• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৪৪)

পর্ব – ৪৪

৪৩
টেবিল চেয়ারে খেতে বসেছেন রমানাথ ও তার বাবা নকুড় নন্দী । নকুড়বাবুর স্ত্রী ওঁদের সাথে এক টেবিলে বসতে চান নি। মা তাঁর নিজের ঘরে ওঁকে খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছেন । শশাঙ্ক পাল অতিথিদের সাথেই টেবিলে বসে গিয়েছেন। শ্যামলী সবিতার পরিচালনায় খাবার টেবিল সাজিয়েছে। আর দাঁড়িয়ে রয়েছে অতিথিদের কাছে। সে লক্ষ্য করলো নকুড়বাবু খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন, কিন্তু কিছুই খাচ্ছেন না। রমানাথ কে সে চোখের ইশারায় সে কথা বলতে রমানাথ দুষ্টুমি করে তার বাবাকে বললো “বাবা, তোমাকে শ্যামলী কি বলতে চায় দ্যাখো।“
নকুড় বললেন, “ কি বলবে বলো ।”
শ্যামলী বললো “জ্যেঠু, আপনি কিন্তু কিছু খাচ্ছেন না, খালি নাড়াচাড়া করছেন। এ রকম করলে কিন্তু আমি রাগ করবো।“
নকুড় বললেন, “ দ্যাখো মা, গুরুদেবকে আমরা পিতার অধিক মনে করি। তাঁর এ রকম একটা দুর্বিপাক হলে আমরা খাবার খাই কি করে?”
শ্যামলী বললো “তা হলে আপনি না খেলে আপনার গুরুদেব ছাড়া পেয়ে যাবেন?”
নকুড় বললেন, “ তুমি তো জানো, এ রকম পরিস্থিতিতে খাবার মুখে রোচে না।”
শ্যামলী বললো “তা হলে আপনি হিন্দুধর্ম মানেন না।“
শ্যামলী দেখলো হাসিমুখে রমানাথ তার দিকেই অপলক চেয়ে আছে। সে দিকে একবার অপাঙ্গে তাকিয়ে নিয়ে শ্যামলী বললো “অন্নই ব্রহ্ম , এমন একটা কথা শাস্ত্রে আছে। আপনি অন্নগ্রহণ না করলে, ব্রহ্মকে কষ্ট দেওয়া হয়। তা ছাড়া হিন্দু ধর্মে এই যে দৈহিক কষ্ট এগুলিকে মায়া বলা হয়েছে। আত্মার কথায় আপনার শাস্ত্র বলেছেন, ইনি জন্মান না, মরেনও না। জ্যেঠু, আপনি শাস্ত্র মানলে কষ্টবোধ হতে নিজেকে মুক্তি দিন।“
নকুড় নন্দী একটু ম্লান হেসে বললেন, “মা, আমি তোমার কথায় একমত হলাম না। হিন্দু শুধু আমার ধর্ম? এ তো তোমারও ধর্ম ! আমাদের সনাতনী ধর্মের আশ্রয়ে তুমি আমি সবাই যে আশ্রয় পেয়ে ধন্য হয়েছি।“
“ জ্যেঠু, আমি কিন্তু হিন্দুধর্মের কেউ নই। জপ তপ পূজা পার্বণ , এ সবের সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই।“ শ্যামলী সবে এটুকু বলেছে, এমন সময়ে ঝড়ের বেগে তনুশ্রী এসে ঢুকল খাবার ঘরে। বোনের দিকে রোষপূর্ণ চোখে তাকিয়ে বললো, “ তা তুমি হিন্দুধর্মের কেউ হবে কেন? যতো রাজ্যের আজেবাজে লোকের সাথে মিশে তুমি তো উচ্ছন্নে গিয়েছ। তোমাদের মতো অপদার্থের জন্যেই তো আমাদের গুরুদেবের এই অবস্থা।“ বাবার দিকে চেয়ে একটা প্রচণ্ড ধমক দিয়ে তনুশ্রী বললো “তুমি, এই তুমিই লাই দিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে বাঁদর বানিয়েছ।“
রমানাথের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। সে তনুশ্রীর দিকে চেয়ে বললো “আপনি তো চমৎকার কথা বলেন! “ মুহূর্তে মিইয়ে গিয়ে তনুশ্রী বললো “দেখুন, আমি খেয়াল করি নি যে, আপনি এখানে আছেন। তা ভালো আছেন তো?”
