দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৮)
by
·
Published
· Updated
পর্ব – ৮
৮৪
কলেজ থেকে বেরিয়ে পড়লো শ্যামলী । বন্ধুরা মজা করে বলেছিল একা একা বেরোচ্ছিস যে বড়? কোনো গোপন ব্যাপার?
মিষ্টি করে হেসেছিল সে। এখন এ কথা সে কাউকে বলতে পারবে না। বাসে উঠে সহজেই পৌঁছে গেল মহকুমা আদালতে। বাইরে থেকে দেখেছে অনেকবার। ভেতরে ঢোকা হয় নি। ভেতরে না ঢুকলে কিছুই জানা হয় না। কতকগুলো পুরোনো ধাঁচের বাড়ি। মাঝে বাঁশের কাঠামোয় কিছু ঘর । চতুর্দিকে অজস্র কালো গাউন পরা মানুষ। শ্যামলী জানে এরাই উকিল। কিন্তু এত ভীড়ের মধ্যে অরিন্দমের বলে দেওয়া আইনজীবীর সন্ধান পাবে সে কি করে?
একজন মহিলা আইনজীবীকে দেখতে পেয়ে জানতে চাইলো – মাদাম, অ্যাডভোকেট অনসূয়া চ্যাটারজি কোথায় বসেন। সে মহিলা মুখ বাঁকিয়ে চলে যেতে শ্যামলী এক পুরুষ আইনজীবীর কাছে জানতে চাইলো । তিনি ভদ্রতা করে অনসূয়া চ্যাটারজি যেখানে বসেন, সেখানে পৌঁছে দিলেন। শ্যামলী খানিক ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর অনসূয়া এসে পৌঁছলেন এবং তার পরেই টাইপিস্ট ও মুহুরিদের উপর হাঁক ডাক শুরু করলেন। শ্যামলীকে দেখে তিনি বললেন, কি আপনার কিসের মামলা?
শ্যামলী ধীর শান্ত স্বরে বললেন “ হয়তো আপনি অরিন্দম বাবুকে চেনেন ।“
হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি শ্যামলী ? ভারি মিষ্টি দেখতে তো ?
সকলের সামনে ভারি লজ্জা পেয়ে গেল শ্যামলীর । কি জানি অরিন্দম কি কি বলেছে মহিলাকে। কিছু না জেনেই বেশ একটু উদ্বিগ্ন হল সে।
একেবারেই ছেলেমানুষ দেখছি। মহিলার কথা শুনে এক মুহুরি বলল – ম্যাডাম , এটা কোর্ট , এখানে দায়ে পড়েই মানুষকে আসতে হয়। ওঁকে আগে উদ্ধার করুন। কি বলতে চান দেখুন।
ও হ্যাঁ হ্যাঁ , বলে অনসূয়া তার হাত ধরে প্রায় হিড় হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চললেন একটা কোর্ট রুমে।
৮৫
কোর্ট রুম । সিনেমায় যেমন দেখা যায় , মহকুমা আদালতে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের তিন নম্বর আদালত কক্ষ আদপে তেমন দেখতে নয় । ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে প্রচুর ফাইল পত্র। লোক গিজ গিজ করছে । সিলিঙে কালো ঝুল ঝুলছে । অনেক উকিল ঘুর ঘুর করছে চালাক চালাক মুখে । দেখলেই বোঝা যায় সবার হাতে কাজ নেই । ওদের ঠেলে ঠুলে সামনে চলে যান অনসূয়া । পেশকারের কানে কানে কি সব কথা বলেন । শ্যামলীকে একটা কাগজে সই করিয়ে তিনি জমা করে দেন পেশকারের কাছে । তার পরেই শ্যামলীকে বলেন – আমি এখুনি আসছি । তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থেকো কেমন ? কোথাও যেয়ো না কিন্তু । কেউ ডাকলেও না। বলেই অনসূয়া ভীড় ঠেলে কোনোমতে বেরিয়ে গেলেন ।
শ্যামলী চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মহকুমা আদালতে বিচার প্রক্রিয়া দেখতে থাকল। অজস্র মানুষ রোজ মামলা নিয়ে এসে আছড়ে পড়ছে আদালতে। আর কত রকম তাদের সমস্যা। বেশির ভাগ মেয়ে খোরপোষের মামলা করেছে। এদের অনেকেই প্রেম করে বিয়ে করেছিল। এমন কি কথাবার্তা শুনে মনে হলো বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েও বিয়ে করেছে কোনো কোনো মেয়ে । কিন্তু কি দেখে বিয়ে করেছে এরা কে জানে? ছেলেগুলোকে দেখে কাউকে তেমন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের তো মনে হলই না। এমন কি অতি সাধারণের থেকেও কম। কি করে এদের প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছে এইসব মেয়েরা?
৮৬
একটা মেয়ে বলতে থাকে তার পুরুষ কিভাবে তাকে প্রতি রাত্রে মারধর করেছে । শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাকে নানা ভাবে বিপদে ফেলতে চেয়েছে । এর মধ্যেই দু দুটি সন্তানের মা হয়েছে সে। শুনে শ্যামলীর লজ্জা করতে থাকে। যে পুরুষ মারধর করেন, তার সন্তানের জননীত্ব ঠেকাতে পারবেন না কেন নারী ? মারধর আর নিদারুণ অবহেলার পরেও মেয়ে এখনো কেন পুরুষের থেকে খোরপোষ আশা করছেন? তার কি লজ্জা করছে না এভাবে ভালবাসাহীন বিবাহের সম্পর্ককে টেনে নিয়ে যেতে? যে পুরুষকে শ্রদ্ধা করি না, তার কাছে ভাত চাইব? শ্যামলীর মনটা খুঁত খুঁত করে ।
কখনো পুরুষ বলেছে কিভাবে তার সাথে প্রতারণা করে গিয়েছে মহিলা। নাইট ডিউটি সেরে ভোর রাতে বাড়ি ফিরে এক কাপ চা পেতে গিয়ে মুখঝামটা শুনতে হয়েছে । সর্বদা নারী ঠেশ দিয়ে কথা বলেছে নাইট ডিউটির সূত্রে অন্যত্র সহবাস করার অপবাদ দিয়ে।
খানিকক্ষণ কোর্ট রুমে থাকতে থাকতে জগত জীবন সম্পর্কে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করে ফেলে শ্যামলী।
আর অবাক হয়েছে কি করে ভাবলেশহীন মুখে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এইসব মামলা শুনে চলেছেন ।
৮৭
এইসবের মধ্যেই আবার কোর্ট রুমে চলে আসেন অনসূয়া চ্যাটারজি । পেশকারের কাছ গিয়ে খোঁজ নেন । তারপর ম্যাজিস্ট্রেটের মুখের পানে তাকিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন সেরে শ্যামলীর হাত ধরে টানতে টানতে বেরিয়ে এসে বললেন – “ তোমার বেল হয়ে গেল। একমাস পরে আবার ডেট । মনে করে এসো কিন্তু । ভুলে মেরে দিও না যেন । অবশ্য আমি অরিন্দমকে বলে দেব । সে ঠিক মনে করিয়ে দেবে তোমায়। আহা, কচি মুখটা শুকিয়ে গেছে গো ” বলে চেনা চা দোকানে দুটো চা আর টোস্ট বিস্কুটের অর্ডার দেন তিনি। “এখন খানিকক্ষণ আর কাজ নেই । উফফ, কি দৌড়ান দৌড়লাম সকাল থেকে।“ মহিলা রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে থাকেন।
শ্যামলী নিচু স্বরে বলে “আপনার ফিজ কি দেব ম্যাম ?”
“ওম্মা , তোমায় কিছু বলে নি অরিন্দম?”
না তো ? তিনি তো কিছুই বলেন নি।
তুমি সত্যি সত্যি ছেলেমানুষ । আমি আর অরিন্দম যে এক ক্লাসে পড়তুম। অরিন্দমের আপনজনের কাছে আমি পয়সা নেব?
শ্যামলী চেয়ে দেখে অনসূয়ার কপালে কোনো এয়োতি লক্ষণ নেই । শরীরেও উপোসী নারীত্বের চিহ্ন স্পষ্ট । সহসা তার মনে কি হল, সে বলে উঠলো – দেখুন, আমি অরিন্দমের বন্ধু । তার বেশি কিছু নই ।
“ওরে মেয়ে, বন্ধু মানে জানিস ? কিভাবে অরিন্দম কতো ব্যাকুলতায় আমায় তোর কথা বলেছে সে যদি শুনতিস। আমার ছোটোবেলার বন্ধু । তাকে আমি বেশ চিনি ।“
অনসূয়ার কথা শুনে শ্যামলীর মন কোন অজানা আশঙ্কায় ভরে উঠলো ।
এমন সময় একটা মুহুরি এসে বললো – দিদি, ওর কাছে কাগজের পয়সাগুলো নাও । নইলে ও মেয়ে খেয়ে শুয়ে শান্তি পাবে না।
মুহুরির কথা শুনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল শ্যামলী । ভারি একটা স্বাভাবিক মানুষ বলে মনে হল তাকে।
৮৮
বাবার ঘরে ঢুকে বেল হয়ে যাবার খবরটা দিল শ্যামলী। বাবা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন আর মা গলায় আঁচল জড়িয়ে কাকে যেন স্মরণ করলেন।
বাবা জানতে চাইলেন , মামলাটা কিসের ?
