বাসন্তীবালা রুক্ষ স্বরে বললেন, তা তোমার লাগবে না। যে কালাপাহাড় হয়ে উঠেছ তুমি?
শ্যামলী বলল, আচ্ছা বাবা, তুমিই বলো, জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক বলে কিছু হয়?
শশাঙ্ক পাল বললেন, কেন রে, হয় না কেন?
বাসন্তীবালা স্বামীর দিকে ক্রুদ্ধ চোখে চেয়ে বললেন, তুমি, একমাত্র তুমিই আদর দিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে বাঁদর করে তুলেছ।
শশাঙ্ক পাল স্ত্রীকে বললেন, আহা, ও কি গল্পটা বলে শুনতে দাও না? তারপর মেয়েকে বললেন, নে , তোর গল্পটা বল্।
শ্যামলী বলল, দেবতাদের রাজা ছিলেন ইন্দ্র। অনেকে বলেন, রাজার পোস্টটার নাম ছিল ইন্দ্র। যাইহোক এক ইন্দ্র ছিলেন ভারি কামুক।
কামুক শব্দটা শুনেই বাসন্তীবালা রাগ করে উঠে পড়লেন। ছিঃ ছিঃ, বাপ মেয়েতে এইসব কথাবার্তা, ম্যা গো, রামঃ রামঃ।
শশাঙ্ক পাল হেসে বললেন, এইসব সত্যি সত্যি বইতে আছে।
আচ্ছা, তুই বল্ শ্যামলী।
বাবা, অহল্যা নামে একটা ভারি সুন্দর দেখতে মেয়ে ছিল।
বাসন্তীবালা বললেন, না না, অহল্যা মানে রুক্ষ পাথুরে জমি, যেখানে গাছপালা হয় না। মেয়ের নাম অহল্যা হলে, সে আসলে বাঁজা মেয়েছেলে। ওই মেয়েকে রামচন্দ্র উদ্ধার করেছিলেন।
শ্যামলী বলল, না গো, অহল্যা মানে হল যে মেয়ের কোনো রকম খুঁত নেই। সর্বাঙ্গসুন্দরী।
তো, জানো বাবা, এই অহল্যা ছিলেন ব্রহ্মার মানসকন্যা। অহল্যা যখন একেবারেই এতটুকু, তখন ব্রহ্মা একটা তপস্যায় বসবেন বলে বাচ্চা মেয়েটাকে দেখাশুনা আর বড়ো করার দায়িত্ব দিলেন গৌতম মুনির হাতে। তা বলতে নেই, তোমার ওই গৌতম মুনি আজকালকার গুরুদেবদের মতো নোংরা চরিত্রের লোক ছিলেন না।
শ্যামলী এইটুকু বলা মাত্র বাসন্তীবালা খেপে গেলেন। বললেন, ওইজন্য তোকে লোকজন দুচক্ষে দেখতে পারে না। সব সময় তোর চিমটি কেটে কথা।
শশাঙ্ক পাল স্ত্রীকে বললেন, আহা, ও তো কারো নাম করে কিছু বলছে না। একটা সাধারণ ভাবে বলছে। তুমি রেগে যাচ্ছ কেন বলো তো?
বাসন্তীবালা বললেন, রেগে যাব না, ডাগরটি হয়েছে। আজ বাদে কাল পরের বাড়ি পাঠাতে হবে। তারা বলবে না, ওর বাপ না হয়, কারখানায় মজুরদের সাথে একসাথে কুলিগিরি করত, মা টারও কি কোনো তালজ্ঞান ছিল না, মেয়েটাকে ইতর বানিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে?
শশাঙ্ক বললেন, আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে। তোমার সবকিছু শুনতে সাধ যায় তো বসো। নইলে নিজের কাজে যাও। তারপর মেয়েকে বললেন, হ্যাঁ রে শ্যামলী, তারপর বাচ্চা মেয়েটার কি হল?