দুষ্টুমি করে রমানাথ বললো, “ভালো আর থাকি কি করে দিদিমণি, এই আপনার উচ্ছন্নে যাওয়া, অপদার্থ , বাঁদর বোনটার মন জয় করবো বলে এসেছিলাম। তা বোধ হয় আর হলো না। সে গুড়ে থান ইট । “
“কেন মশাই, আমার বোনকে কি পছন্দ হয় নি?” তনুশ্রী কথা ঘোরাতে চায়।
রমানাথ বললো, “পছন্দ তো আমার খুব আছে। কিন্তু উনি আমায় পছন্দ করবেন কি না, সেটাই আমার উদবেগের বিষয় । অমন উচ্ছন্নে যাওয়া, অপদার্থ, বাঁদর তো আমি এখুনি হয়ে উঠতে পারছি না!”
তনুশ্রী রমানাথকে দলে টানতে চেয়ে বলে, “আপনিই বলুন না রমানাথ, বাঙালি ঘরের মেয়ে এত ডাকাবুকো হওয়া ভাল? একটু দেব দ্বিজে ভক্তি, সকাল সন্ধ্যে একটু ঠাকুরসেবা না হলে কি হিন্দুর মেয়ের মানায়?”
“দিদি, আপনি হিন্দু চাইছেন, না বাঙালি?”
তনুশ্রী একটু বিরক্ত হয়ে বললো, “তার মানে?”
“মানেটা অতি সরল। বাঙালি বললে, বাঙালি মুসলমান , বাঙালি খ্রিস্টান, সবাইকে বোঝায়। আর হিন্দুর কথা যদি বলেন পশ্চিমা ব্রাহ্মণরা মছলিখোর বলে বাঙালি হিন্দুকে খুব অপছন্দ করে। তা আপনি কি রকম চান?”
“দেখুন রমানাথ, দিদি বলে ডেকেছেন, ভাইকে শাসন কিন্তু আমি করতে জানি।“
উত্তর যেন ঠোঁটে গোছানো ছিল রমানাথের। হাসিমুখে বললো “একতরফা শাসন হলে মানব কেন দিদি, সোহাগও মেশাতে হবে।“
বাবার দিকে ঘুরে তনুশ্রী বললো, “বাবা, বাজে কথায় সময় নষ্ট করার জন্যে আমি আসি নি। তোমার জামাইকে নিয়ে আমি চলে এসেছি, গুরুদেবের জন্য কি করবে ভাবছো?”
হতাশ গলায় শশাঙ্ক পাল বললেন, “তনুশ্রী, আমায় হিসেব থেকে বাদ দে মা, আমার আর কিছু করার নেই।“
রমানাথ বললেন “ দিদি, আপনি কি করতে বলেন? মার্চ পাস্ট করতে করতে উত্তর প্রদেশে যাবো, আর তার পর গুরুদেবকে কেড়ে নিয়ে আসবো, তাই তো?”
রাগ করে তনুশ্রী বললো, “ শুনুন রমানাথ, আপনার ছ্যাবলামির উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই। একটা মানী মানুষ একটু বেকায়দা হয়েছেন। তাঁকে বাঁচাবো , এই তো জানি।“
রমানাথ বললো “তা আপনার গুরুদেব যখন এতই মানী, তা হলে আইনের আশ্রয়ে নিজেকে তিনি নির্দোষ প্রমাণ করুন। সে জন্যে উকিলবাবু আছেন। এই রাত বিরেতে মাথা খারাপ করার দরকার কি?”