শ্যামলীর মনে পড়লো অনসূয়া চ্যাটারজিকে সে কথাটা জিজ্ঞাসা করাই হয়ে ওঠে নি । নিজের ওপর রাগ হল তার। রাগ হলো অরিন্দমের ওপরেও।
শশাঙ্ক পাল আবার জানতে চাইলেন মামলাটা কিসের । শ্যামলী নিজের অজ্ঞতা চেপে যেতে পারতো বাবার কাছে। কিন্তু বললো – “কোর্টে সবাই সাংঘাতিক ব্যস্ত । কাগজ তুলে নেব কাল।“
বাবা বললেন “কারখানার কাজ শুরু করাবি কবে ? টাকা তো খানিকটা উঠে এসেছে ।“
“বাবা, তুমি কি মনে করো আমি এমনি এমনি কারখানার দরজা বন্ধ রেখেছি ?”
“কি তোর মনে আছে, আমি কি করে জানবো?”
“সত্যি করে বলো বাবা, এই যে লেবারদের আমি বাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে টাকা আনালাম, সেটা কি ভুল করেছি?”
“না, তুই একটা টিম স্পিরিট গড়ে তুললি ।“
“শুধু টিম স্পিরিট বাবা?”
“আর কি?”
“আর কিছু টের পাচ্ছো না বাবা?”
“কি বল?”
“ওরা কারবারটাকে নিজের করে জানবে । কারবারের ভালো মন্দ লাভ লোকসান ওদের ওপর কি রকম প্রভাব ফেলে সেটা ওরা বুঝবে । এর পরে মালিকপক্ষ ভুল করতে চাইলে ওরা ঠেকাবে ।“
“এটা হয়? শ্রমিক কখনো মালিকের কথা বুঝতে চাইবে?”
“বাবা, হয় না বলে কোনো কথা হয় না। হওয়াতে হয়। দুনিয়া বদলায় বাবা ।“
“তুই স্বপ্ন দেখ । “
“কিন্তু দ্যাখো বাবা, আমি কলেজে গিয়েছি, আর ওরা লোকের গালমন্দ সহ্য করে টাকা জোগাড় করে এনেছে ।“
“সে তুমি করিয়েছ বলে ওরা বাধ্য হয়ে এনেছে। আর তোকে ওরা ভালোবাসে খুব। ছোট থেকে চেনে কি না।“
“না বাবা, ওরা বুঝতে পেরেছে, এই কারবারটা বাঁচলে ওরা বাঁচবে ।“
“হ্যাঁ , এবার লক্ষ্মী মেয়ের মতো কারবার শুরু করো, কারখানার দরজা খোলো ।“
৮৯
ঘরে গিয়ে পোশাক বদলে লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়ালো শ্যামলী । হঠাৎ চোখে পড়লো নিচে দুটো ছেলে ঘুর ঘুর করছে । আরে এরা তো গ্যারেজের ছেলে। ওদের হাতছানি দিয়ে ডাকলো শ্যামলী । একটা হাউস কোট জড়িয়ে নামলো নিচে । ওরা দুটিতে সসংকোচে দাঁড়িয়ে আছে । স্নেহভরে ওদের কাছে ডাকলো । ছেলে দুটি ধন্য হয়ে গেল।
“কি রে, কি হয়েছে ?”
“তুমি ঠিক আছো ছোড়দি ?”
“হ্যাঁ রে, ঠিক আছি।“
“তোমায় না কি পুলিশ ধরতে এসেছিল কাল!”
“হ্যাঁ তো । নিয়েই চলে যাচ্ছিল ।“
“তুমি একটা খবর দিলে না কেন?” বলেই একটা অশিষ্ট শব্দ উচ্চারণ করতে গেল একজন ।
“ছিঃ, ও কি কথা? ওসব বলতে নেই ।“
তখনি আর একজন হিস হিস করে বলে ওঠে “ ছোড়দি, তোকে যদি কেউ কিছু করে তাহলে তার মাথা ফাটিয়ে দেব। “ এই বলে পকেট থেকে একটা ছোট হাতুড়ি বের করে দেখায়।
চৌদ্দ পনের বছরের ছেলের কথা শুনে গা হিম হয়ে গেল শ্যামলীর । জোর ধমক লাগালো ওদের । মুড়ি খাবে কি না জিজ্ঞেস করলো । ওরা খুশি হয়ে হ্যাঁ বলতে সবিতা পিসিকে মুড়ি মেখে আনতে বললো।
ওরা দুটিতে লোভী ছেলের মতো বললো “ দিদি, কারখানা খুলে দাও না ?”
“খুলবো না যা, খুললেও তোদের কাজে নেবো না । তোদের এতো দুষ্টু বুদ্ধি, মানুষ মারার কথা ভাবিস ? দূর করে দেবো তোদের। “
মাথা নিচু করে বসে থাকে দুটিতে । মুড়ির বাটিতে হাত দিতে চায় না।
শ্যামলী বলে “যা, এবারের মতো মাফ করে দিলাম। আর কখনো ওসব বুদ্ধি মাথায় আনবি না।“
ওরা চলে গেলে মনটি ভারি ভালো হয়ে রইলো তার। ভাবলো – ভালবাসা , তুমি কতো অপরূপ !
৯০
সন্ধ্যে নামলে অরিন্দম এলেন। তাঁর সাথে প্রবাল। আজ আর প্রবালের হাতে কাঠ চাঁপা নেই । অরিন্দম বাবার কাছে বসে গল্প করতে লাগলেন । প্রবাল মায়ের সাথে ঘরোয়া কথা বলা শুরু করে দিলেন । শ্যামলীর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ওঁদের সাথে একান্তে কথা বলে । কতো কথা জমে আছে । বাবা অরিন্দমের সাথে সমানে বকে চলেছেন। কিভাবে প্রথম দিনগুলিতে কারবার শুরু করেছিলেন । ভদ্র ঘরের ছেলে লোকলজ্জা ঝেড়ে ফেলে মিস্ত্রীদের সাথে গাড়ির নিচে উঁকি মেরেছেন। শিখেছেন গাড়ির কলকব্জা । কালিঝুলি মেখে কাজ শিখেছেন । সেই সব গল্প করতে আনন্দ পাচ্ছেন বাবা । মা প্রবালকে বলছেন কি ভাবে বাবার সাথে গ্রামের মেয়ে এই মহকুমা শহরে লোকের বাড়ি ভাড়া থেকেছেন। স্বামী দিনের পর দিন বেশি রাত পর্যন্ত কারখানায় কাজ করেছেন আর তিনি একা ঘরে দু দুটি বাচ্চা সামলেছেন । তার পর শ্যামলী যখন পেটে, তখন সবিতা এসেছে । পুরোনো গল্প নতুন লোকের কাছে করে বাবা মা আনন্দ খুঁজছেন। থাক, বাবা মায়ের যা ভালো লাগে ওঁরা করুন। এই ভেবে নিজের ঘরে চলে আসতে চাইল শ্যামলী । বেশ টের পেল সে উঠে চলে আসার সাথে সাথেই দু জোড়া তৃষ্ণার্ত চোখ ঘুরে তার দিকে তাকালো।
৯১
অভ্যাস মতো বিছানায় বসেই অঙ্ক করছিল শ্যামলী । খানিক পরেই দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে দুজন বললো “আসতে পারি?”
হেসে তাকালো শ্যামলী । দুষ্টুমি করে বললো “যদি পারমিশন না দিই ?”
