• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সিদ্ধার্থ সিংহ (পর্ব – ৫)

২০১২ সালের 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। ১৯৬৪ সালে। ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ই তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় 'দেশ' পত্রিকায়। প্রথম ছড়া 'শুকতারা'য়। প্রথম গদ্য 'আনন্দবাজার'-এ। প্রথম গল্প 'সানন্দা'য়। যা নিয়ে রাজনৈতিক মহল তোলপাড় হয়। মামলা হয় পাঁচ কোটি টাকার। ছোটদের জন্য যেমন সন্দেশ, আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী, চির সবুজ লেখা, ঝালাপালা, রঙবেরং, শিশুমহল ছাড়াও বর্তমান, গণশক্তি, রবিবাসরীয় আনন্দমেলা-সহ সমস্ত দৈনিক পত্রিকার ছোটদের পাতায় লেখেন, তেমনি বড়দের জন্য লেখেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এবং মুক্তগদ্য। 'রতিছন্দ' নামে এক নতুন ছন্দের প্রবর্তন করেছেন তিনি। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুশো চুয়াল্লিশটি। তার বেশির ভাগই অনুদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। বেস্ট সেলারেও উঠেছে সে সব। এ ছাড়া যৌথ ভাবে সম্পাদনা করেছেন লীলা মজুমদার, রমাপদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মহাশ্বেতা দেবী, শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, নবনীতা দেবসেন, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে। তাঁর লেখা নাটক বেতারে তো হয়ই, মঞ্চস্থও হয় নিয়মিত। তাঁর কাহিনি নিয়ে ছায়াছবিও হয়েছে বেশ কয়েকটি। গান তো লেখেনই। মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করেছেন বেশ কয়েকটি বাংলা ছবিতে। তাঁর ইংরেজি এবং বাংলা কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কয়েকটি সিনেমায়। বানিয়েছেন দুটি তথ্যচিত্র। তাঁর লেখা পাঠ্য হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদে। ইতিমধ্যে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, সন্তোষকুমার ঘোষ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, নতুন গতি পুরস্কার, ড্রিম লাইট অ্যাওয়ার্ড, কমলকুমার মজুমদার জন্মশতবর্ষ স্মারক সম্মান, কবি সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা।

