• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সুব্রত বসু (পর্ব – ১)

আমার নাটক, নাটকের আমি                     

(১)

ডাবলু ডাবলু ডাবলু অন্ত্যেষ্টি ডট কম ., পাশে মোবাইল ফোনের নাম্বার, চকচকে স্টিলের ওপর লাল রঙের অক্ষরে লেখাগুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিলাম। এটা একটা ফ্রিজার, আয়তকার  প্রায় আট ফুটের মত লম্বা, চওড়ায়  আড়াই ফুটের মতন, ওপরটা কাঁচ দিয়ে ঢাকা, তার মধ্যে লা্লুদা শুয়ে আছেন। এখন কেউ মারা গেলে দূরের কারুর জন্যে যদি অপেক্ষা করতে হয়,  তবে এখন আর পিস হেভেনের প্রয়োজন হয় না। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোকজনেরা বাড়ীতেই  সে ব্যবস্থা করে দেয়। লালুদার মেয়ে আসবে সুরাট  থেকে, প্লেনে  রওনা হয়েছে, এখানে  আসতে রাত দেড়’টা দুটো বাজবে। সুতরাং আজকের রাতটা লালুদাকে এই হিমশীতল  ফ্রিজারের  মধ্যেই শুয়ে থাকবে হবে, মৃত্যুর শীতল  নিঃস্পন্দতাকে সঙ্গী করে। একটু আগেই ঘরেতে অনেকেই ছিল।যেহেতু  এসে ঢুকলাম তাই বোধহয় , লালদার স্ত্রীর ছোট বোন, দীর্ঘদিন যাওয়া আসা সুত্রে আমি তো কারুর কাছেই অপরিচিত নয়, তিনিই প্রথম কথা বললেন, “আর কি ছুটি হয়ে গেল”।  আমি জানি একথার কোন উত্তর হয় না, ছুটি মানেই তো আর  কোন দায় থাকল না। হাওড়া এসে  লালুদার  সঙ্গে দেখা করতে না পারার যে অপরাধবোধ তাও তো আর থাকল না আমার , এও তো একরকমের ছুটিই। তাই সে কথার আর কি জবাব দেব, চুপ করে রইলাম।  তারপর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে যা হয়ে থাকে,  মৃত্যুর শেষমুহুর্তের কিছু অহেতুক  আলোচনা। আমার কাছে এই  আলোচনা নতুন  কোন বার্তা এনে দেবে না তাই মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিলাম , কেউ একজন ফ্রিজারের পাশে রাখা একটা চেয়ারে বসতে বলল, তবু দাঁড়িয়েই ছিলাম , কাঁচের মধ্যে দিয়ে  লালুদার মুখের দিকে তাকিয়ে।
এখন ঠিক এই মুহুর্তে ঘরে কেউ নেই, তাই   ফ্রিজারের পাশের   চেয়ারটায় গিয়ে বসতেই হল, মনে হচ্ছিল এই বোধহয় বলে উঠবেন “সুবু দাঁড়িয়ে কেন বসো না”। মৃতদেহের পাশে বসে এসব কথা মনে হওয়া খুব স্বাভাবিক।    কাঁচের ঠান্ডা  বাক্সের ভিতর শুয়ে থাকা  লালদার মুখটা কিছুতেই মেলাতে পারছিল না অতীতের সঙ্গে।  অজান্তেই চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। এর আগে লক্ষ্য করেছি  বটে তবে কখনো কি  মনে হয়নি?  এখনই বা  কথাটা মনে হল কেন?  মৃত্যু  কি একই রকম ছাপ ফেলে  যায় সর্বত্র !  কিছুদিন আগে চিম্ময় রায় মারা যেতে  কেউ একজন মৃতদেহের ছবিটা সোস্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছিল। কি অদ্ভুত মিল,লালুদার বর্তমান মুখের সাথে,  চোয়ালটা  ঢুকে গেছে,  সামান্য ফাঁক হয়ে আছে মুখ। বন্ধ চোখ সাড়হীন।  পরিচিত অপরিচিত মৃতদেহ তো কম দেখলাম না ।কর্মসুত্রে অস্বাভাবিক মৃত্যুও কম দেখেনি।  সে যেমনই  হোক না কেন  কোথায় যেন একটা মিল সমস্ত মৃতদেহে। হার্ট এ্যাটাকে হঠাৎই সহকর্মী সোমেশ্বর অসুস্থ হয়ে পড়ে, আমার নাইট ডিউটি ছিল সেই রাতে। হাসপাতালে নিয়ে  গিয়েছিলাম , বুকের থেকেও বাঁহাতের  যন্ত্রণায় ছটফট করছিল সে ।  একটা সরবিট্রেট আর তিন চামচ এ্যান্টাসিড, ব্যস আর কোন খরচ হয়নি, সকলে বলছিল সোমেশ্বরবাবু যেন ঘুমিয়ে আছেন।  আমার  চোখ কিন্তু  এড়িয়ে যায়নি, মৃত্যুর একটা স্পেশাল সিগনেচার যা সোমেশ্বরের  মুখের ওপরও আঁকা হয়ে গিয়েছিল অত কম সময়ের মধ্যে।