“সারা রাত পারমিশন পেতে দাঁড়িয়ে থাকবো ।“ বললেন প্রবাল।
“আসুন।“ দুটো চেয়ার এগিয়ে দেয় ওঁদের দিকে। বলে “ বসুন”।
“কি রকম মামলা হলো?” অরিন্দম জানতে চাইলেন ।
“আমি তো কিছু বুঝলাম না। কে আমার বিরুদ্ধে মামলা করলো, কেন করলো, বিচারক আমার দিকে ভালো করে চোখ তুলে তাকান নি পর্যন্ত !” শ্যামলীর গলায় ক্ষোভ ঝরে পড়ে।
অরিন্দম বললেন “ বেল তো হয়ে গেল। এবার নিশ্চিন্ত।“
“ কিসের নিশ্চিন্ত মশায়? যে পুলিশ দুম করে রাত বিরেতে ভদ্রলোকের বাড়ি ঢুকে বড়ো একটা মেয়েকে তুই তোকারি করে থানায় টেনে নিয়ে যেতে চায়, তেমন পুলিশকে তো আর কোনো মতেই বিশ্বাস করা যায় না।“ কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে শ্যামলীর।
“ তাহলে বেল পেয়েও আমাদের শ্যামলীদেবীর রাগ কমে নি?”
“ অবাক করলেন আপনি অরিন্দম বাবু! আমি কি অপরাধ করেছি, সেটা জানার পূর্ণ অধিকার আছে আমার। আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ আমি পাবো । ন্যায়বিচার সেই কথা বলে। তা না করে পুলিশটা আমায় বাড়ির কাপড়েই হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যেতে চাইছিল ।“
প্রবাল সেন প্রথমাবধি কম কথা বলেন । তিনিও বিস্ময় চাপতে পারলেন না। “ সত্যি , একটা স্বাধীন দেশে পুলিশ নাগরিকের সাথে যে আচরণ করে, তা আমাদের দেশে পাওয়া যায় না।“
শ্যামলীর ভেতরটা অস্বস্তি করছিল। সে কিছুটা বিরক্তি মাখা স্বরে বললো, “ প্রবাল বাবু, আপনার কথা আমার মাথায় ঢুকছে না। আমাদের ভারত দ্যাট ইজ ইন্ডিয়া স্বাধীন না স্বাধীন নয়, এ নিয়ে আপনার মনে দোলাচল আছে?”
প্রবাল আমতা আমতা করে বললেন “ আমি বলতে চাইছি, তোমার ক্ষেত্রে পুলিশের আচরণটা সঠিক ছিল না।“
শ্যামলী বলে “ শুনুন, আমি মনে করি ১৯৪৭ সালে আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে, আর আমি জন্মসূত্রে সেই স্বাধীনতাটা উপভোগ করার একতিয়ার সম্পন্ন।“
অরিন্দম বললেন, “ আমরা বোধ হয় ব্যক্তি পুলিশের আচরণটাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলছি।“
শ্যামলী বললো “ দেখুন, ব্যক্তিকে নিয়েই সমষ্টি হয়। আমার বাড়িতে যখন পুলিশ ঢুকল , তখন ব্যক্তির গায়ে পুলিশী উর্দি ছিল । আর ছিল প্রতিষ্ঠানের ভার। আমার পক্ষে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পুলিশকে প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়ের থেকে আলাদা করে দেখা সম্ভব ছিল না।“
অরিন্দম বললেন “ শ্যামলী, পুলিশকে যে কতো রকম চোর ছ্যাঁচড় অপরাধীর সাথে দিনরাত কাজ কারবার করতে হয়, কতোভাবে মাথা খেলাতে হয়, পাক্কা অপরাধীদের ধরতে কি কি করে বেড়াতে হয়, সেটা তুমি যদি জানতে, তাহলে পুলিশের তুই তোকারি নিয়ে এত কথা বলতে না। পুলিশের কাজটা গান গাওয়ার মতো মিঠে মোলায়েম নয়।“
প্রবাল সেনও বললেন “ সত্যি শ্যামলী, পুলিশের কাজটা দারুণ কঠিন । দিন রাত চব্বিশ ঘন্টার ডিউটি । নিচের তলার পুলিশকে আবার ওপর ওলাদের বাড়িতে চাকরবাকরের মতো কাজ করে দিতে হয় শুনেছি। বউয়ের জামা কাপড় কাচানো , জুতো পালিশ এসবও নাকি করায় । “
শ্যামলী অধৈর্য হয়ে বলে উঠলো “ হ্যাঁ , তাহলে আপনাদের মতে দোষ আমারই । পুলিশ রাতে আমাকে ধরে নিয়ে যেতে চেয়ে আহামরি অন্যায় করে নি, মেয়ে পুলিশ না এনে আমায় আটক করতে চেয়ে বেআইনি কাজ করেনি, তুই তোকারি করে পাবলিক সারভেন্ট এর আচরণ উল্লঙ্ঘন করেন নি। বাহ বেশ , আপনারা খুব চেতনাসম্পন্ন নাগরিকের মতো কথা বলছেন !”
“ রেগে গেলে কিন্তু আমাদের শ্যামলীকে দারুণ দেখায়।“ অরিন্দমের সারা মুখে দুষ্টু হাসি। প্রবাল সেনও মিটি মিটি হাসতে থাকেন।
“অ্যাই অরিন্দম, আপনি একদম বাজে কথা বলবেন না। আপনার যুক্তি শেষ হয়ে গেছে বলে এসব ইললজিক্যাল কথা বলছেন। রেগে গেলে দেখতে সুন্দর লাগে – এ আবার কি কথা?”
প্রবাল সেন বলে ওঠেন , ” রেগে যান আর না যান, আমাদের শ্যামলী পালকে সব সময়েই দেখতে সুন্দর।“
“ যান তো মশাই আপনারা। কেবল বাজে বকতে লেগেছেন !”
অরিন্দম এক মিনিট চুপ থেকে বলেন “ সত্যি চলে যাব ? চলে যেতেই বলছেন ?”
এমন সময়ে সবিতা পিসি চায়ের কাপ নিয়ে ঢোকে । বলে “ চলে যাব বললেই হলো, আমি যে চা করে আনলাম । না খেয়ে যাওয়া চলবেই না।“
তার কথায় সকলে হেসে ফেলল।
৯২
চায়ে একটা চুমুক দিয়ে অরিন্দম বললেন “ পুলিশ অফিসার আমায় ভুল বলেন নি ।“
প্রবাল জানতে চাইলেন পুলিশ অফিসার কি বলেছেন।
“ সে অনেক কথা। শ্যামলীর সামনে তো বলাই যাবে না।“ অরিন্দমের কথা শুনে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো শ্যামলী ।
এমন সময়ে ফোন বেজে উঠলো । তার বাবার ঘরে একটি প্যারালাল লাইন আছে । একবার ভাবলো ফোনটা বাবা তুললে কেমন হয় । তার পর কি ভেবে শ্যামলী নিজেই ফোন তুললো।
ওপারের কণ্ঠ বললো “ আমি রমানাথ নন্দী বলছি ।“
“রমানাথ ? আচ্ছা, কি ব্যাপারে জানতে চান আপনি?”
“তুমি আমায় চিনতে পারছো না?”
শ্যামলী অপরিচিত ব্যক্তিটিকে চিনবে কেন তা বুঝে পেল না। আর রমানাথ বাবু অপরিচিতা মহিলাকে তুমি করে বলছেন কেন সে প্রশ্নও মাথায় এল তার। কিন্তু আর তর্ক করতে ক্লান্তি লাগছে । সকালে একবার কলেজে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের ঘরে তাঁর সাথে বিতর্ক হয়েছে। এখন অরিন্দমের সাথে একটু বাদ প্রতিবাদ হল । আবার নতুন ঝঞ্ঝাটে যেতে চাইল না শ্যামলী । শুধু ভদ্রতা করে বললো “ আপনার সাথে আমার কি কখনো আলাপ হয়েছে?”
“ আমার বাবার নাম শ্রী নকুড় নন্দী ।“
“ হ্যাঁ , মনে পড়েছে, নকুড় নন্দী মশায় একদিন সপরিবারে তাঁর পুত্রের বিবাহ প্রস্তাব নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন । তারপর তাঁর পুত্রের কয়েকজন বন্ধু বান্ধবও আলাপ করতে এসেছিলেন । মনে পড়েছে।“
“হ্যাঁ , আমার বাবা উনি।“
“আপনারই বিবাহ প্রস্তাব নিয়ে উনি এসেছিলেন?”
“হ্যাঁ । শুনলাম কাল না কি তোমার উপর সাংঘাতিক বিপর্যয় ঘটে গিয়েছে?”
“দেখুন রমানাথ বাবু, মানুষের জীবন থাকলে একটু আধটু এসব হয়। আপনি উতলা হবেন না।“ শ্যামলী শান্তভাব ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে চলে।“
“ না, আমরা শুনেছি তোমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছিল । “
অরিন্দম ইঙ্গিতে জানতে চাইলেন কে ফোন করেছেন। শ্যামলী তাঁকে রহস্য করে চোখ টিপল। ওপারের কণ্ঠের উদ্দেশে বললো “সঠিক শুনেছেন আপনি । কার কাছে শুনলেন?”
