লিঙ্গ সচেতনতার এক গুরূত্বপূর্ণ মাইলফলক
সমকালীন নারী আন্দোলন তথা ‘জেন্ডার সেনসিটাইজেশন’ এর দিক থেকে ‘পিংক’ চলচ্চিত্রটি অত্যন্ত গুরূত্বপূর্ণ। এই সিনেমার প্রথমেই আমরা জেনে যাই যে কোনও একটি ‘অবাঞ্ছিত’ ঘটনা ঘটেছে যার কেন্দ্রে আছে অল্প বয়সী কয়েকজন যুবক যুবতী। সিনেমার শেষে টাইটেল কার্ড দেখানোর আগে পর্যন্ত আমরা ঘটনাটি দেখিনি একবারও, কেবল বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাটির সম্পর্কে কখনো সংক্ষিপ্ত, কখনো বিস্তৃত, কখনো একেবারেই দু একটি ইঙ্গিৎ ধর্মী কথাবার্তা শুনেছি। সেখান থেকেই ঘটনাটি বিভিন্ন তরফে আস্তে আস্তে পুন:নির্মিত হতে থাকে।
এই ধরণের পুন:নির্মাণ আমাদের সমাজে চারপাশে অবিরত ঘটে। এই পুন:নির্মাণের প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আমরা আমাদের নিজস্ব সংস্কার, বিশ্বাস, নৈতিক ভালো মন্দের ধারণা, নারী পুরুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অধিকারের নানা স্থিরীকৃত মানদণ্ড দ্বারা চালিত হই। নারী নির্যাতনের মোটা দাগের ঘটনাবলীর কয়েকটি সম্পর্কে আমরা ‘শিক্ষিত সভ্য সমাজ’ মোটামুটি ঐক্যমতে হয়ত এই একুশ শতকে পৌঁছতে পেরেছি। কিন্তু ডাইনী প্রথা, পণ প্রথা, বধূ হত্যা, বাল্য বিবাহের মত ঘটনাবলীর এলাকা ছেড়ে বেরোলেই নারী অধিকারের ক্ষেত্রে সামাজিক ও ব্যক্তিগত অবস্থানগুলি জটিল ও অনেকাংশে প্রথাগত হয়ে পড়ে। নারীর পোষাক, আচার আচরণের সঙ্গে নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলির সম্পর্ক নিরূপণের ক্ষেত্রে এই জটিলতা আমরা বারবার লক্ষ্য করি। মেয়েদের পুরুষ ‘অভিভাবক’ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা, রাত করে বাড়ি ফেরা, নির্দিষ্ট ‘গণ্ডী’র বাইরের পোষাক পড়া, ‘ছেলেবন্ধু’ দের সঙ্গে খোলামেলা মেশা আড্ডা দেওয়া – সবকিছুই প্রশ্নের মুখে পড়ে। এই ধরণের জীবনযাত্রায় কোনও মেয়ে অভ্যস্ত থাকলে তাকে ‘সন্দেহজনক চরিত্র’ হিসেবে অনেকেই চিহ্নিত করে দেন, ‘ভদ্র ঘরের’ মেয়েদের অপর অবস্থানে তাদের বসিয়ে দেন।
সামাজিক ভাবে ‘স্বাভাবিক’ এই ঘটনাগুলিই ঘটে এ সিনেমাতে। আমরা জানতে পারি তিনটি মেয়ে – মিনাল, ফলক, আন্দ্রেয়া কোনও একটি রক কনসার্টে গিয়ে কাছাকাছি বয়সের কয়েকজন ছেলের – রাজবীর ডাম্পি, বিশ্বর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল এক ‘কমন ফ্রেন্ড’ এর মাধ্যমে। পরিচয় আলাপচারিতা হয়ে বন্ধুত্বের দিকে গেলে মেয়েদের ডিনারের আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং তারা তা গ্রহণ করে। খাদ্যের সঙ্গে পানীয়ও ছিল। এরপরে মিনালকে ‘জোর’ করে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ স্পর্শ করে রাজবীর এবং মিনালের নিষেধ না মানার পরও জোর চালিয়ে গেলে মিনাল প্রবল ক্ষোভে রাজবীরকে কাঁচের বোতল দিয়ে মাথায় আঘাত করে, যা থেকে তার একটা চোখও নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
ঘটনার সময় মিনাল রাজবীর ছাড়া ঘরে আর কেউ ছিল না। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে মেয়েরা হোটেল ছেড়ে নিজেদের আস্তানায় চলে আসে। আহত রাজবীরকে তার বন্ধুরা নিয়ে যায় হাসপাতালে। চোখের ওপরে কপাল জুড়ে অনেকগুলো সেলাই পড়ে। শেষমেষ চোখটা অবশ্য বেঁচে যায়।
এরপরেই ঘটনা থানা পুলিশ আদালতের দিকে মোড় নেয়। মেয়েদের দিক ঘটনাটিকে ‘আপোষে মিটিয়ে নেবার’ প্রয়াসই প্রথমদিকে ছিল। কিন্তু ছেলের দল সামাজিক এবং ব্যক্তিগত স্তরে মিনাল ফলক এবং আনদ্রেয়ার ক্ষতি করতে উদ্যোগী হয়। বাড়িওয়ালাকে নির্দেশ দেয় তাদের বাড়িছাড়া করার জন্য, যথেষ্ট ভয়ভীতিও দেখায়। ফলকের ছবিকে বিকৃত করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যার ফলে তার চাকরী যায়। আন্দ্রেয়াকে ফলো করা হতে থাকে, চলে ভয় দেখানো। এরপর মিনালকে গাড়িতে অতর্কিতে তুলে যথেচ্ছ শ্লীলতাহানির ঘটনাটির পরই মেয়েরা থানায় এফ আই আর করে। আর এর পরেই জানা যায় শ্লীলতাহানি করা রাজবীর একজন বড়সড় নেতার ভাইপো। স্বাভাবিকভাবেই পুলিশ একচক্ষু হরিণের মত আচরণ শুরু করে এবং মিনালকেই ব্যাকডেটে নথিভূক্ত করা ‘সাজানো’ এফ আই আর এর ভিত্তিতে গ্রেফতার করে। মিনালের জামিন হয় এবং মামলা গড়ায় আদালত পর্যন্ত।