চশমা খুলে চোখ মুছলাম ।সেই সময়  হারুদা   সুদীপকে সঙ্গে  নিয়ে  ঢুকল, দুজনেই ফ্রিজারে  হাত ছুঁইয়ে মাথায়  ঠেকালো। না  ওটা আমার  করা  হয়নি, এইভাবে প্রণাম করার কথা যে মাথায়  আসেনি তা নয়, মনে হয়েছিল এত তাড়াতাড়ি লালুদাকে বিদায় দিয়ে দেব।মৃতদেহের  পাশে বসে সঙ্গোপনে একটু শোক,  একান্তে  পুরানো স্মৃতি রোমন্থন এগুলো  কি লালুদার পাওনা নয়?

“কতক্ষণ এসেছ?” হারুদাই জিজ্ঞাসা করল, উওর দেবার আগেই সুদীপ বলল, “ আমি এই মাত্র বাস থেকে নেমে খবর পেলাম”। এই দুজনেই সঙ্গেই আমি  মঞ্চে অভিনয় করেছি। বিশেষতঃ  হারুদার সঙ্গে ফজল আলি  আসছে নাটক’টা সেই সময় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।
হারুদার কথার জবাব না দিয়ে সুদীপ কে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুই তো এখানেই থাকিস এখন খবর পেলি কেন, লালুদা তো বিকেল চারটেতে মারা গেছেন”।
“আমার শালা হাসপাতালে ভর্তি তাকে দেখতে গিয়েছিলাম”। সুদীপ একটা মোড়ায় বসল। হারুদার কথাটার যে জবাব দেওয়া হয়নি সেটা আর আমি  খেয়াল করিনি। মুখটা নিজের দিকে  নামিয়েই বসেছিলাম। আসল কথা আমি  একটু একা থাকতে চাইছিলাম  । তারপরেও হারুদা আবার জিজ্ঞাসা করল, “ তুমি কি চুঁচড়ো থেকে এলে”। উত্তর না দিয়ে মুখ তুলে ঘাড় নাড়লাম।
“অত দূর থেকে তাড়াতাড়ি চলে এসেছ, খবর পেলে কখন?”
“সাড়ে ছ’টায় ফেসবুকে’।
“তার মানে খবর পেয়েই বেরিয়ে এসেছ”।
“না , তারও ঘণ্টা খানেক পর বেরিয়েছি, দুঘণ্টা তো লাগেই”।
“তুই কি আজ থাকবি”। এবার সুদীপ জিজ্ঞাসা করল।
“হ্যাঁ,ফ্ল্যাটে”। এরা কেন বোঝে না একটা  মৃতদেহ পাশে রেখে পারস্পরিক কুশল বিনিময় শুধু অহেতুক নয়, সৌজন্য বিরোধীও বটে। কিছুদিন আগেই আমি  দেখেছিলাম লালুদার স্ত্রী যেদিন  মারা গেলেন লালদারই এক সম্পর্কিত বোন মৃতদেহের পাশে একটি বিছানায় বসে মুড়ি খাচ্ছিল। এত খারাপ লেগেছিল আমার । কাউকে কিছু বলতে পারিনি। এগুলো তো বলার কথাও নয়।  আসল কথা খবর পেয়ে যারা এই চোখের দেখা দেখতে আসছে, লালুদার মৃত্যু কোনভাবেই নাড়া দেয়নি তাদের। তারা জানে শেষ কয়েকটা বছর প্রায় শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি , চোখে দেখতে পেতেন না। বাইরের জগতের সঙ্গে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন, এসব কথা আমি  জানতাম , কিন্তু তার সঙ্গে এও জানতাম, মানুষটার অসম্ভব জীবনী শক্তি্র কথা । যা এরা জানত না। তাই যে কোন একটা মৃত্যুর সঙ্গে এক করে ফেলে,  নেহাতই একবার না  এলেই নয়,  তাই এসে পরিচিত কারোর সঙ্গে কুশল বিনিময় করে কিছুটা সময় কাটিয়ে যাওয়া।