এইবার লিখব

পাঁচ

তপন পুস্তক ভাণ্ডার থেকে রূপসী নিয়ে বাড়ি এসেই প্রাপ্তি সংবাদ পাঠিয়েছিল প্রতাপ। মাননীয় সম্পাদক মহাশয় সমীপেষু…
দশ দিনও পেরোয়নি ও দিক থেকে একটা পোস্ট কার্ড এসে হাজির। সেই প্রথম, আগে যে দুটো চিঠি পেয়েছিল, সেই দুটোই ছিল ছাপানো। এ বার এল খোদ সম্পাদকের একেবারে হাতে লেখা চিঠি। এবং তার থেকেও বড় কথা, কোনও জবাবি খাম না পাঠিয়েই এই প্রাপ্তি।
সম্পাদকের চিঠি বলে কথা, আর কালক্ষেপ করেনি প্রতাপ। দু’পাতা জুড়ে সে তার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল। লিখেছিল, রূপসী যে এত ভাল হবে, তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। এমন একটা পত্রিকায় লিখতে পেরে আমি ধন্য। আপনাকে যে কী বলে সাধুবাদ জানাব, আমি কোনও ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। আপনার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ রইলাম।
এই চিঠি পাঠানোর ক’দিন বাদেই আবার এসেছিল বৃন্দাবন করের চিঠি।
সেই শুরু। তার পর কত যে চিঠি চালাচালি হয়েছিল, প্রতাপ তখনই প্রথম জেনেছিল, বৃন্দাবনদা তার থেকে বছর পনেরো-ষোলোর বড়। প্রথম প্রথম ছড়া কবিতা লিখতেন। দু’-চারটে ছাপাও হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ কাগজই নাকি সদস্য হলেও নিজেদের গোষ্ঠীর বাইরের কারও কোনও লেখা সে ভাবে ছাপতে চায় না। অথচ সদস্য করার সময় বলে, সদস্য হলেই প্রত্যেকটা সংখ্যায় লেখা ছাপা হবে। কিন্তু উনি ওঁর অভিজ্ঞতা থেকে নাকি জেনেছেন, মুখে যতই বলুক না কেন, আসলে বছরে ওই একবার কি দু’বারই ছাপে।
কেন, এই সংখ্যায় ছাপলেন না? জানতে চাইলেই বলে, আসলে আপনি যে লেখাটা পাঠিয়েছিলেন, সেটা ঠিক সে রকম জুতসই হয়নি বলে ছাপতে পারিনি। খারাপ লেখা ছাপলে শুধু পত্রিকারই বদনাম হবে না, পত্রিকার পাশাপাশি আপনারও বদনাম হবে। আর যেহেতু আপনি আমাদের পত্রিকার লেখক-সদস্য, আমরা কখনওই চাইব না, আপনার লেখা নিয়ে কেউ খারাপ কোনও মন্তব্য করুক। তাই এই সংখ্যায় আপনার লেখা আমরা ইচ্ছে করেই রাখিনি। আরও কয়েকটা লেখা পাঠান। ভাল হওয়ার দরকার নেই। ছাপার মতো হলেও পরের সংখ্যায় আমরা ছেপে দেব।
কিন্তু এই পরের সংখ্যাটা আর কোনও দিনই আসে না। হয় প্রথম, দ্বিতীয় বা খুব বেশি হলে তৃতীয় সংখ্যা বেরোনোর পরেই পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। কিংবা আজ বেরোচ্ছে, কাল বেরোচ্ছে করে এত দিন পার করিয়ে দেয় যে, মাসিক, দ্বিমাসিক কিংবা ত্রৈমাসিক নয়, ওটা বছরে একটা কি দু’বছরে একটা সংখ্যা কোনও রকমে বেরোয়।
তাই উনি এই রূপসী বের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যাতে তাঁর নিজের লেখা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের মতো বঞ্চিতদেরও লেখা সেখানে নিয়মিত ছাপা যায়। সাহিত্যের সত্যিকারের একটা প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে। কিন্তু তাঁর একার পক্ষে তো একটা কাগজ একদম নিয়ম করে বের করা সম্ভব নয়। লেখা জোগাড় করা, প্রেসে ছুটোছুটি করা, প্রুফ দেখা, ব্লক তৈরি করা, দু’-একটা বিজ্ঞাপনের জন্য এঁকে-তাঁকে ধরা, কাগজ বেরোনোর পর স্টলে স্টলে পৌঁছে দেওয়া না-হয় আমি একাই সামলালাম, কিন্তু এই বিপুল খরচ? সেটা আসবে কোথা থেকে? তাই যারা যারা এখানে লিখতে আগ্রহী, তাদের আগাম বাৎসরিক সদস্য করে তাদের চাঁদা নিয়েই শুরু করেছি এই কর্মযজ্ঞ। আসলে একজনের কাছে যেটা পাহাড়-সমান, পাঁচ জনে মিলে সেটা ভাগ করে নিলে একটা নুড়ি পাথরও নয়, তাই…
তিনিই লিখেছেন, কিছু দিন আগে তাঁর একটি দীর্ঘ কবিতা পড়ে, সেই কবিতায় কাহিনির ঘনঘটা দেখে কে নাকি তাঁকে বলেছেন, তাঁর হাতে উপন্যাস আছে। উনি যদি উপন্যাস লেখেন, অনেক তাবড় তাবড় লেখকদের ঘুম কেড়ে নেবেন। তাই তিনি একটু-আধটু গল্প এ দিক সে দিক ছোটখাটো লিটিল ম্যাগাজিনে লিখলেও, আসলে তাঁর পরিকল্পনা আছে বড় বড় কাগজে উপন্যাস লেখার। তবে এই মুহূর্তে হচ্ছে না। তাঁর বাবা নাকি তাঁকে বলেছেন, ওই লেখালেখি, পত্রিকা-টত্রিকা সব পরে হবে। আগে নিজের পায়ে দাঁড়া।
বৃন্দাবন সে সময় লিখেছিল, আমিও ভেবে দেখলাম, বাবার কথাই ঠিক। টাকা না থাকলে কিছুই করা যাবে না। আর আমার কাছে যদি টাকা থাকে, কারও কোনও সদস্য চাঁদাই লাগবে না। আমি মাইনে থেকে কিছু কিছু টাকা জমিয়েই পত্রিকা বের করতে পারব। কে কবে বাৎসরিক গ্রাহক চাঁদা পাঠাবে সে জন্য হা-পিত্যেস করে বসে থাকতে হবে না। তাই চাকরির নানা পরীক্ষার জন্য এখন নিজেকে তৈরি করছি। চাকরিটা পেয়ে গেলেই, ব্যস… তখন আমাকে আর কে পায়, পারলে দু’হাতে লিখব।
প্রতাপ লিখেছিল, না, সে তো ঠিকই বলেছেন। কিন্তু একটা পত্রিকার প্রথম সংখ্যা বেরিয়েই যদি বন্ধ হয়ে যায়, সেটা কি বাংলা সাহিত্যের পক্ষে একটা ভয়ঙ্কর ক্ষতি নয়? যখন পত্রপত্রিকার ইতিহাস লেখা হবে, তখন গবেষকেরা কী লিখবেন? লিখবেন, রূপসী পত্রিকার আত্মপ্রকাশ সংখ্যা বেরিয়েই মুখ থুবড়ে পড়েছিল। কেন না, স্বয়ং সম্পাদকই পত্রিকার কথা ভাবেননি। শুধু নিজের কথা ভেবেছেন। একটা চাকরি পাওয়ার জন্য, নিজের সুখ-সাচ্ছন্দের জন্য পত্রিকাটিকে আঁতুড়ঘরেই গলা টিপে হত্যা করেছেন। এটা শুনতে কি আপনার ভাল লাগবে? চাকরির জন্য নিজেকে তৈরি করছেন, খুব ভাল কথা। কিন্তু তার মধ্যে থেকেই একটু সময় বের করে কি পত্রিকাটিকে মৃত্যুর হাত থেকে কোনও ভাবে রক্ষা করা যায় না? একবার ভেবে দেখবেন।
প্রতাপ ভেবেছিল, বৃন্দাবনদা নিশ্চয়ই তার পরামর্শ একবার ভেবে দেখবেন। এবং যতই চাপ থাক, শেষ পর্যন্ত ঠিকই রূপসী বের করবেন।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।