রমানাথ বললেন “আমার বাবা তো আপনার বাবার গুরুভাই । তো গুরুদেবের শিষ্য মহলে এই নিয়ে বেশ সোরগোল পড়ে গিয়েছে।“
“আচ্ছা। আর কিছু বলবেন?”
রমানাথ জানতে চাইলেন “মানে, কি করে এমনটা হল, কেন হল, কিছু জানা গিয়েছে?”
শ্যামলী একবার ভাবল কথা থামিয়ে দেয় । তার পরে নকুড় নন্দীর চিঠিটির কথা মনে পড়ে যেতে কথা চালাতে চাইল সে।
“দেখুন, যে মেয়ে পর পুরুষের সাথে হোটেলে রাত কাটায়, তাও একটা নয়, দু দুটো সোমত্ত পুরুষ , সে মেয়েকে পুলিশ মাঝে মধ্যে ধরে নিয়ে যেতে চাইবে এ আর আশ্চর্য কি?”
প্রবাল অধৈর্য হয়ে জানতে চাইলেন কার সাথে শ্যামলী এত কথা বলছে। আবারো শ্যামলী ইঙ্গিত করে তাঁকে থামিয়ে দিল।
“আমি তোমার কথার মানে বুঝলাম না শ্যামলী। পরপুরুষ, হোটেল, রাত কাটানো, এসব কি ব্যাপার? “
“আমিও প্রথমটা বুঝতে পারি নি । তার পর আপনার বাবার তরফে একটি চিঠিতে আমার বাবাকে জানানো হয়েছে যে মেয়ে পরপুরুষের সাথে হোটেলে রাত কাটায়, তেমন মেয়ের সাথে কোনো সম্পর্ক নন্দী মশায় চান না। … চিঠিটি আমার কাছে আছে।“
“চিঠি দিয়ে বাবা সম্পর্ক রাখতে চায় না বলেছে?”
“চিঠিতে লেখা হয়েছে। নিচে যে স্বাক্ষর করেছে, তার নাম নকুড় নন্দী লেখা হয়েছে ।“
”আমি কিছু বুঝতে পারছি না ।”
“আমি তো কিছু বোঝাতেও চাইছি না। সত্য স্বয়ং প্রকাশ। আর কি কিছু জিজ্ঞাসা করবেন?”
“আপনার বাবা কি করছেন? তাঁর সাথে কথা বলা যাবে?”
“বাবার বেশ শরীর খারাপ হয়েছিল। ডাক্তারের নির্দেশে বাড়ির বাইরে যাওয়া বারণ। কারখানায় বসতে পারছেন না। কথা না বলতে চাইলে ভালো হয়। এবার রাখি?”
“চিঠির ব্যাপারটা সত্যি কিছু বুঝলাম না !”
“রমানাথবাবু, সব কিছু আমিও বুঝি নি। শুধু বুঝেছি যে পরিবারের লোকেদের আমার বাবা মা নারায়ণ জ্ঞানে আপ্যায়ন করেছেন, তাদের ছেলের বন্ধুদের পর্যন্ত রীতিমতো যত্ন করেছেন, তারা শ্যামলী সম্পর্কে আসল খবর পেয়ে গিয়েছেন।“
প্রবাল উঠে এসে বললেন, “শ্যামলী আর তোমাকে আমি কথা বলতে দেবো না। কথায় কথা বাড়ে।“ ফোন কেড়ে নিয়ে তিনি ওপারের বক্তার উদ্দেশে বললেন, “আজ শ্যামলী খুব পরিশ্রান্ত । আপনি অন্য সময় কথা বলবেন।“ বলে নামিয়ে দিলেন ফোন। দু হাতে চোখ মুখ ঢেকে শ্যামলী মেঝেতে বসে পড়লো।
অনেকক্ষণ পরে শ্যামলী নিজেকে সামলে নিয়ে দেখল ঘরে কেউ নেই।
৯৩
শ্যামলী বাবার ঘরে গিয়ে দেখলো বাবা বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছেন। মাও দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে গেছেন । নিচে গিয়ে দেখল রান্না ঘরের দরজা ভেজানো। ধীর পায়ে রান্নাঘরে ঢুকে দেখলো তার পাশের যে ঘুপচি ঘরে সবিতা পিসি থাকে; সেখানে টিমটিমে প্রদীপ জ্বেলে পিসি কি একটা করছে। দরজা আস্তে করে খুলে সে জানতে চাইলো “পিসি আলো না জ্বেলে কি করছো?”
“ আলোটা ক’দিন হল কেটে গেছে শ্যামলিমা।“
“ সে কি, মাকে বলো নি কেন?”
পিসি আঁচল চাপা দিয়ে কি যেন লুকোতে চায়।
“তো তুমি এই অন্ধকারে কি করছো?”
“আমি আর কি করবো, এই অন্ধকার আমার বেশ সয়ে গেছে। আর অসুবিধে হয় না।“
“না, তুমি বলো কি করছিলে?” জেদ ধরে শ্যামলী।
“কি করবো, কই কিছুই করছি না!” বলে পিসি আঁচল সামলাতে থাকে ।
“এ কি, তোমার লক্ষ্মীর ভাঁড় ভেঙেছ যে ! কেন কি হয়েছে তোমার?”
পিসি ধরা পড়ে গিয়ে রেগে ওঠে । “কেন কি করেছি, সব কিছু তোকে জবাব দিতে হবে না কি?”
“তোমায় বলতেই হবে ভাঁড় ভাঙলে কেন?”
“তাহলে শোন, যে দুজন ভদ্রলোক আজ এসেছিল, তাদের চা ছাড়া আর কিছু দিতে পারি নি, সে খেয়াল আছে তোর? বউদির হাতে আর একটিও পয়সা নেই । তোমার দুই ভাইয়ের রোজ দশটাকা করে হাত খরচ চাই । আজ দিতে পারে নি বলে বীরপুরুষেরা মায়ের গায়ে হাত তুলেছে। তোমার কারখানার টাকা যা আদায় হচ্ছে, তার থেকে তুমি তো একটি পয়সাও খসাবে না। কারবার আর তার মালিক না কি ভিন্ন ভিন্ন ! এই সব বলেছিস তুই দাদাকে। তোরা ভাই বোনেরা এক একটা অবতার!”
“তাই তুমি নিজের ভাঁড় ভেঙেছ ?”
“হ্যাঁ , আমার বিদুরের খুদ। এই দিয়ে কাল চাল আনবো।“ মাথা সোজা করে ঘোষণা করে সবিতা। রেড়ির তেলের প্রদীপের টিমটিমে আলোতেও তার চোখের উজ্জ্বলতা ঢাকা পড়ে না।
শ্যামলীর কান্না পেয়ে গেল।
৯৪
খুব ভোরে সবিতা পিসিকে ঠেলে তুললো শ্যামলী। পিসির সাথে গিয়ে কারখানার গেট খুললো। তার পর ঝাড়ু হাতে নিয়ে নিজেই পরিষ্কার করতে লাগলো।
পিসি বলল, “তুই কি করে পারবি? দে আমায় দে । “
শ্যামলী বললো “খুব পারবো পিসি, তুমি দ্যাখো না।“
“তা হয় না মা। লোকে কি বলবে? তোমায় ঝাঁট দিতে দেখলে লেবাররা মানবে কেন? তুই বরং খাতা পত্রটা দেখ । আমি এদিকটা সামলাচ্ছি।“
ইতিমধ্যে এক জন দু জন করে শ্রমিক ঢুকে পড়লো।
ওদের গলায় উৎসাহ “ ছোড়দি , কারখানা খুলে দিচ্ছ?”
শ্যামলী বললো “হ্যাঁ , তোমাদের সবাইকে নিয়ে আগে বসবো।“
মিনিট ত্রিশেকের মধ্যে বেশির ভাগ শ্রমিক জুটে গেল।
সকলের সামনে দাঁড়িয়ে শ্যামলী বললো “দেখ, তোমাদের চেষ্টায় বকেয়া টাকার অনেকটা উঠে এসেছে। এবার সেই টাকাটা মূলধন করে আমরা এগোতে পারি। কিন্তু কতকগুলো নিয়ম মানতে হবে ।“
কি নিয়ম?
প্রথম কথা “ সময় মতো কারখানায় আসতে হবে। যখন তখন ছুটি নেওয়া চলবে না।“
শ্রমিকেরা একযোগে বললো “আমরা রাজি।“
“কাউকে বিনে পয়সায় গাড়ির কাজ করে দেওয়া হবে না।“ সবাই শুনতে পেলে?
একটি চালাক মুখের ছেলে বলে “পার্টি লিডাররা এলে?”