সর্বক্ষণের কাজের মেয়েটী একটা থালা  কিছু কাগজের কাপে চা সাজিয়ে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল কেউ খাবে কিনা? ঘাড় নেড়ে ফিরিয়ে দিলাম, চা না খেয়ে তো এ বাড়ী থেকে কখনো যাইনি আজ আর নাই বা খেলাম, সেইসময় তাড়াতাড়ি হারুদা একটা কাপ তুলে নিল, সুদীপ চা খায় না।
ইদানীং একটা জিনিষ লক্ষ্য করার মত,যে কোন মৃত্যই সেভাবে আর শোকের আবহাওয়া তৈরী করতে পারে  না।আগে যেটা স্বাভাবিক ছিল,এখন  নেহাতই যদি অস্বাভাবিক বা অকালে না হয়। তবুও সেই শোকের আয়ু দু’একজনের কাছে ছাড়া সেভাবে ছাপ ফেলে না সামগ্রিকভাবে। আমি  অবশ্য কোনটা অকাল  সেটা বুঝতে পারিনা। কোন মানুষই বা জানে না মরার পক্ষে  কোন সময়টা যথাযথ।  যে কোন পরিবারে মৃত্যু একটা বড় ঘটনা, তা সে যখনই ঘটুক না কেন , তাই  প্রথমেই শোকগ্রস্থ পরিবারের সান্ত্বনার প্রশ্ন,এরপর সন্তাপিত পরিবারকে আনুষাঙ্গিক কাজ থেকে বিরত রেখে পাড়াপ্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, অনাত্মীয়রাই যাবতীয় আশু কর্তব্য পালন  করত স্বেচ্ছায়। এখন এসবের দায় ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের উপযুক্ত পারিশ্রমিকের পরিবর্তে। তাই প্রদর্শনীর মত কেউ কেউ আসে ফ্রিজারে হাত ছুঁইয়ে প্রণাম করে চলে যায়।
আপনা আপনিই দীর্ঘশ্বাস পড়ে ,   সত্যিই তো লালুদা আর পুরানো জায়গায় কোন দিন ফিরতে  পারতেন না।শেষের দিকে আমিও  তো এটাই মনে করতাম ,  যে মানুষটার মধ্যে এত জীবনী শক্তি ছিল, অন্ধ হয়ে, জড়িয়ে  যাওয়া দু’একটা কথার মধ্যে সেই  জীবনের স্পন্দন বজায় রাখা কি কোন সান্ত্বনা হতে পারে আমার  কাছে।তাই ইদানীং হাওড়ায় এলেও লালুদার সঙ্গে দেখা করতে  আসায় ছেদ পড়ত অনিবার্য ভাবে।খুবই  কষ্ট হত, সেই মানুষটাকে এই ভাবে দেখতে মন চাইত না। আজ তবু    মৃত্যু  একটা জায়গায় পৌঁছে দিল তাঁকে । এই রূঢ় বাস্তবটা মনে করতে গিয়েও  আবার চোখে জল আসছে।
“আজ তো আর বডি যাচ্ছে না সুবু,  কাজল আসতে আসতে রাত হবে, কাল সকালের আগে বডি বার করা যাবে না, তাই বসে থেকে আর কি করবে?” হারুদার কথায়  আর একবার মনে হল সত্যি তো  আমরা মারা যাবার পর তো সকলেই বডি হয়ে যাই , হারুদারই বা কি দোষ।  লালুদাই বা ব্যাতিক্রমী হবেন  কেন।  যত তাড়াতাড়ি মৃতদেহের  অপসারণের কথাটাই তো  ভাবতেই হয়।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।