রুক্ষ স্বরে তনুশ্রী বললো “মাথা যার থাকে, তার সময়ে সময়ে একটু খারাপ হয় রমানাথ।“
“তা দিদি, আপনি নিজে মুখে যদি বলেন আপনার এখন মাথা খারাপ আছে, আমি আর প্রতিবাদ করি কি করে !”
বিতর্ক থামালেন নকুড় নন্দী স্বয়ং। গম্ভীর স্বরে বললেন, “যার কাজ তিনি ঠিক করিয়ে নেবেন। তুমি আমি নিমিত্ত মাত্র। “
রমানাথ বললো, “এই তো বাবা, গীতায় চলে এসেছ। এবার বাড়ি চল। রাতে ঘুমোতে হবে। দেখি কাল সকালে কী হয়।“ তনুশ্রীর দিকে তাকিয়ে বললো “দিদিমণি, অনুমতি করুন, এবার বাড়ি যাই?”
তার দিকে একটা কঠোর দৃষ্টি হেনে তনুশ্রী অন্য ঘরে চলে গেল।
বাসন্তীবালা নকুড় নন্দীকে আবদারের সুরে বললেন “দিদিকে মাঝে মধ্যে পাঠিয়ে দিলে দু’ বোনে বেশ ভাল সময় কাটে।“
নকুড় বললেন, “তা সে তো মন করলেই গুরুবোনের কাছে আসতে পারে।“
নকুড় গিন্নি লজ্জা পেয়ে বললেন, “তা ভাই, তুমিও তো আসতে পারো। ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গিয়েছে, এখন আর চিন্তা কি?”
একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বাসন্তীবালা বলেন, “ছেলে দুটো নামেই বড় হয়েছে। কেবল বলখেলার নামে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। বাবার কারবার দেখার দিকে মোটে মন নেই। সব দায় এই মেয়েটার ঘাড়ে। আমি যে কি করি?”
নকুড় গিন্নি অবাক হয়ে বলেন, “সে কি কথা, ছেলেরা বাবার কারবারে সময় দেয় না? মেয়েকে কাজ দেখতে হয়!”
শশাঙ্ক মাথা নিচু করে বলেন, “যাকে যেমন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয় বউদি।“
বাসন্তীবালা শ্যামলীকে ইঙ্গিত করলেন নকুড়কে প্রণাম করতে। শ্যামলী বুকের কাছে দুটো হাত জড়ো করে সামান্য ঝুঁকে সম্মান জানাল।
বাসন্তীবালা কটমট করে তাকালেন। সেদিকে লক্ষ্য করে রমানাথ বললেন, “কাকিমা, প্রীতি প্রণাম নমস্কারটা স্বাভাবিক ভাবে আসতে দিতে গেলে একটু সময় লাগে। আমরা অনেক সময়েই ও যেভাবে করল, সেভাবেই প্রণাম করি। এতে কোনো সমস্যা নেই।“ এই বলে সে নিজেও বুকের কাছে হাত জড়ো করে নমস্কার জানালো। তারপর নকুড়ের উদ্দেশে বললো, “বাবা, আর দেরি করা ঠিক হবে না।“
নকুড়বাবুর গাড়ি শ্যামলীদের বাড়ির রাস্তা ছেড়ে যাওয়া অবধি সে দরজায় দাঁড়িয়ে রইলো। এমন সময় কে পিঠে টোকা মারতে চমকে শ্যামলী দেখলো সবিতা দাঁড়িয়ে আছে। মুখে চোখে হাসি ছড়ানো।

“কি রে, ছেলেটাকে মনে ধরেছে?”
শ্যামলী তাকে ভেংচি কেটে পালিয়ে গেল।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।