শক্ত হয়ে শ্যামলী বলে “আমি দেখবো ।“
মিচকে হেসে সে ছেলে বলে “ তুমি তো কলেজ যাবে ।“
“আমি দিনের শেষে পয়সা বুঝে নেব। যে বিনে পয়সায় লোকের কাজ করে দেবে, তার মাইনে থেকে টাকা কাটবো । আমার বাবার গাড়িও বিনে পয়সায় সারাবো না। পয়সা দেবো।“
“সে কি কথা? বড়বাবু বললেও হবে না।“
দৃঢ় কণ্ঠে শ্যামলী বলে “না, হবে না। কারবার আর মালিক আলাদা আলাদা।“
একটা গুঞ্জন ওঠে ।
“যার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে, আমায় বলতে পারো। দশবার বোঝাবো। কিন্তু কাজে ভুল হলে এক কথায় তাড়িয়ে দেব । বিনে পয়সায় নো সার্ভিস । মনে থাকবে?”
হেড মিস্ত্রি বলে ওঠে, “সার্ভিস যে দেবেন, মোটর পার্টস কই ?”
“লিস্ট করুন, আনাবো । কি কি হলে আপাততঃ কাজ চালু করা যায়, আর স্টকে কি কি আছে … আমায় লিস্ট করে দিন ।”
দু তিনজন মিলে লিস্ট বানাতে বসে যায় ।
শ্যামলী বলে “ দ্যাখো, তোমরা চেয়েছ বলে কারখানা খুলেছি। নইলে বারবার বাবা বলেছিল, কারখানা বিক্রি করে দিয়ে ঝাড়া হাত পা হয়ে যাবে। তোমাদের উৎসাহে বকেয়া টাকা আদায় হয়েছে। এবার চালু কারখানা তোমরা বজায় রাখবে। চুরি ঠেকাবে সকলে মিলে। আর কাউকে বিনে পয়সায় সার্ভিস দিয়ে কারখানার স্বার্থ নষ্ট করবে না। মোটর পার্টস আনাবো, কিন্তু সেটা থাকবে আলাদা কারবার। গাড়ি যে লোক সারাতে আসবে, তাকে আগে এস্টিমেট দেবে। সে কিছুটাকা জমা দিলে তবে কাজে হাত দেবে । মোটর পার্টস আমাদের স্টক থেকে সে কিনে দেবে। পার্টস কিনে দিলে তবে আমরা কাজে হাত দেবো।“
চালাক মুখের ছেলেটি বলে “ এভাবে হয় না কি?”
“এভাবে হতে হবে। আগে গাড়ি দেখে নেবে। সে পয়সা অ্যাডভানস করলে তবে কাজে হাত দেবে। সব টাকা বুঝে পেয়ে গাড়ি ছেড়ে দেবে।।“
সবিতা হাঁ করে শ্যামলীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। আর সকলেও।
৯৫
হেড মিস্ত্রীকে নিয়ে মহাজনের গদীতে গেল শ্যামলী। এদের নাম বহুবার শুনেছে বাবার মুখে। কিন্তু কোনোদিন আসা হয় নি। এরা মাড়োয়ারি ব্যবসাদার। মেঝেতে ঢালা বিছানা। তাকিয়া রয়েছে । মাঝখানে ফিনফিনে ধুতি আর গেঞ্জি পরা অতি বৃদ্ধ মালিক। তাঁর সামনে ক্যাশ বাক্স ।
বোসো বোসো, তোমার বাবার শরীর খারাপের কথা শুনেছি । কেমন আছে সে এখন?
শ্যামলী খেয়াল করলো ভদ্রলোক বেশ ভালো বাংলা বলেন।
শ্যামলী বলল “বাবা এখন একটু ভালো। কিন্তু মনের জোরটা হারিয়ে গিয়েছে।”
বৃদ্ধ হেসে বলেন ” তুমি তো হাল ধরেছ ।”
হ্যাঁ , চালু করে দেব আজ থেকে। আপনার কাছে মোটর পার্টস নিতেন বাবা।
কিন্তু আমি তো পাল অটোমোবিলস কে ধারে মাল দেবো না।
বৃদ্ধের চোখ শান্ত।
শ্যামলী চেয়ে থাকে।
দ্যাখো, পাল অনেক টাকা নষ্ট করে ফেলেছে। আমার কাছে যদিও ওর দেনা নেই, শুনেছি ব্যাংকে বাকি পড়েছে । ব্যাংক নোটিশ দিয়েছে তাও শুনেছি । এই অবস্থায় বাকিতে মাল দিয়ে সম্পর্ক নষ্ট করতে পারব না।
আপনি ঠিক শুনেছেন। তবে কিনা কিছুদিন হল ব্যাংকের সব দেনা পাই পয়সা মিটিয়ে দিয়েছি।
খুব ভালো করেছ। বাজারে দেনা বেশিদিন পড়ে থাকলে সুনাম থাকে না।
আমি নগদে আপনার কাছে পার্টস নেব।
বৃদ্ধ হেসে বললেন “পার্টসের দাম জানো? তুমি কারবার সামলাবে কি করে? পাল সেরে উঠুক । তাকে মাল দেব। তুমি তো শুনেছি কলেজে পড় ।“
“হ্যাঁ , কলেজে পড়ি। আমার টাকা অনুযায়ী মাল নেব।“
“না না, তুমি ছোট মেয়ে, কারবার সামলাবে কি করে? এ লাইনে খুব চুরি, আর সবাই বাকিতে কাজ করাতে চায়। দু দিনে ব্যবসা লাটে উঠে যাবে।“
শ্যামলী দেখলো দরজার বাইরে মাথা নিচু করে শুনছে হেড মিস্ত্রী।
“পালের গণ্ডগোলটা কি তা তো আমি জানি। একজনকে ভাই ভেবে ভাল রকম বিশ্বাস করে কারবারের রাশ ছেড়ে দিয়েছিল । সে এখন নানাভাবে কামড় দিচ্ছে। তুমি তো টের পেয়েছ ।“
শ্যামলীর মনে পড়ে যায় কিভাবে বীরু কাকার পয়সায় মদ খেয়ে তাকে মারধর করেছিল শান্তনু অতনু দুইভাই। আর রামনগরে কি রকম বাড়ি বানিয়েছে বীরুকাকা। সে বাড়ি নিজে চোখে দেখে এসে তার বাবা কিভাবে কষ্ট পেয়েছেন । সব ঝলসে উঠলো চোখের সামনে।
“শোনো নাতনি, তোমাকে নাতনিই বলছি । আমি তোমায় মাল দেব । তবে অল্প করে মাল নিয়ে যাও । স্টক রেজিস্টারে এন্ট্রি করাবে কিন্তু । চুরি ঠেকানোর ওই রাস্তা। বেচে পয়সা তুলে আবার মাল নাও। দরকারে আমার লোক তোমার ওখানে রেগুলার মাল পৌঁছে দিয়ে আসবে। তুমি বাকিতে কারবার করবে না। আমিও করবো না।
শ্যামলী মুগ্ধের মতো মাথা নাড়ে।
ফর্দ মিলিয়ে দু দিনের স্টক বুঝে নিল হেড মিস্ত্রী । টাকা বুঝে নিয়ে পাকা রশিদ কেটে দিল ক্যাশিয়ার ।
দাদু, আবার আসছি দু তিন দিন পরে ।
“তা এসো। টিকে থাকতে পারো তো এসো । আমাদের দেশ তো। মেয়েছেলেকে কেউ মানুষ মনে করে না। বলে বারোহাত কাপড়েও তাদের কাছা হয় না।“ নবতিপর বৃদ্ধের মুখ অনাবিল হাসিতে ভরা।
‘মেয়েছেলে’ শব্দটা কট করে কানে লাগলো শ্যামলীর। কিন্তু ভেতরের বার্তাটা সঠিক । ইন্দিরা গান্ধীর মত জবরদস্ত প্রধানমন্ত্রী সত্ত্বেও এদেশের মেয়েরা নিত্য দিন নানা রকম লাঞ্ছনার শিকার । বাড়িতে এবং বাইরে। মেয়েদের মানুষ বলে গণ্য করতে শেখেনি এদেশ ।
বৃদ্ধকে একটা প্রণাম করে উঠে চলে আসে শ্যামলী। হেড মিস্ত্রীকে বলে ফর্দ আর রশিদ আমার কাছে থাক । আপনি স্টকে এন্ট্রি করে রাখবেন। আমি ফিরে দেখে নেব।
“তুমি তো জানো না কোন মালের কি নাম।“ হেডমিস্ত্রী একটু চালাক সাজতে চায়।
শক্ত হয়ে শ্যামলী বলে “শিখে নেব। আপনি স্টকে মাল লিখে রাখুন। আমি ফিরে এসে দেখবো।“
৯৬
কোর্টে পৌঁছল শ্যামলী । পুরোনো কয়েকটি বাড়ি। মাঝের চত্বরটি বাঁশ ও বাখারির বেড়ায় ত্রিপলের ছাউনি দিয়ে ছোটো ছোটো ঘর । একজায়গায় দুটি বাঁশ খাড়া করে রঙ চটা সাইন বোর্ড ঝুলানো। তাতে লেখা “ বার অ্যাসোসিয়েশন” ।
অনসূয়া চ্যাটার্জি ছিলেন না। তাঁর মুহুরি শ্যামলীকে দেখেই চিনতে পারলো।
“কি খবর দিদিমণি ? বেল তো হয়ে গিয়েছে !”
