• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৩৮)

পর্ব – ৩৮

১৩৭
বাবা, তোমাকে আমি ফলটা খাইয়ে দিই?
খাইয়ে দিবি? তা দে ।
বিছানায় বসে পিঠে বালিশ দিয়ে আধশোয়া হয়ে থাকেন শশাঙ্ক পাল।
বাবা, এখন শরীর তোমার অনেকটা ভালো আছে। একবার চেষ্টা করে দ্যাখো না, কারখানা দু এক ঘন্টার জন্যে বসতে পারো কি না?
“সে কি রে? আমি তো তোকে সব দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছি। কারখানা এখন তোর হাতে।“
“না বাবা, সে বললে হবে না। আমি কি রকম চালাচ্ছি, একটু দেখে দাও। “
“তুই তো ভালোই চালাচ্ছিস। নিয়মিত ব্যাঙ্কে টাকা জমা করছিস। স্টক মেলাচ্ছিস। তোর মা যদি সংসারের পাশাপাশি আমার সাথে কারখানাটা একটু দেখতো!”
বাসন্তী বালা রেগে উঠলেন। “হ্যাঁ, চার চারটে ছেলে মেয়ে মানুষ তো তোমায় করতে হয় নি, পেটেও ধরতে হয় নি। দিন রাত্তির গুরুদেবকে নিয়ে পড়ে থাকতে। বয়স হলে কোন লোকটা দীক্ষা না নেয় গো? কিন্তু তোমার মতো কারখানা ফেলে কেউ ধর্ম কর্ম করতে ছোটে না।“
শশাঙ্ক পাল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন।
শ্যামলী চোখের ইঙ্গিতে মাকে চুপ করে থাকতে বলে। বাবার দিকে তাকিয়ে বলে “বাবা, তুমি সেই ইউনিয়ন লিডারদের কতো রকম গল্প বলতে!”
“কি গল্প বলতাম রে?”
“মনে করো না বাবা! ঠিক মনে পড়বে।“
“আর মনে করতে ইচ্ছে করে না মা।“
বাবা, সেই যে তুমি বলতে, একেবারে ছোট পার্টির ইউনিয়ন লিডার পর্যন্ত মাসোহারার টাকা পেতে দু দিন দেরি হলে ফোন করে করে মাথা খারাপ করে দেয়!
“হ্যাঁ রে মা , নাছোড়বান্দার মতো ফোন করতো। আমাদের মতো ছোট ছোট কারবারিদের কাছেই ছোটখাট নেতারা মাসোহারা দাবি করতো। বড় নেতারা হয়তো বড় বড় কারবারিদের কাছে।“
“বাবা, এই সব রাজনীতির লোকেরা যে শ্রমিকের মুক্তিসংগ্রাম বলে এত কিছু করে, ওরা নিজেরা কি জানে না, এ সব ভুয়ো ?”
“হয় তো সব ভুয়ো নয় । হয়তো সত্যি একদিন ওরা ভেবেছিল বিপ্লব করবে।“
“তাহলে হল না কেন বাবা?”
“চাইলেই কি সব হয়ে যায় রে মা? এই যে তুই এত কিছু চাইছিস, যা ভাবছিস, তা কি পারছিস?”
“আমি তো সত্যি সত্যি চেষ্টা করছি বাবা। “
“ওরাও হয়তো করছে শ্যামলিমা। ওদের মতো করে করছে।“
“কিচ্ছু করছে না বাবা। তুমি জানো না, ওরা নিজেরা খুব জানে ওরা কি করছে। ওরা আসলে স্থিতাবস্থার পক্ষে ।“
ভ্রূ কুঁচকে মেয়ের দিকে তাকান বাবা। “স্থিতাবস্থার পক্ষে বলতে তুই কি বলতে চাস?”
“বাবা, ‘স্থিতাবস্থার পক্ষে’ বলতে যেমন আছে, তেমন টি থাকলেই আমার সুবিধে। সব কিছু তেমনটি থাকুক। তোমার মতো কারবারিরা, ট্রেড ইউনিয়ন লিডারেরা, তোমার গুরুদেবেরা, সাধু মহাত্মারা, পুলিশের ওপরঅলারা …।“ বলতে গিয়ে থমকে গেল শ্যামলী ।
“কি থামলি কেন? দুনিয়ার সবাই ওঁচা , আর তুমি খুব ভাল তাই না?” সবিতা পিসি যে এতক্ষণ ধরে তার প্রতিটি কথা মন দিয়ে শুনছিল, তা খেয়াল করে নি শ্যামলী ।
“কি ভাবিস তুই নিজেকে? ইন্দিরা গান্ধী?”
“পিসি, তুমি থামো। তোমার সঙ্গে কথা হচ্ছে না।“
শশাঙ্ক পাল ইঙ্গিতে থামিয়ে দেন সবিতাকে।
বাসন্তীবালাও ঝামরে ওঠেন সবিতাকে। “কতদিন পরে ওরা বাপ মেয়ে গল্প করছে। যা মনে আসে বলুক না কেন নিজেদের মধ্যে। তুই সব তাতে কথা বলিস কেন সবিতা?”
মুখ গোঁজ করে উঠে যায় সবিতা।
সেদিকে তাকিয়ে শক্ত হয়ে শ্যামলী বলে, “বাবা, আমি ইন্দিরা গান্ধীকে এশিয়ার মুক্তিসূর্য মনে করি না। এশিয়া মহাদেশ কেন, কোন ছোট দেশেরও মুক্তিসূর্য হতে পারতেন না তিনি।“
বাসন্তীবালা মেয়েকে সস্নেহে বলেন “জানিস, তোরা তখন হোস নি, আমাদের প্রতিমা দি তখন সবে হাসপাতালে নার্সের কাজ নিয়ে ঢুকেছে । একদিন বড় হাড়ি করে রসগোল্লা এনে সবাইকে খাওয়ালো। কেন, না কে একটা মেয়ে না কি প্রধানমন্ত্রী হয়েছে! আমি তো অবাক! মেয়ে আবার প্রধানমন্ত্রী? আমি তো কিছুই বুঝতাম না। ক্লাস এইটে উঠতে না উঠতে বাবা বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলেছিল।“
শশাঙ্ক পাল স্ত্রীকে চুপ করিয়ে দেন। “সে কথা থাক। কিন্তু কেন ইন্দিরাকে তুই মুক্তিসূর্য বলে মানবি না?”
“বাবা, ইন্দিরা গান্ধী গণতন্ত্রের কিছু জানেন না। অমন পণ্ডিত মানুষের মেয়ে হয়ে লেখাপড়ার একটা জিনিসও তিনি দেশে ফলাতে চান নি।“
“হ্যাঁ , কেউ কিছু জানে না। আর তুমি এই কচি বয়সে নিজেকে বিদ্যেধরী অপ্সরী ভাবতে শিখে গিয়েছো। এখনো সময় আছে, নিজেকে সামলা, নইলে জ্বলে পুড়ে মরবি তা বলে দিলাম।“
সবাই দেখলো সবিতা গাছকোমর করে শাড়ি জড়িয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।