পর্ব – ৮২
১৮১
কাগজের ঠোঙায় কতকগুলি স্থলপদ্ম ফুল। শ্যামলী বেরিয়ে পড়ল তা নিয়ে। আজ তাকে রামনারায়ণ সিংহের বাড়ি থেকে গাড়ি সারানো বাবদ টাকাটা আদায় করতেই হবে। গাড়ি সারানোর মধ্যে মজুরের পয়সা আর পার্টসের দাম, দুটোই থাকে। দুটোর পয়সাই কোম্পানি মিটিয়ে দিয়েছে। অথচ কাজ করে পয়সা উঠে আসে নি। কাজেই পয়সা না পেলে ঘাটতি পূরণ হয় না। আর এভাবে ফাঁকি দিয়ে কাজ আদায় করা যায়, রামনারায়ণ সিংহের এই ধারণাটা ভাঙা দরকার। একবার পাল অটোমোবাইল এর অফিসে এসে কাচ ভেঙেছিল রামনারায়ণ এর লোকেরা। ডিএসপি সাহেবের ফোনে ওরা থানায় পয়সা জমা দিতে বাধ্য হয়েছিল। অবশ্য ডিএসপি সাহেব রামনারায়ণকে বলেছিলেন বার্থডে গিফট মনে করে কাচের দামটা দিয়ে দিতে। কাচের দাম আদায় করার জন্য সেদিন সত্যাগ্রহ করেছিল শ্যামলী। কিন্তু সেদিন সাংঘাতিক বিপদ হতেও পারত। শ্যামলীর কোনো শ্রমিক বেমক্কা মাথা গরম করে ইট পাটকেল ছুঁড়ে ফেলতে পারত। কোনো বাইরের লোক রামনারায়ণের ওপর রাগের প্রতিশোধ নিতে শ্যামলীর দলে ভিড়ে গিয়ে হিংস্র আক্রমণ করে ফেলতে পারত। এমনকি আগুন ধরিয়ে দেওয়াও বিচিত্র ছিল না। সাধারণ বাঙালি ভীষণ রকম আবেগপ্রবণ। আবেগের চোটে তার যুক্তি যায় তলিয়ে। সুস্থ ভাবে চিন্তা করে যুক্তিসিদ্ধ পথে হাঁটতে বাঙালির অনীহা বরাবর। কিছু একটা করে ফেটে পড়লাম। তার পর কি হবে, কেউ জানি না। কর্মেণ্যবাধিকরস্তে দোহাই দিয়ে বাঙালির বিপ্লব যাপন। কতো ব্যাঙ্ক লুঠ হয়েছে, ডাকঘরের টাকা ছিনতাই হয়েছে, এমনকি ক্ষুদিরাম বসু পর্যন্ত এক গরিব ডাক হরকরার নাক ফাটিয়ে দিয়েছিলেন। আঁধারের আড়ালে দাঁড়িয়ে অজানা অচেনা নিরপরাধ মানুষের উপর বোমা ছুঁড়তে প্ররোচনা দেবার কাজকে পর্যন্ত একদল লোক বাহবা দেয়।
অথচ এই রকম অদূরদর্শী নেতৃত্বের হঠকারিতার জন্য ব্রিটিশের পুলিশ বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে ঢুকে ছেলে খোঁজার নামে মেয়েদের ইজ্জত লুটেছে। কত মেয়ে যে পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে আত্মহত্যা করেছে, সে কথা ইতিহাসে লেখা নেই। দেশ স্বাধীন হবার আগেও হিন্দু মুসলিমের দাঙ্গা বেধেছে নানা জায়গায়। সে সময়েও এক পক্ষের লোকজন অন্য পক্ষের বাড়িতে চড়াও হয়ে মেয়েদের ইজ্জত লুটেছে। দেশভাগ পর্বে বাংলাদেশের এক অংশের মেয়েদের শরীরের তল্লাশ করেছে অন্য অংশের বাঙালি। কত মেয়েকে অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের দায়ে নিজেকে শেষ করে দিতে হয়েছে। এসব ইতিহাস যোগ্য গবেষকের কলমে একদিন উঠে আসবেই। বাঙালি যেন ভিতর থেকে অহিংসার সাধনা করতেই শেখেনি।
অহিংস পথে প্রতিবাদ করাটা খুব কঠিন। মনের ভিতর থেকে সব রকমের হিংসা দূর করাটা সাধনা সাপেক্ষ। আমি তোমার কাজের বিরুদ্ধে বলছি, ব্যক্তি তোমার প্রতি আমার কোনো বিরোধিতা নেই, এমনকি তোমার ব্যক্তিসত্তার প্রতি ঘৃণাটুকু পর্যন্ত নেই, এই হল অহিংস মূল্যবোধ। এর যে মহত্ত্ব, সাধারণ অল্পমেধা অস্থিরচিত্ত ব্যক্তির পক্ষে তা কল্পনা করাও কঠিন। সেদিন যে এ রকম কিছু ঘটে নি, ভাবতে ভাল লাগে শ্যামলীর। তাকে কালো গাড়িতে করে পুলিশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে দেখে বীরপুরুষেরা এদিকে ওদিকে কেটে পড়েছিল। যদি সময় মতো পুলিশের গাড়ি তাকে তুলে না নিত, যদি মাথা গরম কোনো লোক রামনারায়ণের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিত, পুলিশ গুলি চালানোর ছুতো পেয়ে যেত। আর বাংলাদেশের পুলিশের যা হাতযশ, হাঁটুর নিচে গুলি করলে তার গুলি প্রায়শই গিয়ে লাগে খুলিতে বা কলজেয়। পরিস্থিতিটা ভাবলেই শ্যামলীর মাথা ঘুরতে থাকে। আজ তাই খুব ভেবে চিন্তে সে একা। একা হওয়া কখনো কখনো ভাল। তাতে অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণে থাকে।