আদালত কক্ষেই নারীর অধিকার, তার চরিত্র সম্পর্কিত ধারণা, শ্লীলতাহানির মতো ঘটনাগুলির ক্ষেত্রে মেয়েদের ‘দায়দায়িত্ব’, ভালো মেয়ে মন্দ মেয়ের আদলের নির্মাণ বিনির্মাণ এর নাটকীয় পর্ব চলে।
রাজদীপ এর পক্ষের উকিলের সওয়াল জবাবে চলে মিনাল এবং তার বন্ধুদের দিক থেকেই যৌন সংসর্গের ইঙ্গিৎ আসার কথা। এই ইঙ্গিৎ কী কী ছিল ? ছেলেদের আমন্ত্রণে চটজলদি ডিনারে যেতে রাজী হয়ে যাওয়া, তাদের সঙ্গে মদ্যপান করা, মিনাল এর নিজেরই ড্রিংকস বানানো, যৌন পরিহাসপূর্ণ চুটকী বলা এবং ছেলেদের সঙ্গে ‘হোটেলের ঘর’ পর্যন্তও যাওয়া। নির্দিষ্ট ঘটনাটির এই পুনঃনির্মাণ পর্বে ছিল মেয়েদের চরিত্রকে কালিমালিপ্ত করার অন্যান্য ‘সামাজিক মনস্তত্ত্ব’গত উপাদান। যেমন তাদের রাত করে বাড়ি ফেরা, পুরুষ অভিভাবক ব্যতিরেকে ‘নির্দিষ্ট কোনও কারণে’ তিনটি মেয়ের আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকা, সেই ফ্ল্যাটে ‘পুরুষ’ দের যাতায়াত ইত্যাদি। এই সমস্ত সূত্রের ভিত্তিতেই এমনকী আইনের চোখেও প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় মিনাল ও তার সঙ্গীরা সবাই যৌনতার প্রশ্নে ‘কোশ্চেনেবল ক্যারেকটার’ এবং টাকার বিনিময়েই তারা ছেলেদের দিকে ‘ইঙ্গিৎ’ পাঠায়। ফলে শ্লীলতাহানির অভিযোগটি উঠতেই পারে না, বরং বিচারের যোগ্য হয়ে ওঠে কেবলমাত্র ‘খুনের চেষ্টা’র অভিযোগটি যাকে মেয়েদের পক্ষ থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা বলে বলা হয়েছে।
এই সূত্রেই এরপর পালটা সওয়াল জবাবে আসে যাবতীয় এই নির্মাণ এর অতি প্রয়োজনীয় বিনির্মাণগুলি। মিনালের উকিল হিসেবে সওয়াল জবাব করতে উঠে প্রবীণ দীপক সেগাল এর চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করা অমিতাভ বচ্চন নিচু তারে অনাটকীয়ভাবে তীক্ষ্ণযুক্তিতে যাবতীয় নির্মাণের অন্তঃসারশূন্য বুননগুলিকে ফাঁসিয়ে দিতে থাকেন। পোষাক, রাতে বাড়ি ফেরা, পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে হেসে কথা বলা, ডিনারের আমন্ত্রণ গ্রহণ করা, একসাথে মদ্যপাণ করা, যৌন পরিহাসে অংশগ্রহণ করা – কোনও কিছুই মেয়েদের সঙ্গে শরীরী ঘনিষ্ঠতার ছাড়পত্র দেয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাতে তার শর্তহীন সম্মতি থাকে। সম্মতির ভিত্তিতে যে যৌনতা, তা উনিশ বছর বয়সেই শুরু হোক আর একাধিক সঙ্গীর সঙ্গেই হোক – তাও তাকে স্বাভাবিকভাবে একজন ‘আগ্রহী’ নারী বানিয়ে দেয় না। যৌন নৈতিকতার একটি এবং কেবল একটি মানদণ্ডই থাকতে পারে, আর সেটি হল সম্মতি, কনসেন্ট। এই সম্মতি অসম্মতিই কেবল ঠিক করে দিতে কোন ঘটনা পারস্পরিক আর কোনটি বলপূর্বক। যে কোনও ধরনের বলপূর্বক সম্মতিবিহীন যৌনতাই শ্লীলতাহানি – তা পরিস্থিতি এবং পাত্রপাত্রী নিরপেক্ষভাবে। আদালতের সওয়াল জবাবে আইনজীবী দীপক সেগাল এমনকী সম্মতিবিহীন যৌনতার ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ককেও অন্তর্ভূক্ত করেছে – ভারতীয় বিচার ব্যবস্থা এখনো যাতে সম্মতি দেয় নি, কিন্তু যা জেন্ডার মুভমেন্ট এর অন্যতম দাবী।
নিঃসন্দেহে এই ছবি ভারতের সিনেমা এবং সামাজিক আন্দোলন, নারী আন্দোলন, লিঙ্গ সচেতনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক মাইল ফলক হয়ে ওঠার গুণাগুণ সমৃদ্ধ। যা থেকে আমাদের অনেকেরই নৈতিকতার নির্মাণগুলিকে বিনির্মিত করার শিক্ষা নেওয়ার আছে।