“কিছু কাগজ নিতাম।“ নিচু স্বরে বলে শ্যামলী ।
মুহুরি বলে, “ আচ্ছা, ম্যাডাম আসুন, ব্যবস্থা হয়ে যাবে ।“
খানিকবাদে প্রায় ছুটতে ছুটতে অনসূয়া চ্যাটার্জি এলেন।
মুহুরি বললো দিদি, অমন করে ছুটলে পড়ে যাবেন যে ! দেখুন, কে এসেছে।
অনসূয়া চ্যাটার্জি শ্যামলীকে দেখে বললেন “ আজ আবার চলে এসেছো যে ?”
“ম্যাম, আমার যে বেল হয়েছে, সে বাবদে কোনো কাগজ পাব? আর, আমার বিরুদ্ধে ওদের অভিযোগটা কি সেটাও জানা দরকার।“
অনসূয়া চ্যাটার্জি বললেন কাগজ তো অরিন্দম নিয়ে গেছে । পাওনি বুঝি?
শ্যামলী কি বলবে ভেবে পায় না। গত সন্ধ্যায় অরিন্দম আর প্রবাল দুজনেই এসেছিলেন। সে নিজেই মনে মনে কিছুটা বিধ্বস্ত ছিল। ওদের সামান্য ঠাট্টায় রেগে গিয়েছিল। মনে পড়লো ফোন এসেছিল রমানাথের। নকুড় নন্দীর চিঠির বিষয়ে তার সাথে শক্ত শক্ত কথা হতে হতে এক সময় চোখে হাত চাপা দিয়ে মেঝেতে বসে পড়েছিল সে।
নিজের ওপর রাগ হল শ্যামলীর । কেন সে আরো সহনশীল হতে পারছে না? নকুড় নন্দীর চিঠিটাকে সে এত পাত্তা দিল কেন? একটা লোক তার সম্বন্ধে খারাপ বললে সে যদি রেগে যায় , তাহলে কার লাভ? নাঃ , রাগ করা মানে হেরে যাওয়া ।
“অ্যাই মেয়ে, কি ভাবছো? সত্যি বলছি, অরিন্দম তোমার কাগজগুলো নিয়ে গিয়েছে। খুব ভালোবাসে তোমায়।“
লজ্জায় কান লাল হয়ে গেল তার । নিচু স্বরে বললো “ম্যাম, অরিন্দম বাবুকে আমি শ্রদ্ধা করি । আমার বাবার অসুস্থতার সময়ে উনি আর অন্য একজন যেভাবে আমার পাশে ছিলেন, আমি অনেক ঋণী ।“
“শ্রদ্ধা থেকেই ভালবাসা আসে।“ গলাটা কেমন উদাস হয়ে ওঠে অনসূয়া চ্যাটার্জির । শ্যামলী ওঁর চোখে অনেক কিছু দেখতে পায়। অনেক গভীর কিছু।
৯৭
বাড়ি ফেরার পথে কারখানায় ঢুকল শ্যামলী । কারখানায় কাজ হচ্ছে। হেড মিস্ত্রী কে ডাকল সে । মিস্ত্রী এলে বললো “ একটা হাজিরা খাতা এনেছি । আজ থেকেই হাজিরা চালু করে দিন । কাজের খবর কি? কটা গাড়ির কাজ হচ্ছে? “
সন্তোষজনক জবাব পেয়ে কয়েকজন কাস্টমারকে ফোন করলো শ্যামলী। “জানেন, আমাদের পাল অটোমোবিলস আবার চালু করেছি। আগে যেমন আসতেন, আবার আসুন । আমাদের সেরাটা আমরা দেবো ।“ পাকা রিশেপশনিস্টের গলায় পর পর ফোন করে চললো সে।
একটি ছোট ছেলে মুড়ি তেলেভাজার একটা ঠোঙা মেলে ধরলো তার কাছে। “ ছোড়দি খাও ।“
শ্যামলী তাকিয়ে তার মুখটা দেখল । “ কে পাঠাল মুড়ি?”
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে হেড মিস্ত্রী জবাব দিল “ আমি। সকাল থেকে যে কিছু খাননি সে কথা মনে আছে?”
সহসা খিদের কথা মনে পড়লো তার । পরম তৃপ্তিতে গরম বেগুনিতে কামড় দিল শ্যামলী । “ মিস্ত্রী, রোজ সন্ধ্যায় কোম্পানি এ রকম টিফিন দেবে তো?”
হেড মিস্ত্রী বললো “ হ্যাঁ দেবো। লেবারের পেটটা ভরা থাকলে সে খুশি মনে কাজ করে।“
ঘুরে ঘুরে কাজ দেখতে থাকলো শ্যামলী। কাজ দেখার জন্য উবু হয়ে বসতেও বাধলো না তার। হেড মিস্ত্রী হেসে বললো “শুনেছি এককালে বড়বাবু নিজে গাড়ির নিচে শুয়ে কাজ উতরে দিতেন ।“
শ্যামলী মজা করে বললো – “তোমরা আমাকেও তাই করতে বলছো না কি?”
সকলে হো হো করে হেসে উঠলো।
৯৮
শ্যামলী হেড মিস্ত্রী কে বললো সন্ধ্যা সাতটার পর কারখানা বন্ধ করে দেবেন । আর কি আদায়পত্র হল আমায় হিসেব দিন। আদায়ের টাকা থেকে প্রত্যেক শ্রমিককে দশটাকা করে দিয়ে তাদেরকে সই করিয়ে নিল শ্যামলী । আর মিস্ত্রীকে বললো কাল সে কলেজে যাবে । তার বেরোবার সময় যেন মিস্ত্রী এসে চাবি নিয়ে যায় ।
বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে সে একশ টাকা দিল। বললো “ মা, কারখানায় কাজ শুরু হয়েছে। আজ রোজগার হয়েছে। এই টাকাটা রাখো ।“ সবিতা পিসিকে ডেকে বললো “ তুমি কাল ভাঁড় ভেঙ্গেছো। আমি চাই, তুমি আবার টাকা জমাও ।“
বাবার সাথে দেখা করতে তাঁর ঘরে গেল শ্যামলী ।
শশাঙ্ক পাল বললেন, “ শুনলাম মহাজনের গদীতে গিয়েছিলি ।“
“হ্যাঁ বাবা । তোমার মুখে ওঁর কথা অনেক শুনেছি। আজ আলাপ হল।“
“আজ কাজকর্ম শুরু করালি?”
“হ্যাঁ বাবা।“
“আমায় একবার বললি না। একটু গিয়ে দাঁড়াতাম ।“ শ্যামলী লক্ষ্য করলো তার বাবা বেশ একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন। বললো “বাবা তুমি তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো । তার পর যতো পারো ব্যবসার কাজ দেখো।“
তোর জন্য কাল এটা অরিন্দম রেখে গিয়েছে । বলে একটা মোটা খাম তার হাতে তুলে দিলেন শশাঙ্ক পাল। তখুনি তার হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠে খামটা খুলে দেখতে চাইছিল। কিন্তু বাবার সামনে নিজের আবেগ বা উদ্বেগ কোনো কিছুই শ্যামলী প্রকাশ করতে চাইছিল না।
নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শ্যামলী খুললো সেই খাম। একটা ছোট চিঠিতে অরিন্দম লিখেছেন – কোর্ট থেকে বেল আর অভিযোগের কাগজ – এর সারটিফায়েড কপি তুলে এনেছি। গুছিয়ে রাখা দরকার। এর আগে বাড়ির কেউ তোমার নাম করে নোটিশ নিয়েছেন, কিন্তু তুমি জানতে পারো নি। নানা ভাবে সতর্ক থাকতে হবে। প্রীতি নিও।
শ্যামলী আন্তরিক ভাবে প্রীতি গ্রহণ করে। হাত বুলিয়ে বুলিয়ে চিঠির প্রতিটি অক্ষর , আর অক্ষর গুলির প্রতিটি বাঁক কে স্পর্শ করে পরম মমতায় । তার পর তার মনে পড়ে অনসূয়া চ্যাটার্জির কথা। বলেছিলেন “শ্রদ্ধা থেকেই ভালবাসা আসে।“
মনে মনে অনসূয়া চ্যাটার্জির উদ্দেশে বলে – নিশ্চয় ম্যাম; কিন্তু ভালবাসাও অনেক রকম। চিঠির লিপির বিন্যাসের ভেতর থেকে কথা কয়ে ওঠেন অরিন্দম – নানা ভাবে সতর্ক থাকতে হবে।
চিঠির দিকে তাকিয়ে মেয়ে বলে – থাকবো।
৯৯
কলেজে ক্লাসের মাঝখানেই পিওন দিয়ে ডেকে পাঠালেন প্রিন্সিপ্যাল । যেতে হল শ্যামলীকে । তিনি বসতে বললেন না। কড়া স্বরে জানতে চাইলেন “ কাল ক্লাসে আসো নি কেন?”