সত্তর দশকের কৃষক অভ্যুত্থান বিপথগামী যুবকদের হাতে পড়ে ট্রিগার হ্যাপি পুলিশকে সুযোগ করে দিয়েছিল। আন্দোলন দরকার, আরো দরকার আন্দোলন যাঁরা করবেন, তাঁদের রাজনৈতিক শিক্ষা। কেন আন্দোলন করছি, কার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি , মেধাগত ভাবে এটা না বুঝে, অহিংস রুচিকে অভ্যাসগত স্তরে আয়ত্ত্ব না করে, লড়াইয়ের ময়দানে গরিব মানুষকে নামিয়ে দেবার মতো হঠকারিতা আর নেই। কলেজের ছাত্র, কমবয়সী অধ্যাপক, এমনকি স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্রকে পর্যন্ত টেনে বের করে খুন করতে লজ্জা বোধ করে নি সিদ্ধার্থবাবুর পুলিশ। এই সিদ্ধার্থবাবু লোকটা নাকি আবার দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নাতি। ভাবতে ভাবতে হাসি পায় শ্যামলীর। আর সিপিএমের প্রমোদ দাশগুপ্তের কথাও কানে বাজে তার। লোকটা বলেছিল, পুলিশের বন্দুকে কি নিরোধ পরানো ছিল? ইশশ, লোকটার ভাষা যতোটা না কুরুচিকর, ইঙ্গিতটা অনেক বেশি। পুলিশ যদি জনতার উপর গুলি ছোঁড়ে, তাতে এই ধরনের লোকের মনে কষ্ট হয় না। এরা নাকি কমিউনিস্ট দলের উচ্চ পর্যায়ের তাত্ত্বিক নেতা!
সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের পুলিশ শত শত তাজা তরুণ নওজোয়ান ছেলেকে নির্লজ্জভাবে খুন করার মওকা পেয়ে গেল কৃষক অভ্যুত্থানের আগুনখেকো নেতাদের নির্বুদ্ধিতার জন্য। সাধারণ মুদি ব্যবসায়ী, গাঁ ঘরে প্রতিষ্ঠিত গোলদারি কারবারী, এমনকি পুলিশের সামান্য কনস্টেবল, এই গোত্রের লোকজনকে শ্রেণিশত্রু আখ্যা দিতে পারে একমাত্র নির্বোধেরা। বিদ্যাসাগর মশায়ের মতো মানুষের মূর্তির মুণ্ডপাত করে আহ্লাদে আটখানা হতে পারে তারা, যাদের মাথায় গোবর পোরা। বিবেচনা শক্তিতে দুর্বল, আচার আচরণে বালখিল্য, অনভিজ্ঞ নেতৃত্বের জন্যই সিদ্ধার্থ রায়ের জল্লাদ বাহিনী খুনের অজুহাত পেয়ে গেল। একশ্রেণির বামপন্থী নেতৃত্ব যে এই হত্যাকাণ্ডে পুরোপুরি নির্লিপ্ত ছিল না, তা ইতিহাস একদিন অনাবৃত করে দেবে।
যে দেশের মানুষ লটারির টিকিট কেটে বড়লোক হবে বলে স্বপ্ন দ্যাখে, যে দেশের লোকে সঞ্চয়িতার মতো চিটফান্ড খুব অল্পদিনের মেয়াদে টাকা ডবল করে দেবে বলে বিশ্বাস করে, যে দেশে কন্যাসন্তান হলে বাড়ির লোকজন কান্নাকাটি করে, যে দেশে মেয়েরা বাড়ির পুরুষের হাতে নিয়মিত মার খায়… ভাবতে ভাবতে শ্যামলীর যেন দম আটকে গেল। রাস্তার ধারে একটা গাছের গায়ে হাত রেখে কোনো মতে সামলালো নিজেকে। কি হল তার? তার অন্তরাত্মা তাকে মনে করিয়ে দিল, সে নিজেও বাড়িতে বাবা মায়ের চোখের সামনে সহোদর দাদার হাতে কিল ঘুঁষি খেয়েছে। তার কোনো বিচার হয়নি। তার বাবাকে সবাই চেনে দয়ালু মানুষ বলে। বাপের সামনে মেয়ের গায়ে হাত উঠল। বাপ টুঁ শব্দ করে না। গোবিন্দর ভাইঝির অস্বাভাবিক মৃত্যু হল, গোবিন্দর দাদা বউদি জামাইকে কিছু বলে না।
শ্যামলী দেখল আনমনে নিজের সাথে বকতে বকতে সে চলে এসেছে রামনারায়ণ সিংহের বাড়ির গেটের কাছে। সহসা ঘোমটা দিল সে। বেশ টেনে একটা ঘোমটা। একগলা ঘোমটা যাকে বলে। ঘোমটা দেখে দারোয়ান কিছুই জিজ্ঞাসা করল না। সটান ঢুকে যেতে কোনো অসুবিধা হল না শ্যামলীর। সোজা ভিতরে ঢুকে সে দেখল অফিস ঘরে একা রামনারায়ণ সিংহ চেয়ারে বসে খবরের কাগজের উপর ঝুঁকে পড়ে একমনে কি যেন পড়ছে।
নীরবে ঘরে ঢুকে টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়াল শ্যামলী। তাকে চেয়ে দেখেই ভূত দেখার মতো করে চমকে উঠল রামনারায়ণ সিংহ, লোহার ছাঁটের কারবারী, এলাকার ত্রাস রামনারায়ণ মাফিয়া।
ক্রমশ…