‘ঠিক তাই, এও এক সাধনা নন্দিনী, অভিনেতার শরীর এবং গলার স্বর, তার মড্যুলেশন,মুখের এক্সপ্রেশান সব মিলিয়ে একটা পরিপূর্ণ অভিনেতা, দেহ পটে সনে নট সকলি হারায়। এই সবগুলি মিলিয়েই তো অভিনেতা শরীর বা দেহ। যেকোন একটি চলে গেলে তার আর কিছুই থেকে না। আজ জীবনের অপরাহ্ণবেলায় এসে কি মনে হচ্ছে জানো নন্দিনী, এই সামান্য স্মৃতিটুকু ছাড়া আর কিছুই থাকল না। এর থেকে কিছু পেতে হলে নিজেকে সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ করতে হয়। যাঁরা করতে পেরেছেন তাঁরা আজও স্মরণীয়। লালুদার এত প্রতিভা এত জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও সেভাবে মূল্যায়ন হল না। কি তাঁর একাডেমিক কেরিয়ার, বিএ এবং এম’তে প্রথম শ্রেনীতে প্রথম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কালীন সারা ভারত আন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয় নাট্য প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরষ্কার গ্রহন করেছিলেন, রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের হাত থেকে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেই একই প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। কেউ এই নিয়ে আক্ষেপ করলে বলতেন “আরে আমি বড়বাবুর সান্নিধ্য পেয়েছি, হাবিব তানবীরের সঙ্গে কাজ করেছি, স্তালিস্লাভিস্কি পড়েছি, ব্রেখ্টের নাটক নিয়ে সেমিনারে বক্তব্য রেখেছি, আর কি চাই।
ব্রেখ্টের নাটক তোমরা করেছ।
করেছি বৈকি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বাংলায় অনুবাদ করা rule and exception অবলম্বনে বাংলা নাটক “ বিধি ও ব্যতিক্রম। আদালতে বিচার প্রক্রিয়া চলেছে,সেটি যে কত বড় প্রহসন সেটাই দেখানো হয়েছিল এই নাটকে। এক ব্যবসায়ী যখন মরুভূমি পার হয়ে তেলের খনির ইজারা নিতে যাচ্ছে, পথে সে তার মালবাহী কুলিকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। বিচারকই বুঝিয়ে দিচ্ছেন কিভাবে সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপিত করলে এই খুন আত্মরক্ষার অধিকার হিসাবে সাব্যস্ত হবে । কারণ কুলি গরীব, ব্যবসায়ী ধনী, সুতরাং গরিব কুলিকে খুন করার জন্যে ধনীর সাজা হতে পারে না। এই ছিল নাটকের মূল বক্তব্য। সেই প্রথম লালুদার কাছ থেকে জানলাম কেন ব্রেখ্টের নাটক অন্য নাটকের থেকে স্বতন্ত্র। এখানে কোন নিটোল গল্প থাকে না কোন একটি ঘটনাকে ঘিরে নাটক আবর্তিত হতে থাকে। যে মুহুর্তে নাটকীয়তায় দর্শক একাত্ম হয়ে যায়, তখনই তাকে ছিন্ন করার জন্যে হয় কোন গান, কিংবা সুত্রধরকে দিয়ে নাটকের মূল বক্তব্য স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। একে বলে Break of illusion, নাটকের মায়া যেন দর্শক’কে বিচ্যূতি না ঘটায় উদ্দেশ্য থেকে। ব্রেখ্টের নাটক খুব বাস্তব ধর্মী। দর্শক সাধারণ জানে এটা সত্যি নয়। সত্যি হিসাবে উপস্থাপিত করার প্রচেষ্টা নাটকের ক্ষতি করে। নাটকের সর্ত মেনে অভিনেতা ঘোড়ার পিঠে বা হাতির পিঠে রয়েছেন, তার জন্যে মঞ্চে ঘোড়া বা হাতি আনার দরকার নেই, তিনি চেয়ার বা টুলে বসে থাকলেই দর্শক মেনে নেবেন ওটা হাতি বা ঘোড়া, উদ্দেশ্য একটাই কোনমতে যেন illusion না তৈরী হয়। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ সাধারণ যে সমস্ত নাটক দেখে থাকি তার সঙ্গে ব্রেখ্টের নাটকের পার্থক্য।আবার সেই বাদল সরকারের থার্ড থিয়েটারের কথা বলতে হয়। আমার অত পড়াশুনা নেই নন্দিনী যে ব্রেখ্টের নাটকের খুটিনাটি গভীর ভাবে বুঝাতে পারব।
“না না এর চেয়ে বেশী আমার মাথায় ঢুকবে না”।
লালুদা একটা কথা বলতেন, থিয়েটার বা সিনেমা দেখে এসে অনেকেই বলে না আহা কি অভিনয় দেখলাম চরিত্রের সঙ্গে এক হয়ে গেছে। লালুদার মতে যে অভিনেতা যত বেশী কনসাস থাকবে সে তত ভালো অভিনয় করবে। মঞ্চে বা ক্যামেরার সামনে অভিনেতাকে জানতে হয় তাকে কি করতে হবে। কোন সংলাপ তাকে বলতে হবে কোন আচরণ তাকে করতে হবে। যিনি যত বেশী এটা আত্মস্থ করতে পারবেন তাঁর অভিনয় তত ভাল হবে। মঞ্চে একটা সুবিধা আছে, নাটক যত ক্লাইম্যাক্সের দিকে এগোবে, অভিনেতা নিজেকে ধীরে ধীরে সেই উচ্চতায় নিয়ে যেতে থাকবেন, তার সঙ্গে আছে দর্শকদের রিএ্যাকশন। যা থেকে অভিনেতা ইন্সপিরেশন পান। ফিল্মে সেই সুবিধা নেই, শেষদৃশ্যের অভিনয় হয়ত প্রথমদিনেই শুটিং হল, অভিনেতাকে ইম্প্রোভাইজ করতে হয় অনেক বেশী। তাই আমার নিজস্ব মত ফিল্ম এ্যাকটিং অনেক বেশী কঠিন,আবার দেখো সেখানে তবে ভুল হলে সংশোধন করার সুযোগ আছে, মঞ্চের নাটকে তা নেই, এখন তুমিই বিচার করো কোনটা কঠিন।
“লালুদা কি ফিল্ম এ্যাকটিং করেছেন কখনো’।
সেভাবে করেন’নি, একটা তমসারেখা নামে একটা সিরিয়ালে কিছুদিন কাজ করে ছিলেন, অত্যন্ত বীতশ্রদ্ধ হয়ে আর দ্বিতীয় বার করার কথা ভাবেন’নি, ঋতুপর্ণ ঘোষের টেলিফিল্মে একটি ছোট্ট রোল, আর জ্যোর্তিময় রায়ের ডকুমেন্টারী ফিল্ম “স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলা” ছবিতে একটী বড় চরিত্র।মুখ্য সুত্রধর বলা যায়। যাতে আমার একটি ছোটখাট কাজ করেছিলাম । নীলদর্পণ নাটকের একটি দৃশ্য চলচিত্রায়িত হয়েছিল, সেখানে একটি চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলাম”।
“ইউটিউবে খোঁজ করলে পাওয়া যাবে?”
