শশাঙ্ক পাল বললেন, হেড মিস্ত্রিকে কাজে লাগিয়ে নিবি। একবার একটা ভুল করেছে বলে তাড়িয়ে দেওয়া ঠিক নয়। ও তবু ক্যাশবুক লিখতে পারে। অন্যগুলো তো কিছুই বুঝবে না।
শ্যামলী মাথা নিচু করে শুনে গেল। তারপর বলল, আমি খুব কম পুঁজিতে কারবার চালাচ্ছি বাবা। লোকসান গুনতে হলে বড় কষ্ট পাব।
শশাঙ্ক পাল বললেন, ওই হেডমিস্ত্রিকে একটু চোখে চোখে রাখবি। আর শোন্, ওই রাম নারায়ণকে কিছু বলার দরকার নেই। পুজোর মধ্যে ঝামেলা পোহাতে ভাল লাগবে না।
শ্যামলী তার বাবাকে কি একটা বলতে গেল এমন সময়ে ফোন বেজে উঠল। বাবার ঘরেই ফোন ধরার ব্যবস্থা আছে। প্যারালাল লাইন। ফোন ধরেই শ্যামলী বুঝতে পারল তার কলেজের অধ্যাপক করবী মিত্রের ফোন।
অধ্যাপক মিত্র প্রথমেই তাকে বকাবকি শুরু করলেন। সেদিন আমায় না বলে চলে গিয়েছিলি কেন রে?
শ্যামলী বলল, আমাদের কারখানায় একটা ঝামেলার জন্য উকিল বাড়ি গিয়েছিলাম। তার আগে ব্যাঙ্কে যাবার কাজ।
করবী মিত্র বললেন, আচ্ছা সে না হয় হল, তুই বক্তৃতা করে কলেজকে ফার্স্ট প্রাইজ এনে দিবি , সবার এমন আশা ছিল।
শ্যামলী বলল, আমি ওই জন্যে বলতে উঠতে চাই নি। প্রিন্সিপাল ম্যাম আমাকে বকে ধমকে স্টেজে উঠিয়ে ছাড়লেন।
অধ্যাপক মিত্র বললেন, তোর ওপর সবাই আশা করে। গুছিয়ে বলতে পারিস। তাই করে।
শ্যামলী বলল, কিন্তু ম্যাম, আমি এখন আর অন্যের শেখানো কথা তোতাপাখির মতো বলতে পারি না। আমার নিজের ভিতরে যুক্তি জেগে উঠে আমায় দিয়ে বলিয়ে নেয়। আমার নিজস্ব চিন্তাকে পাশ কাটিয়ে কথা বলতে পারি না আমি।
অধ্যাপক মিত্র বললেন, খুব পাকা পাকা কথা বলতে শিখে গিয়েছিস। শোন্ ভাল কথা, প্রফেসর সান্যাল তোকে খুব খুঁজেছিলেন। তোকে কিছুতেই পাওয়া গেল না বলে, আমরা খুব অপ্রস্তুত হলাম।
শ্যামলী বলল, ম্যাম, প্রফেসর সান্যাল বলতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই বিজ্ঞানী? উনি আমাকে খুঁজেছিলেন?
অধ্যাপক মিত্র বললেন, হ্যাঁ। উনি বললেন, এই একটা মেয়েই বিজ্ঞানপড়ুয়ার মতো করে কথা বলল। তুই কমপিটিশনে স্ট্যাণ্ড করিস্ নি ঠিকই, তবে প্রফেসর সান্যাল বিচারকদের পথে বসিয়ে দিয়ে গেছেন। বলেছেন, অনেক ন্যায্য আর যুক্তিসঙ্গত কথাও সম সময়ে আদর পায় নি। গ্যালিলিওকে শাস্তি দিয়েছে, ডারউইনকে ক্যারিকেচার করেছে। হাততালির পরিমাণ দিয়ে বিজ্ঞানের সত্যাসত্য বিচার হয় না। অবশ্য তার আগে ওঁর হাত দিয়েই পুরস্কার দেওয়ানো হয়ে গিয়েছে। তোকে উনি নিজেই পুরস্কার দেবেন বলছিলেন। তখন প্রিন্সিপাল ম্যাম বললেন, আচ্ছা, ওকে আমরা একটা সান্ত্বনা পুরস্কার দিয়ে দেব’খন। উনি বলে গেলেন তোকে যেন ওঁর বাড়ি যেতে বলি আমরা। প্রিন্সিপাল ম্যাম আমাকে বলেছেন তোকে সাথে করেই ওঁর বাড়ি নিয়ে যেতে। কবে যাবি?