মুখ নিচু করে শ্যামলী বললো “ বাড়ির কাজ ছিল ম্যাম।“
শক্ত গলায় প্রিন্সিপ্যাল জানতে চাইলেন বাড়ির কাজ থাকলে তাকে দু দুবার রাস্তায় দেখা গিয়েছিল কেন ।
শ্যামলী সংক্ষেপে জানালো বাবার কারখানার মালপত্র কিনতে সে মহাজনের বাড়ি গিয়েছিল ।
“ তোমাকে কাল কোর্টে দেখা গিয়েছে । আমার কাছে নিশ্চিত খবর আছে।“
শ্যামলী মুখ তুলে তাকালো , বললো “ হ্যাঁ ম্যাম, কাল কোর্টেও গিয়েছিলাম।“
“কেন গিয়েছিলে?”
“আমার একটা মামলা আছে । তাই উকিলের কাছে যেতে হয়েছিল।“
“না, তোমার বিরুদ্ধে একটা প্রতারণার মামলা দায়ের হয়েছে।“
শান্ত ভাবে শ্যামলী বললো “হ্যাঁ ম্যাম, সেই সমস্ত কাগজপত্র গোছাতে উকিলের কাছে গিয়েছিলাম ।“
“তোমার ব্যাপারটা কি বলো তো? কলেজ ছাত্রী তুমি। তোমার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা হয় কেন?”
শ্যামলী সোজা তাকিয়ে বলে “আমারও তো সেই প্রশ্ন ম্যাম।“
বিরক্তির স্বরে প্রিন্সিপ্যাল বলেন “ন্যাকামো কোরো না। কি এমন করেছ যে প্রতারণার মামলা দায়ের হোলো?
তীব্র অপমানবোধে কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করতে শুরু করেছিল শ্যামলীর । অরিন্দমের কথা মনে পড়লো। নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতে থাকলো সে। বললো “ সেটা আমি জানার চেষ্টায় আছি। জানতে পারলে আপনাকে জানাবো।“
“ কি জানাবে তুমি? কি বলার আছে তোমার? কোনো সম্মানবোধ, রুচিবোধ আছে তোমার?” ঝাঁঝিয়ে ওঠেন প্রিন্সিপ্যাল ।
শান্ত থাকার চেষ্টা করতে করতে শ্যামলী বলে “ ম্যাম, মামলা হয়েছে, কোর্টে হাজিরা দিয়েছি। জামিন মঞ্জুর করেছেন আদালত। এবার তারিখ জানতে পারলে সে সব দিনে কোর্টে যাব । মামলা লড়বো। সুবিচার না পেলে উপরের আদালতে যাব । এইটুকু জানি। এতে আমার সম্মানবোধের কোনো ঘাটতি হয় নি ।“
“তুমি তো দেখছি লাজ লজ্জা সব খুইয়ে বসেছ । জানো তোমার নামে অভিযোগ জানিয়ে একটা চিঠি এসেছে। তাতে লিখেছে কিছুদিন আগে কলকাতার একটা হোটেলে তুমি দু দুটো ছেলের সাথে রাত কাটিয়েছ ।“
“কে এসব লিখেছে ম্যাম? চিঠিটা দেখতে পেতে পারি?”
“না । দেখতে হবে না। কলেজের গভর্নিং বডি তোমার আচরণে অত্যন্ত বিরক্ত। তোমাকে বেকাফেস্টে কলেজকে রিপ্রেজেন্ট করতে বলে সাংঘাতিক ভুল করেছিলাম দেখছি। তুমি এক কাজ করো। অন্য কোনো কলেজে পড়ার ব্যবস্থা করো।“
শ্যামলী বললো “ম্যাম, আমি নিরপরাধ। আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ অন্ততঃ দিন।“
তিতি বিরক্ত হয়ে প্রিন্সিপ্যাল বললেন “না না, এটা ভদ্র পরিবারের মেয়েদের কলেজ । এখানে অসভ্যতা করে তুমি পার পাবে না।“
মুহূর্তে ফুঁসে উঠলো শ্যামলী । “ শুনুন ম্যাম, কারও বিরুদ্ধে মামলা হলেই সে অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে যায় না। অন্ততঃ ভারতীয় বিচার ব্যবস্থা তা বলে না। আর আমি একটা অ্যাডাল্ট মেয়ে । কলেজের ক্যাম্পাসের বাইরে আমার সাথে কারও কোনো সম্পর্ক থাকলে তার আইনী দিকগুলো প্রশাসন দেখবেন। কলেজের ক্যাম্পাসের ভেতর আমি কি করছি না করছি, সেটুকু শুধু গভর্নিং বডি দেখতে পারেন ।“
একটু থমকে যান প্রিন্সিপ্যাল । “তাহলে তুমি কলকাতার একটা হোটেলে তুমি দু দুটো ছেলের সাথে রাত কাটিয়ে আদৌ লজ্জাবোধ করছো না?”
মরিয়া হয়ে শ্যামলী বলল “ এ তো দেখছি কলেজে রাম রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হয়ে গিয়েছে !”
প্রিন্সিপ্যাল বললেন “ রাম রাজত্ব? তুমি কি বলতে চাইছো?”
“আমি আর কি বলব ম্যাম, যা বলার তা তো বাল্মীকি মহারাজ বলে গিয়েছেন। ঐ যে কারা সীতার চরিত্রের কথা বললো, আর অমনি মহান প্রজারঞ্জক রাজা বিয়ে করা বউকে অগ্নি পরীক্ষা দিতে বললেন। শুনুন ম্যাম, আমি অগ্নি পরীক্ষাও দেবো না। আর পাতাল প্রবেশও করবো না।“
“তাহলে তোমার বক্তব্য কি?”
“আমায় শো কজ করুন। আমি আইনের সাহায্য নেব।“
“শোনো মেয়ে, মাথাটা ঠাণ্ডা করো।“ প্রিন্সিপ্যাল যেন আপস করতে চান।
“ না, না, এই রাম রাজত্বের আমি শেষ দেখে ছাড়বো । আমার বিরুদ্ধে কিছু বলার থাকলে আপনি আমায় শো কজ করবেন। আমি রিপ্লাই দেব। আমি এখন যেতে পারি?”
হাল ছাড়ার ভঙ্গীতে প্রিন্সিপ্যাল বললেন “ যাও।“
৯৯A
কোর্ট ঘর ভর্তি লোকে। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সওয়াল করছেন অনসূয়া চ্যাটার্জি ।
“মি লর্ড , আমার মক্কেল শ্যামলী পালের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা দায়ের করা হয়েছে। বলা হয়েছে সে সিমেন্ট , ইট , বালি, লোহা , স্টোন চিপস কিনে দিনের পর দিন দাম দেয় নি । বিক্রেতাকে ফাঁকি দিয়েছে। কিন্তু মামলাকারী কি প্রমাণ করতে পারবেন যে আমার মক্কেল ওই সব বিল্ডিং মেটিরিয়াল ডেলিভারি নিয়েছেন?”
“মি লর্ড , আমার মক্কেলের স্বাক্ষর রয়েছে বলে যে রশিদ গুলি দেখানো হচ্ছে, সে স্বাক্ষর গুলি আদৌ আমার মক্কেলের নয়।“
“মি লর্ড , যে তারিখের স্বাক্ষর বলে দেখানো হচ্ছে, সেই সব তারিখে আমার মক্কেল স্কুলে ক্লাস করছিল।“
ফুট কাটলেন মামলাকারীর উকিল। “শ্যামলী পাল ক্লাস করছিল না কলকাতার কোথাও কারও হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ?”