শ্যামলী বলল, গুরু গৌতম পুঙ্খানুপুঙ্খ যত্নে মেয়েটাকে বড় করলেন। সুশিক্ষিত ও মার্জিত স্নিগ্ধ মেয়েটির রূপ ও গুণের খ্যাতি জগতে ছড়িয়ে পড়ল।
শশাঙ্ক বললেন, বাঃ, গৌতম মুনির দায়িত্ববোধ আছে বলতে হবে।
শ্যামলী বলল, বাবা, তারপর শোনো, অহল্যার সুখ্যাতি ব্রহ্মলোকে ব্রহ্মার কর্ণগোচর হল। তখন তাঁর ইচ্ছে করল, অহল্যা কেমন বড়োটি হয়েছেন, দেখবেন।
বাসন্তীবালা বললেন, তা বাপ বলে কথা, দেখতে ইচ্ছে হওয়াটাই স্বাভাবিক।
শ্যামলী বলল, গুরু গৌতম অহল্যাকে ব্রহ্মার কাছে নিয়ে গেলেন। অমন পরমা রূপসী মেয়েকে দেখে ব্রহ্মা ভারি খুশি।
গৌতম একটু বললেন, তোমার মেয়ের যত্নের কোনো ত্রুটি আমি করি নি, খাওয়া পরার কোনো কষ্ট দিইনি। ব্রহ্মা তখন খুব খুশি হয়ে বললেন, তুমি এত যত্ন নিয়ে মানুষ করেছ যখন, আমার এ মেয়েকে তোমার হাতেই সম্প্রদান করলাম। তুমিই এতদিন একে রক্ষা করেছ, বাকি জীবনটাও একে রক্ষা করার দায়িত্ব ও অধিকার তোমাকে দিলাম।
বাসন্তীবালা বললেন, এটা তো ভাল কাজ হল না। ছোট্ট থেকে মানুষ করেছে মানে, গৌতমের সঙ্গে মেয়েটার বয়সের ফারাক অনেকটাই।
শশাঙ্ক বললেন, তাছাড়া মানুষ করেছে মানে সে একরকম বাবা।
শ্যামলী বলল, হ্যাঁ হিন্দুদের শাস্ত্রে পাঁচ রকম বাবার কথা বলা আছে। জন্মদাতা পিতা, অন্নদাতা পিতা, শিক্ষাদাতা পিতা, দীক্ষাদাতা পিতা আর কন্যাদাতা পিতা।
তারপর বলল, তো অহল্যা গৌতম মুনির ঘর করতে গেল। এদিকে অহল্যার কথা তো জগদবাসী জেনেছে। দেবতাদের রাজা ইন্দ্রের কানেও গিয়েছে অহল্যার অনুপম সৌন্দর্যের কথা। ইন্দ্রের ঘরে বৌ ছিলেন। শচী রাজেন্দ্রাণী। আর অফিসে এক দঙ্গল অপ্সরী, উর্বশী, মেনকা, ঘৃতাচী, অলম্বুষা তাদের নাম। তারা মারকাটারি সুন্দরী আর ছলাকলায় অঘটনঘটনপটীয়সী। তবুও লোকের মেয়ে বউয়ের চোখ ধাঁধানো রূপের খোঁজ পেলে ইন্দ্রের মনটা ছোঁক ছোঁক করত। অহল্যার দিকে নজর পড়ল দেবরাজ ইন্দ্রের।
বাসন্তীবালা বলে উঠলেন আচ্ছা শয়তান লোক তো।
শ্যামলী হেসে বলল, ইন্দ্র কিন্তু দেবলোকের মহানাগরিক। তো একদিন অহল্যাকে আশ্রমে রেখে মুনিঠাকুর গিয়েছেন তীর্থস্থানে পুণ্যভূমিতে স্নান করতে। ইন্দ্র তালে ছিলেন। মুনিঠাকুরের ছদ্মবেশ ধরে তিনি অহল্যার কাছে এসে কামপিপাসা ব্যক্ত করলেন। স্বামীর দাবিমাত্র কামনা পূরণ করা সতী নারীর কর্তব্য। অহল্যা স্বামীজ্ঞানে মুনিরূপী আগন্তুকের কামচরিতার্থ করলেন। ওদিকে যোগবলে গৌতম মুনি টের পেয়ে গেলেন, আশ্রমে তাঁর অনুপস্থিতিতে কী হচ্ছে। তিনি সহসা উপস্থিত হয়ে ইন্দ্রকে কট রেড হ্যাণ্ডেড। সেকালে মুনিরা মহাতেজা ছিলেন।
ইন্দ্রকে অভিশাপ দিলেন যে তার গোটা শরীর জুড়ে হাজারটা স্ত্রী অঙ্গ গজাবে, আর অহল্যাকে শাপ দিলেন যে, সে রুক্ষ বিশুষ্ক পাথর হয়ে থাকবে। সেকালে সিআরপিসি, আইপিসি, এভিডেন্স অ্যাক্ট জুরিসপ্রুডেন্স, বেনিফিট অফ ডাউট, কোনো কিচ্ছু ছিল না কি না। মুনি বুঝতে পর্যন্ত চাইলেন না, অহল্যা স্রেফ ধর্ষিতা। স্বামী সেজে প্রতারণা করে, ভুল বুঝিয়ে, বিশ্বাস উৎপাদন করে ইন্দ্র তাকে ভোগ করেছে। আইপিসিতে ধর্ষিতা একজন ভিক্টিম মাত্র। তাকে অপরাধের প্রশ্রয়দাত্রী বলা যায় না। অ্যাবেটমেন্ট, মানে প্ররোচিত করার প্রশ্নই ওঠে না। একটি ধর্ষিতা মেয়ে একটা অপরাধের নিছক একটা সাক্ষী মাত্র। গৌতম কাকে শাস্তি দিলেন? না যে মেয়েটাকে তিনি কোলেপিঠে করে মানুষ করে, তারপর তার পাণিগ্রহণ করেছেন। ইন্দ্র কান্নাকাটি করে লবিবাজি করে নিজের শাস্তিটাকে কমিয়ে নিলেন। অহল্যার জন্যে কথা বলার মতো কোনো প্রেশার গ্রুপ ছিল না। তার কোনো রেমিশন পর্যন্ত হল না। সে পাথর হয়ে হাজার হাজার বছর ধরে অবজ্ঞা অবহেলায় অনাদরের অন্ধকারে পড়ে রইল। কবে রাম আসবে। তার পা ঠেকে গেলে তবে মেয়ে আবার নড়ে চড়ে উঠবে, কথা বলবে। ততদিন থাক্ পড়ে ধূলার মধ্যে। আইন বলছে, শত অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাক, একটিও নিরপরাধ যেন অবিচারের শিকার না হয়। কিন্তু মুনির মনে অহল্যার জন্যে বিন্দুমাত্র দয়ার উদ্রেক হল না। বাবা এই হল জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক।
শশাঙ্ক পাল একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে বসে রইলেন।