দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৩৬)
by
·
Published
· Updated
পর্ব – ১৩৬
শশাঙ্ক পাল মেয়ের কাছে জানতে চাইলেন বাড়িতে ব্রাহ্মণ ভোজনের অনুষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও কেন এত সকালে রমানাথ হাজির হয়েছেন। আরও বললেন, তিনি আশঙ্কা করছেন, গত সন্ধ্যায় তাকে নিয়ে রমানাথের বাড়িতে কোনো অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে।
শ্যামলী বলল, বাবা, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটা উপন্যাস আছে, বিষবৃক্ষ। সেখানে নগেন্দ্র দত্তের বাড়িতে মেয়েদের মহলে হরিদাসী বৈষ্ণবী সেজে একজন এসেছিল। তাকে সবাই গান গাইতে বলেছিল। তার গান শুনে সকলের ভাল লেগে ছিল। হরিদাসী চলে যাবার পর মেয়েদের একজন তার প্রশংসা করল। সেই শুনে অনেকেই প্রশংসা করল। তারপর একজন একটু খুঁত বের করল। তার পর আরো অনেকে তার আরো খুঁত খুঁজে বের করল। শেষে দেখা গেল হরিদাসী বৈষ্ণবীর মতো বিশ্রী গলা আর বিশ্রী চেহারা কারো হয় না। বঙ্কিম লোকরহস্য খুব বুঝতেন। মানুষ যখন কারো প্রশংসা করে, কিভাবে করে, আর যখন সেই একই লোকের নিন্দা করে, তা কিভাবে করে, বঙ্কিম চমৎকার ভাবে লিখেছেন।
মেয়ের কথার মাঝখানেই বাসন্তীবালা ঘরে এসে বসেছিলেন। এখন মেয়ের কথার যেটুকু শুনতে পেলেন, তাতেই নিজের সাংসারিক বুদ্ধিতে টের পেয়ে গেলেন যে রমানাথের বাড়িতে তাঁর মেয়েকে নিয়ে বড় কোনো গোলমাল হয়েছে।
শ্যামলী বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, প্রাচীন গ্রীসে অয়দিপাউস বলে একটা নাম করা লোক ছিল। কেউ আবার তাকে ঈডিপাস বলে। তো ও এক পুরোনো গল্প। গ্রীক পুরাণকথা। হোমার তাঁর ওডিসিতেও গল্প ঢুকিয়ে দিয়েছেন। নাট্যকার সফোক্লেস এক রকম ভাবে লিখেছেন। ওঁর বন্ধু এসকাইলাস আরেক রকম ভাবে লিখেছেন।
শশাঙ্ক পাল বললেন, গল্পটা কি?
শ্যামলী বলল, সে অনেক আগে, ধরো না কেন, আড়াই হাজার বছর আগে থিবস বলে একটা রাজ্য ছিল। লাইয়ুস ছিল তার রাজা। আর রাজার বৌ ছিল জোকাস্টা। তখন দৈববাণী হত। তো রাজা লাইয়ুস এর একটা ছেলে হল। বাচ্চাটা হবার পর দৈববাণী হল যে, সে তার বাবা মানে লাইয়ুস কে হত্যা করবে। লাইয়ুস তো ক্ষেপে অস্থির। সে করল কি শক্ত দড়ি দিয়ে বাচ্চাটার পা বাঁধল আচ্ছা করে। তারপর বৌ জোকাস্টাকে হুকুম দিল বাচ্চাটাকে মেরে ফ্যালো।
গল্পের টানে সবিতাও অভ্যাস মতো দরজার চৌকাঠে এসে বসেছেন। রাজার নিষ্ঠুর হুকুম শুনে সবিতা আর বাসন্তীবালা দুজনেই হায় হায় করে উঠলেন। শশাঙ্ক পাল বললেন, তারপর?