“না। তারও একটা ইতিহাস আছে, ওই ডকুমেন্টারী ফিল্মটি প্রযোজনা করেছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তখন তথ্যসংস্কৃতি মন্ত্রী, প্রিমিয়ার শো’য় ছবিটি দেখতে আসেন। কলকাতার বুকে যে সমস্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্ট্যাচু আছে ছবিতে দেখানো হয়েছিল সেগুলির হতশ্রী অবস্থা, পাখিতে নোংরা করেছে স্ট্যাচুগুলির মাথায়। বুদ্ধবাবু বলেছিলেন ছবি থেকে ওগুলি বাদ দিতে হবে, পরিচালক রাজী হন’নি।যদি তা না হয় , তাহলে ফিল্মের ক্যানগুলি গুদামজাত হয়ে পড়ে থাকবে। তাই হয়েছিল , সব শাসকেরই তো একই মুখ। তাই ফিল্মে লালুদার অভিনয় দেখার কোন সুযোগ নেই। সিরিয়ালে অভিনয় তাঁর পছন্দ হয়নি সেকথা আগেই বলেছি। যিনি সারা জীবন আন্তরিকতার সাথে নাট্য চর্চা করেছেন, তিনি কিকরে মেনে নেবেন, শট দেবার দশ মিনিট আগেও স্প্রিপ্ট এসে পৌঁছায়নি। শুধুমাত্র সংলাপ উগরে দেওয়া তো অভিনয় নয়।চরিত্র নিয়ে ভাববার কোন অবকাশ দেওয়া হয় না। আগের এপিসোডের সঙ্গে পরর্বতী এপিসোড সঙ্গতিহীন এবং এর কোন ব্যাখা নেই। ফলে দ্বিতীয়বার সিরিয়ালে অভিনয় করার কথা ভাবেননি। অভিনয় জীবনের একদম শেষের দিকে ঋতুপর্ণ ঘোষের একটি টেলিফিল্মে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ব্যস ওই পর্যন্ত। তবে কি জানো নন্দিনী, লালুদা যদি সিরিয়াসলি ফিল্ম এ্যাকটিং করতেন বাংলা সিনেমা আর এক স্টলওয়ার্টকে পেত।এই তো কদিন আগে স্মৃতিচারণ করার সময় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজে স্বীকার করেছিলেন, লালু তো আমার মত সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেনি, তার অনেক দায়বদ্ধতা ছিল, যেহেতু সে বাবা মায়ের এক মাত্র সন্তান তাঁদের প্রতি তার কর্তব্য অস্বীকার করবে কিকরে, তাই তাকে উনষাট সালে কলেজে প্রফেসরের চাকরী নিতে হয়েছিল। লালু ফিল্মে এলে বাংলা সিনেমা জগৎ আর একজন দুর্দান্ত অভিনেতাকে পেত। দুর্ভাগ্য আমাদের।
“ সত্যিই দুর্ভাগ্য”।
“হ্যাঁ নন্দিনী, শুধু তোমার নয় আমারও, তিরাশি সালে চাকরী পেয়ে সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে চলে যেত হল। এতদিনের পরিশ্রম মনের মধ্যে থাকা আশা সব কিছু বিসর্জন দিয়ে চলে যাওয়া কি বেদনার তোমাকে বোঝাতে পারব না। আমারও তো সংসারের প্রতি দায়বদ্ধতা।সেদিন সব কিছু ছেড়ে দিয়ে আমিও ঝাঁপিয়ে পড়তে পারিনি। তারপর অনেক ভাল ভাল নাটক হয়েছে,দিবানিশি ভূত অদ্ভুত, হদিশ মুক্তধারা। এ আপসোস কি যাবার। মুক্তধারা রিহ্যার্সাল পর্যন্ত দিয়েছিলাম। কিন্তু অভিনয় করা হল না। কবে থেকে ইচ্ছা ছিল রবীন্দ্রনাথের নাটক করব, ধরো সেই রক্ত করবী দেখার পর থেকে”।