“মি লর্ড, এটা আদালত । এখানে দায়িত্বশীল কথাবার্তা বলতে হবে। আমার প্রতিপক্ষ একটি সম্মানিত মেয়ে সম্পর্কে অশালীন ইঙ্গিত করছেন।“
মামলাকারীর উকিল বলে উঠলেন “ সম্মানিত মেয়ে কি না শেয়ালদা’র হোটেলের রেজিস্টারে নাম ঘাঁটলেই বোঝা যাবে !”
জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মামলাকারীর উকিলকে ধমকে উঠলেন । “আমাকে বিল্ডিং মেটিরিয়ালের মামলাটা শুনতে দিন। প্রসীড অ্যাডভোকেট চ্যাটার্জি ।“
অনসূয়া বলতে শুরু করেন , “আমার মক্কেল সেই তারিখগুলোয় ক্লাসে পড়াশুনা করছিলেন । আর তিনি যে রীতিমতো মেধাবী ছাত্রী সেটা তার মার্কশীট বলে দেবে। আমি আমার মক্কেলের মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিকের মার্কশীট আদালতের কাছে এক্সিবিট করছি।“
“মি লর্ড, লক্ষ্য করবেন, আমার মক্কেল অঙ্কে আর ইংরাজীতে কি রকম ভালো নম্বর পেয়েছে। সত্যি বলতে, আমাদের মহকুমায় মেয়েদের মধ্যে সেরা দশজনের মধ্যে সে ছিল। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এটা হতে পারতো না।“
জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন “ মিস চ্যাটার্জি, ল পয়েন্টে আসুন। আমি এখানে আপনার মক্কেলের গুণপনা শুনতে বসি নি।“
অনসূয়া দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন “মি লর্ড, মামলাকারী নিশ্চয় বিল্ডিং মেটিরিয়ালস সাইটে সাপ্লাই করেছেন । সেই সম্পত্তি কার নামে আর কার দখলে আছে সেটা আদালতকে দেখতে অনুরোধ করি। এই আমি পরচা আর দলিলের কপি দিলাম । আমার মক্কেল কেন অন্যের জমিতে বাড়ি করতে যাবে মি লর্ড ?”
মামলাকারীর উকিল তিড়বিড়িয়ে জ্বলে উঠে বলেন “ ভুমি দপ্তরের পরচায় জমির মালিকানার কিছুই প্রমাণ হয় না।“
তাকে গ্রাহ্য না করে অনসূয়া চ্যাটার্জি বলেন “ যে সব তারিখে বিল্ডিং মেটিরিয়ালস সাপ্লাই করা হয়েছে বলে তথাকথিত রশিদে বলা হয়েছে, সেই সময়ে আমার মক্কেল শ্যামলী পাল নেহাত ছেলেমানুষ ছিলেন। তার বয়স সে সব তারিখে আঠারো পেরোয় নি। আঠারোর কম বয়সী একজন কিশোরীকে মামলাকারী মাল সাপ্লাই দিয়েছেন এটা বিশ্বাসযোগ্য? আমি আমার মক্কেলের বয়সের প্রমাণপত্র হিসেবে তার মাধ্যমিক অ্যাডমিট কার্ডের অরিজিনাল কপি আদালতের কাছে এক্সিবিট হিসাবে পেশ করছি।”
জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মন দিয়ে শ্যামলীর মাধ্যমিক অ্যাডমিট কার্ড আর মার্কশীট গুলি দেখতে থাকেন ।
অনসূয়া চ্যাটার্জি বলেন “ আশা করি আমি আদালতকে বোঝাতে পেরেছি যে আমার মক্কেলের বিরুদ্ধে বিল্ডিং মেটিরিয়ালস এর দাম না মেটানো নিয়ে প্রতারণার মামলা দাঁড়ায় না। “
হঠাৎ শ্যামলী ভিড়ের মধ্যে দেখতে পায় প্রবাল সেন আর অরিন্দম দাশগুপ্ত গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
১০০
মামলাকারীর উকিল জেরা শুরু করলেন এইভাবে
“ দেখুন, লোক ঠকানোটা আপনার পেশা ।“
শ্যামলী অরিন্দম দাশগুপ্তের সাবধান বাণী মনে রেখে কিছুতেই মাথা গরম না করে বললো “ না, আমি লোক ঠকাই নি কোনোদিন ।“
মামলাকারীর উকিল চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন “ শ্যামলী দেবী , শুধু আপনি নন, আপনার বাবাও লোক ঠকাতে অভ্যস্ত ।“
সহসা কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো মেয়ের । অনসূয়া চ্যাটার্জি বলে উঠলেন “ মামলা হচ্ছে একজনের বিরুদ্ধে; সেখানে অন্যের প্রসঙ্গ আসবে কেন? “
জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বললেন “ শুধুমাত্র মামলার পয়েন্টে কথা বলুন।“
শেয়ালের মতো নজরে মামলাকারীর উকিল বললেন “হুজুর, মামলার পয়েন্টেই কথাটা বলছি । আমাদের শ্যামলী দেবী এখন তাঁর বাবার কারবার দেখাশোনা করছেন। বাবার বদ অভ্যাসগুলিও তিনি শিখে নিয়েছেন।“
জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন “ আপনার মামলা তো শ্যামলীর বিরুদ্ধে। ওঁর বাবার বিরুদ্ধে আমি শুনবো কেন?”
“ হুজুর মেয়ে যে বাবার কাছেই লোক ঠকানোর শিক্ষা পেয়েছে। এই দেখুন হুজুর , ওর বাবা শশাঙ্ক পাল ব্যাংকে লোন নিয়ে দিনের পর দিন পালিয়ে বেড়াচ্ছে।“
অনসূয়া চ্যাটার্জি বলে উঠলেন “ ব্যাঙ্কের কিছু বলার থাকলে তারা বলুক। বিল্ডিং মেটিরিয়ালসের লোকে সে কথা বলবে কেন?”
জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শ্যামলীর কাছে জানতে চাইলেন শশাঙ্ক পালের ব্যাঙ্ক লোনের এখন কি অবস্থা। শ্যামলী শান্তভাবে বললো ব্যাঙ্ককে কিছুদিন হল সে নিজে উপস্থিত থেকে পাই পয়সাটি মিটিয়ে দিয়েছে। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের আর কোনো সমস্যা নেই।
মামলাকারীর উকিল আবার বললেন “ লোন নিয়ে শোধ দিচ্ছিল না বলে ব্যাঙ্ক দু দুটো নোটিশ পাঠিয়েছিল।“
অনসূয়া চ্যাটার্জি ফুঁসে উঠলেন “ ব্যাঙ্ক কি আপনাকে ওকালত নামা দিয়েছে, যে ব্যাঙ্কের হয়ে বলতে শুরু করেছেন? ধান ভানতে শিবের গীত।“
“ব্যঙ্গ করে পার পাবেন না ম্যাডাম। দেখতে ছেলেমানুষ হলে কি হবে, এই শ্যামলী পাল ভারি ত্যাঁদড় ।“
জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কড়া গলায় বললেন “ মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাডভোকেটস। দিস ইজ আ কোর্ট । ইউ শুড মেনটেইন দ্য ডেকোরাম।“
মামলাকারীর উকিল শ্যামলীকে নতুন করে জেরা শুরু করলেন “ আচ্ছা শ্যামলী দেবী , দেখুন তো, এই বাড়িটি চেনেন কি না?”
একটি ছবি মেলে ধরলেন তিনি।
শ্যামলীর মনে পড়ে গেল রামনগরে বীরু কাকার বাড়ি নিজে চোখে দেখে এসে বাবা কি রকম কেঁপেছিল । সেদিনই বাবার শরীর খারাপ হল। বাড়িটা তাহলে এই রকম ।
“কি ম্যাডাম, বলুন, বাড়িটা তো বেশ ভালোই বানিয়েছেন।“
“ না, এ বাড়ি আমার নয়, এ বাড়ি সম্পর্কে কোনো কিছু আমার জানা নেই ।“
“ অ , তাহলে এই রশিদে সই করে ইট , বালি , সিমেন্ট , স্টোন চিপস, লোহা আপনি ডেলিভারি নিলেন কেন? এই যে রশিদগুলি । ভালো করে চেয়ে দেখুন , এই যে এস পাল বলে সই করেছেন ।“
“ এই সই আমার নয়। এই রশিদ সম্পর্কে আমি কিছু জানি না।“
“ তাহলে এই বাড়ি আপনার নয়?”
“ এই বাড়ি আমার নয়, এর জমি আমার নয়, এ সম্পত্তির সাথে আমার কোনো সংশ্রব নেই।“
মামলাকারীর উকিল বললেন “ দ্যাট’স অল হুজুর।“
কোর্টের দিকে ঝুঁকে সম্মান জানিয়ে অনসূয়া বেরিয়ে পড়লেন । তাঁর পিছু পিছু শ্যামলী ।