তো জোকাস্টাকে রাজা হুকুম দিলে হবে কি, তার তো মায়ের প্রাণ, তার যে নাড়ীছেঁড়া ধন। সে আর বাচ্চাটাকে মারতে পারল না। একটা চাকরের হাতে দিয়ে বলল, রাজার এই হুকুম। তুই যা পারিস কর। চাকরটা বাচ্চা টাকে নিয়ে অনেক দূরে একটা মাঠে ফেলে রেখে এল। পায়ে শক্ত করে দড়ি বাঁধা অবস্থায় বাচ্চাটা পড়ে আছে দেখে একটা রাখাল ছেলে তাকে কুড়িয়ে নেয়। পায়ে অত ক্ষণ ধরে মজবুত বাঁধন দেওয়া ছিল বলে বাচ্চাটার পা ফুলে ঢোল। তার ওই ফোলা পা দেখে রাখাল তার নাম দিল ঈডিপাস। ঈডিপাস মানে ফোলা পা।
রাখাল ছেলে অমন ফুটফুটে বাচ্চা নিয়ে কি করবে, সে শুনেছিল করিন্থের রাজা পলিবাস এর নাকি বাচ্চাকাচ্চা নেই। তার কাছে দিলে আদরে মানুষ হবে ভেবে রাখাল ছেলে তার হাতে তুলে দিল ঈডিপাসকে।
একসময় ঈডিপাস বড় হল। নওজোয়ান ঈডিপাস চলেছে রথে। এমন সময় একটা বয়স্ক লোকের রথ এসে পড়ল। কার রথ আগে যাবে সেই নিয়ে জোর তর্ক বাধল।
বয়স্ক মানুষ দাবি করলেন আমার রথ আগে যাবে। আর তরুণ ঈডিপাস এর রক্ত টগবগ করে ফুটছে। সে কেন মাথা নিচু করে থাকবে? তার ঔদ্ধত্য দেখে বয়স্ক লোকটা লাঠি উঁচিয়ে শাসন করতে গেল।
শ্যামলী হেসে বলল, তো টগবগে জোয়ান ঈডিপাস দিল বুড়োকে এক ধাক্কা। সে তখন মাটিতে পড়ে মারা গেল।
বাসন্তীবালা বললেন, আহা হা।
শ্যামলী বলল, বুড়োটা ছিল থিবসের রাজা লাইয়ুস। ঈডিপাস এর হাতে বুড়ো মারা পড়ায় থিবস রাজ্য ঈডিপাসের দখলে চলে এল। এমন সময় রাস্তা আটকাল এক অদ্ভুত জীব, স্ফিংক্স।
শশাঙ্ক পাল জানতে চাইলেন, কেমন জীব স্ফিংক্স?
শ্যামলী বলল, তার মাথা আর বুক যুবতী নারীর মতো, দেহটা সিংহীর। তার উপর ঈগলের ডানা।
সবিতা বললেন, এমন জন্তু হয় না কি?
বাসন্তীবালা বললেন, আরে গল্পটা শোন্ না!
শ্যামলী বলল, স্ফিংক্স থিবসের সব লোককে পথ আটকে ধাঁধা বলে উত্তর জিজ্ঞাসা করত। তার বিটকেল শক্ত শক্ত ধাঁধার উত্তর দিতে পারত না কেউ। তখন স্ফিংক্স তাদের ধরে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে গিয়ে খেত। তো স্ফিংক্স ঈডিপাসকে জিজ্ঞাসা করল, বলো তো দেখি, কোন্ জানোয়ার সকালে চারপায়ে হাঁটে, দুপুর রৌদ্রে দুই পায়ে হাঁটে, আর সন্ধ্যা নামলে তিন পায়ে হাঁটে?