শ্যামলী বলল, উনি আমাকে খুঁজেছেন, আবার ওঁর বাড়ি পর্যন্ত যেতে বলেছেন, এটা আমার বিশাল প্রাপ্তি। কিন্তু একবার যেতে বলেছেন বলেই হ্যাংলার মতো ওঁর বাড়ি ছুটব?
করবী মিত্র বললেন, ছুটবি মানে? এমন একটা সুযোগ পেলে লোকে ধন্য হয়ে যায়, আর তুই যেন কী!আচ্ছা বোকা তো তুই? তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে আজই চ?
শ্যামলী কাকুতি মিনতি করতে তিনি বললেন, কাল সকালে অবশ্যই যেতে হবে। লক্ষ্মী পুজোর দিন উনি কানাডা চলে যাবেন। সেখানে ওঁর ছেলে থাকে। কালই যাব আমরা। কেমন! আমার সাথেই তুই যাবি। তারপর বললেন, একটা বলতে ইচ্ছে করছে, তবে তোকে বলা আর একটা দেয়ালকে বলা তো সমান। আজকের একটা ইংরেজি কাগজে আমাদের কলেজের অনুষ্ঠানের ছবি বেরিয়েছে। খবর বলতে বিশেষ কিছু লেখেনি। কিন্তু ছবিটা অনেক বড়সড় ছেপেছে। অনেকেই লক্ষ্য করে আমায় ফোন করেছে।
শ্যামলীর মনে পড়ল অরিন্দম দাশগুপ্ত সকালে এই খবরটাই তাকে দিয়েছিলেন। অধ্যাপক মিত্রের দেওয়া খবরের উত্তরে সে শুধু বলল, তা সে তো বেশ ভাল কথা।
অধ্যাপক মিত্র বললেন, ভাল কথা মানে? তুই তো এখন সেলিব্রিটি রে! প্রফেসর সান্যাল উঠে এসে তোকে জড়িয়ে ধরেছেন, সেই ছবি। তোকে ভালভাবে বোঝা যাচ্ছে।
শ্যামলী ম্লান হেসে বলল, অত বড়ো বিজ্ঞানী এসেছিলেন বলেই কাগজে ছবি ছেপেছে।
করবী মিত্র বললেন, নির্বিকার নিরাসক্ত বলে একটা কথা আছে। তোর সাথে কথা বললে সেটা বোঝা যায়। আচ্ছা, তুই কি পেঁপে সিদ্ধ দিয়ে ভাত খাস?
শ্যামলী হেসে বললো, যেদিন মা যেমন জোটাতে পারেন, তাই খাই।
অধ্যাপক মিত্র বললেন, শ্যামলী, তাহলে ওই কথা রইল। আমরা আটটায় বের হব। অনেকটা সময় লাগবে।
শ্যামলী বলল, ম্যাম, কাল সপ্তমী পূজা, ওঁর বাড়ি গেলে ওঁর অসুবিধা হবে না?
করবী মিত্র বললেন, শোন্ শ্যামলী, উনি বিজ্ঞানী। সারাক্ষণ ল্যাবরেটরি আর বইপত্র নেড়েচেড়ে কাটে। ঠাকুর দেখা, পূজাপাঠ এসবের ধার ধরেন না। তারপর বললেন, আচ্ছা, এখন রাখ্। কাল দেখা হচ্ছে।