• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৫)

সোনা ধানের সিঁড়ি

১৩
ছোটবেলায় অন্ধকারকে দেখলে সবাই ভয়ে কাঁপত। আর আমি অন্ধকারকে দেখে কাঁদতাম।  সন্ধে হলে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে দুয়ারে পড়তে বসতাম। মা তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে দিত। ওই সামান্য আলোতেই উঠোনটা যেন আলো হয়ে থাকত। পড়তে পড়তে ওই আলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে কি ভালো লাগতো। পরিবারের কেউ মারা গেলে অশৌচের দিনগুলোতে তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বলত না। উঠোনটা অন্ধকারে ডুবে থাকতো। পড়া থামিয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। চোখে জল আসত। হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো চোখের সামনে ভেসে বেড়াত। ছোটবেলায় আমার এই কষ্টের কথা কাউকে বোঝাতে পারি নি।
১৪
আমি যখন উচ্চমাধ্যমিক দিচ্ছি তখনও আমাদের বাড়িতে ঘড়ি ছিল না। মা মেজজেঠিমার বাড়ি থেকে ঘড়ি চেয়ে নিয়ে আসত। আমি সময় দেখে পড়ব বলে। এটা অবশ্য পরীক্ষার সময়েই করা হতো। যদিও সব দিন নয়। যেদিন ঘড়ি থাকতো না সেদিন মা আকাশে ভোরের শুকতারা দেখে আমাকে ভোরবেলা পড়তে তুলে দিত। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখতাম গভীর অন্ধকার। আমি আর একটু শুয়ে নেওয়ার কথা বললে মা খুব বকত। মায়ের মুখেই শোনা, এই অন্ধকারটা নাকি ভোরের চাদর। ততদিনে জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের গান কানের ভেতর দিয়ে একেবারে মরমে প্রবেশ করে গেছে —– ” এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার। ” চোখে জল দিয়ে ঘুম ঘুম চোখে হ্যারিকেনের আলোয় পড়ছি আর তাকিয়ে দেখছি অন্ধকারের ভেতর থেকে কিভাবে আলোর নদী বেরিয়ে আসছে।
১৫
আমার বাবা ব্রাহ্মণ ছিলেন। বিয়ের কাজ করে গভীর রাতে বাড়ি ফিরতেন। পায়ে হেঁটে। কোনো কোনো দিন আমিও থাকতাম। গ্রামের রাস্তা ধরে ধুলো পথে। ধুলোয় আমাদের পা ডুবে যেত। বাবার হাতে থাকতো হ্যারিকেন।
ঘন্টা দেড় দুই হেঁটে যাওয়ার পর তবে বাড়ি। বাবা এমনিতেই কম কথা বলতেন। রাতে গ্রামের রাস্তায় তো আরও কম। মনে হতো বাবা যেন অন্ধকারকে পড়তে পড়তে বাড়ি ফিরছেন। এই অন্ধকারকে আমি কখনও ভয় পাই নি। মনে হতো আমরা তিন বন্ধুতে একসঙ্গে বাড়ি ফিরছি —— বাবা, আমি আর অন্ধকার।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।