• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৩২)

পর্ব – ১৩২

বাড়ি ফিরে যাবার আগে রমানাথের মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেল শ‍্যামলী। বলল, জ‍্যেঠিমা, আপনাদের কাছে সারাদিন র‌ইলাম, এবার আমি আসি। তখনো বেশ কিছু আত্মীয় মহিলা  পুরুষ রমানাথদের বাড়িতে রয়ে গিয়েছেন। রমানাথের মা বললেন, আমার কাছে আর থাকলে কোথায়, সারাক্ষণ তো একজনের পিছুপিছুই ঘুরলে!
একজন প্রবীণা তিক্ত স্বরে বললেন, তোর কি হায়া লজ্জা কিছু নেই শ‍্যামলী? বাপ মরা ছেলেটাকে নিয়ে তুই খোলা ছাতে বসে র‌ইলি?
কথার ঢঙে শ‍্যামলী অবাক হয়ে গেল। অথচ সকালে এই ঘরেই তার প্রতি মধু বর্ষিত হচ্ছিল।
শ‍্যামলী চাইছিল না, কোনো তিক্ততা বাড়ুক। সে বলল, এই তো নেমে এসেছি। সূর্যাস্ত দেখব বলে উঠেছিলাম।
প্রবীণা বললেন, তুই তো অবাক করলি! এই সন্ধেবেলাটাতেই তো বেশি ভয়! তোর মা বাপ কি কিছুই শেখায় নি!
কশাহত জন্তুর মতো শ‍্যামলী এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। কোথাও কারো চোখে যেন তার প্রতি কোনো মমতা নেই।
রমানাথ ঘরে ঢুকে বললেন, শ‍্যামলীকে বকা দিয়ে লাভ নেই। আমিই ওকে ছাতে টেনে নিয়ে গিয়েছিলাম।
আরেকটি প্রবীণা রমানাথের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, এখন বুঝতে পারছ, মাথাটা ওর কতটা চিবিয়ে দিয়েছে?
 শান্ত স্বরে শ‍্যামলী বলল, জ‍্যেঠিমা, উনি আমাকে ডেকেছিলেন, সেটা যেমন সত‍্য, তেমনি এটাও সত‍্য যে, আমার স্বাধীন ইচ্ছেতেই আমি ছাতে গিয়েছিলাম।
প্রবীণা ঝঙ্কার দিয়ে বলে উঠলেন হা হা রে, বড্ড সত‍্যিবাদী যুধিষ্ঠির এসেছেন! তুই ছাতে গিয়েছিলি কেন আগে বল্?
শ‍্যামলী আরো শান্ত স্বরে বলল, গল্প করতে।
অন‍্য এক বয়স্ক মহিলা বললেন, সে কি আমরা জানি না ভেবেছ? আমাদের মেয়েরা গিয়ে গিয়ে নজর রাখছিল। আমরা নিচে বসে সব খবর নিচ্ছিলাম।
শ‍্যামলী বলল, তা যদি করে থাকেন, তাহলে খুব গৌরবের কোনো কাজ আপনারা করেন নি।  দুটো অ্যাডাল্ট ছেলেমেয়ে নিজেদের ইচ্ছায় একান্তে কি গল্প করছে, তাতে কারোরই নাক গলানো উচিত নয়।
আরেকটি বৃদ্ধা বললেন, হ‍্যাঁ রে শ‍্যামলী, তুই না কি পড়াশুনায় খুব ভাল, তা এই সোজা কথাটা জানিস্ না, যে ছেলেটার বাবা সদ‍্য মারা গেছে। আজ সবে শ্রাদ্ধ চুকতে না চুকতে তুই এই ভর সন্ধেবেলা ওর সাথে ছাতে বসে র‌ইলি, তাও আবার এলো চুলে? আমার তো ভাবতেই গা শিউরে ওঠে!
শ‍্যামলী বলল, আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না, এলোচুলে ছাতে গেলে কি হয়?
দাঁত কিড়মিড় করে এক প্রবীণা বললেন, বুঝতে পারছ না, তাই না? জানো না, সন্ধেবেলা তাঁরা সব ধারে পাশে থাকেন, ভরযুবতী মেয়েদের দেখলে…আমাদের তিন কাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, তবু আমরা কত সামলে সুমলে থাকি, আর তুমি বাছা এমনি আগুনপারা চেহারা, তুমি যে আস্ত নিচে নামতে পেরেছ, তোমার বাপ মায়ের অনেক পুণ‍্যি বলতে হবে।
 রমানাথ বললেন, পিসিমা, মারা যাবার পর মানুষের আর কিছু থাকে না। আগুনে তার দেহ পুড়ে যাবার পর তার হাত পা মাথা মুখ কিছু থাকে না। কোনো অস্তিত্ব‌ই থাকে না। তোমরা খামোকা ভাবনা করছ।
প্রথম প্রবীণা শিউরে উঠে বললেন, রমার মা, তোমার খোকার মাথাটা একেবারে আস্ত চিবিয়েছে গো, তারপর মুখে মুখে তর্ক করছে। ওরে বাবা দিষ্টিটা কি ভয়ানক হয়ে উঠেছে। রাম রাম রাম, গুরুদেব, রক্ষা করো।
একজন বৃদ্ধা বললেন, শুনেছি আজ নাকি তুমি প্রথম এবাড়িতে এসেচ, আর এসেই ছেলেটার সঙ্গে এতখানি মাখামাখি দেখতে মোটেই ভাল লাগল না। শুনেছি তোমার নাকি অনেক ছেলেবন্ধু আছে। মেয়েরা তোমাকে না কি পছন্দ‌ই করে না।
একজন ফুট কাটলেন, লোকমুখে শুনেছি, জানি না সত‍্যি কি না, বছরখানেক আগে দু দুটো সোমত্ত জোয়ান লোকের সাথে রাত কাটাবে বলে কলকাতার হোটেলে গিয়ে উঠেছিল।
শ‍্যামলী বলল, ভুল কিছু শোনেন নি। কথাটা কিন্তু ঠিক। তবে এটা পুরোনো গল্প। জ‍্যেঠিমা এটা জানেন। নতুন কেচ্ছা বলুন।
রমানাথ বলল, দাঁড়াও, ও আমার গেস্ট। কিছুতেই আসতে চাইছিল না। অনেক বলে কয়ে তবে এসেছে। তোমরা ওকে এভাবে অপমান করতে পারো না।
একজন প্রবীণা রমানাথের মাকে বললেন, তুমি তাই এমন ডাইনিকে ঘরের বৌ করবে ভাবছ, ছেলেকে তার হাতে তুলে দিচ্ছ, আমি হলে মুড়ো ঝ‍্যাঁটার বাড়ি মেরে বিদেয় করতাম।
শ‍্যামলী বক্তা মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, আজ্ঞে, ওই ভয়টি পাবেন না। আমি রমানাথকে বিয়ে করব না।
একজন বৃদ্ধা কটু স্বরে বললেন, তা বিয়ে করবে কেন বাছা, বিয়ে করলে তো এক একদিন এক একটা মায়ের বাছার মাথা চিবোনো যাবে না! অনেক মেয়ে দেখেছি। এমন ইতর আর অভদ্র জীবনে দেখিনি।
শ‍্যামলী রমানাথের দিকে ম্লান হেসে বলল, এবার আমি বাড়ি যাই। জ‍্যেঠিমা, আমি আসছি।
রমানাথ বললেন, শ‍্যামলী তুমি এভাবে যেতে পাবে না। চলো, আমি তোমাকে তোমার বাড়ি রেখে আসি।
শ‍্যামলী বলল, আজ থাক। ওঁরা আপনার শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন। আপনি ওঁদের চোখের সামনে থাকুন।
রমানাথ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, কি করলে মা তুমি, বিনা দোষে ওকে এভাবে গায়ে পড়ে অপমান করলে! আমি যে ভয় পেয়ে বীরুবাবুকে আসতে বারণ করেছিলাম, তার কাজটা তোমরা সবাই মিলে করে দিলে? মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে যাচ্ছে, তোমাদের সেটা ভাল লাগছে!
শ‍্যামলী উদ্দীপ্ত চোখে রমানাথের দিকে তাকিয়ে বলল, কর্মণ‍্যেবাধিকরস্তে মা ফলেষু কদাচন। মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্তকর্মণি।। যোগস্থ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত‍্যক্ত্বা ধনঞ্জয়। সিদ্ধ‍্যসিদ্ধ‍্যোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ‍্যতে।।
শ্রুতিবিপ্রতিপন্না তে যদা স্থাস‍্যতি নিশ্চলা। সমাধাবচলা বুদ্ধিস্তদা যোগমবাপ্স‍্যসি।।
ওঁদের কথায় আমি কোনো দুঃখ পাইনি রমানাথ। আমার কোনো কষ্ট‌ও হয় নি। আজ আপনার সাথে আমার যে কথা হয়েছে, তা আমি আনন্দের সাথে মনে রাখব। আচ্ছা, অনুমতি করুন, আমি আসি। ভাল থাকবেন সকলে।
বলে শ‍্যামলী বুকের কাছে হাত জোড় করে সামান্য একটু নত হল। তারপর বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়।
হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরে বাবার ঘরে গিয়ে দেখল, মা বাবা খুশি মনে গল্প করছে ন। মা বললেন,  শ‍্যামলিমা, আজ না তোকে খুব মিষ্টি লাগছিল।
রমানাথের মা তোকে খুব ভালোবাসে দেখলাম। সব সময় তোর সুখ‍্যাতি। ওবাড়ির সবাই তোর কত প্রশংসা করছিল। ক ঘণ্টার জন‍্য গিয়ে সবার মন জয় করে ফেলেছিস যে!
শ‍্যামলী একটু হাসল। বলল, মা দুঃখে উদ্বিগ্ন হতে নেই, আর সুখেও স্পৃহা রাখতে নেই। রাগ ভয় ক্রোধের বশবর্তী না হ‌ওয়া মানুষকেই চিরকালের ভারত শ্রদ্ধার আসনে রেখেছে। তারপর গান ধরল
সুখে আমায় রাখবে কেন, রাখো তোমার কোলে।
                   যাক-না গো সুখ জ্বলে ॥
          যাক-না পায়ের তলার মাটি,   তুমি তখন ধরবে আঁটি–
                   তুলে নিয়ে দুলাবে ওই বাহুদোলার দোলে ॥
                   যেখানে ঘর বাঁধব আমি আসে আসুক বান–
                   তুমি যদি ভাসাও মোরে চাই নে পরিত্রাণ।
হার মেনেছি, মিটেছে ভয়– তোমার জয় তো আমারি জয়
                   ধরা দেব, তোমায় আমি ধরব যে তাই হলে ॥
শ‍্যামলীর বন্ধ চোখের পাতা গলে জল পড়ছিল। বাসন্তীবালা ব‍্যস্ত হয়ে উঠলেন। শশাঙ্ক পাল নিজের ওষ্ঠে তর্জনী ঠেকিয়ে তাঁকে কথা বলতে নিষেধ করলেন। নিজের ঘরে সারা রাত একটার পর একটা গান গেয়ে চলল একটা মেয়ে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।