শ্যামলী বলল, ঈডিপাস ছিলেন ধুরন্ধর বুদ্ধিমান ব্যক্তি। তিনি বললেন, মানুষ। শৈশবে হামাগুড়ি, যৌবনে মজবুত দুই পা, আর বার্ধক্যে লাঠি সম্বল করে হাঁটে।
সবিতা বলল, এ তো খুব সহজ ধাঁধা।
শ্যামলী বলল, স্ফিংক্স তো ঈডিপাসকে পথ ছেড়ে দিল। থিবস ভোগ করতে ঈডিপাস কে আর কোনো বাধা পেতে হল না। রাজ্য তো মুঠোয় পেলই, এমনকি লাইয়ুস এর রাণিকে পর্যন্ত ভোগ করল ঈডিপাস।
বাসন্তীবালা আর সবিতা একযোগে বললেন, ইশশ ছি ছি ছি।
শ্যামলী বলল, অনেক পরে ঈডিপাস জানতে পারল থিবসের রাজা লাইয়ুস এর ঔরসে তার জন্ম। আর থিবসের রাণি জোকাস্টা তার গর্ভধারিণী মা।
তখন তার কি প্রবল হতাশা, কাতরতা, নিঃসীম আত্মগ্লানি। সফোক্লেস এর ঈডিপাস রেক্স নাটকে পিতৃহন্তা, মাতৃগমনকারী অভিশপ্ত চরিত্রটি দুরন্ত ক্ষোভে লজ্জায় নিজের দুই চোখ খুবলে তুলে আনে। রাণি জোকাস্টা আত্মহত্যা করেন।
এই গল্পটা সভ্য মানুষকে খুব ভাবিয়েছে। সিগমুণ্ড ফ্রয়েড নামে এক মনোবিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি ১৮৯৯ সালে একটা বিখ্যাত বই লেখেন। ইন্টারপ্রিটেশন অফ ড্রিমস। স্বপ্নকে ব্যাখ্যা করা নিয়ে বই। তাতে তিনি ঈডিপাস কমপ্লেক্স বলে একটা ধারণা আনলেন। মনোবিশ্লেষণী তত্ত্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। তবে এই শব্দটা তৈরি করেন এগারো বছর পরে প্রকাশিত একটা বইতে।
শশাঙ্ক বললেন, ঈডিপাস কমপ্লেক্সটা তাহলে কি?
শ্যামলী বলল, মায়ের সঙ্গে ছেলের বড়ো হয়ে ওঠার অনেক আগে, ধরো তিন থেকে ছয় বছরের মধ্যে একটা সম্পর্ক বিন্যাস।
বাসন্তীবালা বললেন, একটা ঘর কেউ দেখাতে পারবে না, যেখানে শাশুড়ি বৌয়ের মধ্যে একটা রিষ নেই।
সবিতা বললেন, শাশুড়ি সব সময় ভাববে কি, ঐ যা, আমার ছেলে আর আমার রইল না। তাকে এখন পর করে দিল।
বাসন্তীবালা বললেন, মেয়েদেরও বোঝা উচিত সে মানুষটা বুকে করে তার ছেলেকে মানুষ করেছে, তাকে সইয়ে সইয়ে সব কাজ করতে হবে।
সবিতা বললেন, মেয়েরা আবার খুব বাপসোহাগী হয়। আমাদের মেয়েটাকে দেখলেই বোঝা যায়। বাবা তোমাকে ফল খাইয়ে দিই, মশারি টাঙিয়ে দিই। বাব্বা, বাপকে এত ভালবাসা চট করে ছেলেদের মধ্যে দেখা যায় না।
শশাঙ্ক পাল বললেন, অ, তাহলে, কাল রমানাথের বাড়িতে এইসব হয়েছে? তোকে ছোটোবড়ো কোনো কথা বলেছেন ওর মা?
শ্যামলী বলল, না না, তেমন কিছু নয়।
সবিতা বললেন, হ্যাঁ, তোকে আমরা পেটে ধরেছি, না তুই আমাদের পেটে ধরেছি? সারা রাত তুই কেঁদে কেঁদে গান গাইলি, ভাবছিস আমি কিছু বুঝি নি?
বাসন্তীবালা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ও যেতে চায় নি গো। কত আপত্তি করেছিল। আমিই ঠেলেঠুলে জবরদস্তি করে পাঠালাম গো।
শ্যামলী মাথা নিচু করে রইল। চোখ দিয়ে বড় বড় ফোঁটায় টপটপ করে জল পড়তে থাকল।
শশাঙ্ক পাল একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন।