দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১১৪)
by · Published · Updated
পর্ব – ১১৪
শ্যামলী অনুভব করল মাথায় তার রক্ত ছুটছে। প্রচণ্ড রাগে ক্ষোভে তার ধমনীতে ঠেলে ঠেলে রক্ত পাঠাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। রক্ত ঠেলে উঠছে মাথায়। চোখ জ্বলছে। নাকে উষ্ণ নিঃশ্বাস। শ্যামলী স্থির করল যে করেই হোক নিজেকে শান্ত করতে হবে। শান্ত শময়িত। রেগে যাওয়া মানে অন্যের দোষে নিজেকে শাস্তি দেওয়া। বাথরুমে গিয়ে মুখে চোখে ঘাড়ে জল দিতে শুরু করল সে। জল দিতে দিতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল সে।
শ্যামলী, তুমি রাগ কমানোর ছলে নিজেকে ঠকাচ্ছ না কি?
প্রতিচ্ছবি বলল, রাগ পুষে রাখলে শরীরের ক্ষতি। আত্মার অবমাননা। রাগ না কমিয়ে উপায় কি?
শ্যামলী, তোমার কি মনে পড়ছে, শান্তু তোমার দাদা হওয়া সত্ত্বেও বোনাস বিতরণের দিন কারখানায় গিয়ে তোমার কাছে টাকা দাবি করেছিল। তুমি ভয় পেয়েছিলে শ্রমিকের বোনাসের টাকা শান্তু ছিনতাই করে নিতে পারে। তুমি টের পেয়ে গিয়েছিলে, ও তোমার হাতব্যাগ হাঁটকেছিল।
প্রতিচ্ছবি বলল, হ্যাঁ মনে আছে। আমার সেদিন খুব ভয় ভয় করছিল। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি ছিনিয়ে নিল টাকাগুলো।
শ্যামলী বলল, অথচ তুমি বাবাকে সে কথা বলোনি।
প্রতিচ্ছবি বলল, বলিনি, তার কারণ একাধিক। প্রথমতঃ, বাবা শান্তুকে কিছু বলতে পারত না। শ্রমিকদের যে ন্যায্য বোনাস দিতে হয়, বাবা সেটা নিজের আমলে এড়িয়ে গিয়েছেন। দ্বিতীয়তঃ, শান্তু তখনও কিছু করে নি। শুধু মতলব এঁটেছিল। ওকে এড়িয়ে আমি স্টিলের টিফিন কৌটায় টাকাটা পাচার করে দিয়েছিলাম।
শ্যামলী বলল, এটা তুমি একটা সাংঘাতিক রিস্ক নিয়েছিলে।
প্রতিচ্ছবি বলল, কিন্তু কৌশলটা খেটে গিয়েছিল। আমার ইনটুইশনটা দ্যাখো!
শ্যামলী বলল, তোমাকে যে শান্তু গায়ে হাত তুলেছে, এ নিয়ে তুমি প্রতিবাদ করতে পারতে।
প্রতিচ্ছবি বলল, কার কাছে করতাম বলো?
শ্যামলী বলল, এই যে তুমি ভাবছিলে ইন্দিরা গান্ধী জার্নেল সিং ভিন্দ্রানওয়ালেকে সন্ত্রাসবাদী হয়ে উঠতে দিয়েছিলেন, শিখ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেবেন না এই ছুতোয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে সেনাবাহিনী দিয়ে অভিযান করতে হল। সেই শিখ ধর্মস্থানে গুলি চলল, লোক মরল, বিদ্রোহ হল, শেষ অবধি নিজের প্রাণটা পর্যন্ত তিনি হারালেন!
প্রতিচ্ছবি বলল, কার সাথে কার তুলনা করছ! কোথায় ইন্দিরা গান্ধী আর কোথায় থার্ড ইয়ার গণিত অনার্স শ্যামলী পাল!
শ্যামলী বলল, ভাবো ভাবো, ভেবে দ্যাখো। তুমি শান্তুকে সাহস যোগাচ্ছ। ও ধরেই নিয়েছে শ্যামলীর উপর যা খুশি করো, ও কিছু বলবে না।
প্রতিচ্ছবি বলল, না তা নয়।
বাইরে থেকে মা দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। শ্যামলী গায়ে নাইটিটা গলিয়ে দরজা খুলে বলল, কি হয়েছে, চেঁচামেচি করছ কেন?
মা তার গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, কখন থেকে ডাকছি। তুই সাড়া দিচ্ছিলি না। এই দ্যাখ, আমার বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে।
আমাকে নিয়ে চিন্তা কম কোরো মা। আমি অঙ্ক করি। আবেগে ভেসে যাই না।
বাসন্তীবালা বললেন, হুঁ, পাকা বুড়ি হয়েছো। চল্, ওদের সবার খাওয়া হয়ে গেছে। এবার তোতে আমাতে খাব।
শ্যামলী বলল, মা আজ রাতে না হয় নাই খেলাম!
বাসন্তীবালা বললেন, দেখ্, এই না তুই বলছিলি, আমি আবেগে চলি না?
শ্যামলী বলল, না মা, এটা একটা ধিক্কার জানানো। একজনকে বলতে চাই, দ্যাখো, তুমি কতদূর নীচ হয়ে গিয়েছ। কতদূর গোঁয়ার মারকুটে হয়ে উঠেছ। আমি তোমার নিষ্ঠুর আচরণের নিন্দা করছি।
মা বললেন, নিচে চ, একটা জিনিস দেখাব।
মা শান্তুদের দোর আলতো করে ঠেলে দেখালেন, দুই ভাই দুজনে দুটি খাটে ঘুমোচ্ছে। তাদের নিঃশ্বাস পড়ার শব্দ শোনা যায়।
বাসন্তীবালা বললেন, হ্যাঁ রে শ্যামলিমা, এই দুটোকে তোর রাগ দেখাচ্ছিস! ওরা বুঝবে তোর রাগের মর্ম?
শ্যামলী বলল, এরা এমন কি করে হয়ে গেল মা?
ক্রমশ…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন