• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সিদ্ধার্থ সিংহ (পর্ব – ১১)

২০১২ সালের 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। ১৯৬৪ সালে। ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ই তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় 'দেশ' পত্রিকায়। প্রথম ছড়া 'শুকতারা'য়। প্রথম গদ্য 'আনন্দবাজার'-এ। প্রথম গল্প 'সানন্দা'য়। যা নিয়ে রাজনৈতিক মহল তোলপাড় হয়। মামলা হয় পাঁচ কোটি টাকার। ছোটদের জন্য যেমন সন্দেশ, আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী, চির সবুজ লেখা, ঝালাপালা, রঙবেরং, শিশুমহল ছাড়াও বর্তমান, গণশক্তি, রবিবাসরীয় আনন্দমেলা-সহ সমস্ত দৈনিক পত্রিকার ছোটদের পাতায় লেখেন, তেমনি বড়দের জন্য লেখেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এবং মুক্তগদ্য। 'রতিছন্দ' নামে এক নতুন ছন্দের প্রবর্তন করেছেন তিনি। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুশো চুয়াল্লিশটি। তার বেশির ভাগই অনুদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। বেস্ট সেলারেও উঠেছে সে সব। এ ছাড়া যৌথ ভাবে সম্পাদনা করেছেন লীলা মজুমদার, রমাপদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মহাশ্বেতা দেবী, শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, নবনীতা দেবসেন, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে। তাঁর লেখা নাটক বেতারে তো হয়ই, মঞ্চস্থও হয় নিয়মিত। তাঁর কাহিনি নিয়ে ছায়াছবিও হয়েছে বেশ কয়েকটি। গান তো লেখেনই। মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করেছেন বেশ কয়েকটি বাংলা ছবিতে। তাঁর ইংরেজি এবং বাংলা কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কয়েকটি সিনেমায়। বানিয়েছেন দুটি তথ্যচিত্র। তাঁর লেখা পাঠ্য হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদে। ইতিমধ্যে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, সন্তোষকুমার ঘোষ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, নতুন গতি পুরস্কার, ড্রিম লাইট অ্যাওয়ার্ড, কমলকুমার মজুমদার জন্মশতবর্ষ স্মারক সম্মান, কবি সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা।

এইবার লিখব

এগারো

বৃন্দাবনদার ছেলের অন্নপ্রাশনের চিঠি অনেক আগেই পেয়েছিল প্রতাপ। কিন্তু যেতে পারেনি। সে সময় একটা মাসিক পত্রিকার পঁচিশ বছর পূর্তি চলছিল। এক টানা তিন ধরে অনুষ্ঠান। সে সময়েই পড়েছিল বৃন্দাবনদার ছেলের অন্নপ্রাশন।
আসলে ওই পত্রিকার সম্পাদক পর পর কয়েকটা সংখ্যায় ওর দীর্ঘ কবিতা, গুচ্ছ কবিতা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছেন। অনুষ্ঠানে একদিন রাখা হয়েছিল কবি সম্মেলন। সেখানে ওকে কবিতা পাঠের জন্যও বলেছেন। কার্ডে নাম পর্যন্ত ছেপে দিয়েছেন। ওখানে না গেলে হয়!
ও না যাওয়াতে বৃন্দাবনদা বোধহয় একটু ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। কোনও চিঠিপত্র দিচ্ছিলেন না। একটা লোক তাকে দু’-দু’বার নিমন্ত্রণ করলেন, আর সে একবারও যেতে পারল না! একটা চিঠিও তো লেখা উচিত ছিল! ভীষণ খারাপ লাগছিল প্রতাপের।
দিচ্ছি, দেব, করতে করতেই কেটে গেল আরও কয়েকটা বছর। অবশেষে ও একদিন লিখল— কেমন আছেন? কোনও বইটই বেরোল? নতুন কী লিখছেন? আমি এ বার পুজোয় অনেকগুলো পত্রিকাতেই লিখছি।
চিঠি পেয়ে যেন আর তর সয়নি বৃন্দাবনের। সে দিনই লিখেছেন— ক’টা মাস খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে গেলাম। মাত্র এর রাতের জ্বরে আমাদের ছেড়ে মা চলে গেলেন। বাবা এখন এখানে। নদীয়ার পাট চুকিয়ে দিয়েছি। ওই বাড়িটা বিক্রি করে যা হাতে পেয়েছিলাম, তা দিয়ে এখানে একটা জমি কিনেছি। জানাশোনা ছিল। তাই জলের দরে পেয়ে গেছি। ছেলেটার কথা তো ভাবতে হবে। এর মধ্যে ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করেছি। সকালে কোনও রকমে রেডি হয়ে ওকে স্কুলে দিয়ে অফিস চলে যাই। ফেরার সময় একেবারে বাজার করে ফিরি। এক-আধটা সিনেমা-থিয়েটারও এখন আর দেখা হয়ে ওঠে না। যা দেখি, ওই টিভিতেই। বাচ্চাটাকে নিয়ে পড়াতে বসতে হয়। ছুটির দিনগুলোতে ওর তবলার ক্লাস থাকে। তোমার বৌদিরও তো কম ঝক্কি যাচ্ছে না। মাঝে মাঝেই কাজের মেয়েটা আসে না। খুব সমস্যায় আছি। ছেলেটা একটু বড় না হওয়া পর্যন্ত লেখায় হাত দিতে পারছি না। এত ডিস্টার্বেন্সের মধ্যে লেখা যায় না। কবিতা-গল্প না হয় ফাঁকফোকরে লিখে দেওয়া যায়। কিন্তু আমার তো উপন্যাস, ভাবনা-চিন্তা করে সময় নিয়ে বসতে হবে। এ ভাবে হবে না। তবে হ্যাঁ, আমি ঠিক করে ফেলেছি— এইবার লিখব।
চুটিয়ে লিখছিল প্রতাপ। ছোট বড় সব কাগজে। শুধু কবিতাই় নয়, কবিতার পাশাপাশি গদ্যও। লেখার জন্য এ কাগজ সে কাগজ থেকে টাকাও পেত। কোনও কোনও পত্রিকা আবার বাই পোস্টে চেক পাঠিয়ে দিতে বাড়িতে।
মা বলতেন, চাকরি যখন করবিই না, লিখে যখন পয়সা-কড়ি পাচ্ছিস, তখন লিখেই না হয় রোজগার কর। দু’-দিন পর বিয়ে করবি, ঘর সংসার হবে। তখনও কি তোর বাবা তোকে টানবে?
মায়ের কথাগুলো প্রতাপের একেবারে বুকে গিয়ে বিঁধত। কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারত না। বন্ধুরা শুনলে কী ভাববে! ওর বেশির ভাগ বন্ধুই তখন এখানে সেখানে চাকরি করে। ছুটিছাটার দিনে কেউ কেউ ওর বাড়িতেও আসে।
এমনই এক বন্ধু একদিন ওর বাড়িতে এসেছিল। প্রতাপ তখন ছিল না। প্রতাপের মা ওকে বসিয়ে চা-টা দিয়ে কথায় কথায় বলেছিল, ও তো তোমার বন্ধু, একটু বোঝাও না বাবা, ওর বাবার তো বয়স হচ্ছে, রিটায়ার হতে আর বেশি দেরি নেই। এখনও যদি না বোঝে! জানি, চাকরি-বাকরির বাজার খুবই খারাপ, তা বলে কি কারওরই চাকরি হচ্ছে না? অন্তত চেষ্টা তো করতে হবে।
ওই বন্ধুটা কাজ করত একটা খবরের কাগজে। ওর মা তাকে কী বলেছেন, সে কথা ঘুণাক্ষরেও প্রতাপকে জানতে দেয়নি সে। এর কিছু দিন পরে প্রতাপকে সে নিজে থেকেই যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল তাদের কাগজের নৃসিংহদার সঙ্গে। উনি তখন বুক রিভিউ সেকশন দেখতেন। ও সেখানে বই সমালোচনা করার সুযোগ পেতে থাকল নিয়মিত। মাঝে মধ্যে যেত। বই নিত। বাড়িতে এনে, পড়ে, সমালোচনা লিখে পৌঁছে দিত।
মাত্র ক’দিনেই বেশ মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাঁর সঙ্গে। তিনিই ধীরে ধীরে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ওই পত্রিকার অন্যান্য বিভাগের দায়িত্বে থাকা আরও অনেকের সঙ্গেই। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ও বেশ জমিয়ে নিয়েছিল। তখন শুধু বুক রিভিউ বা অনুষ্ঠান কভার করাই নয়, ওর লেখা বেরোতে লাগল অন্যান্য পাতাতেও। আর ওর লেখা যত বেরোতে লাগল, ওর বন্ধুরা ততই যেন ওকে নিয়ে নানা কটাক্ষ করতে লাগল। কেউ বলতে লাগল, ও কী এমন লেখে? ওটা কবিতা? ধান্দাবাজি করে কেউ বেশি দূর যেতে পারে না। কার নাম কোন কাগজে কত বড় টাইপে কত বার ছাপা হল, দু’-দিন পরে কেউ তা মনেও রাখে না। ওগুলো কিছুই নয়, আসল হল লেখা। আমি জানি, আমি যদি ভাল লিখতে পারি, একশো বছর পর হলেও, পাঠক ঠিক আমাকে খুঁজে নেবে।
এর মধ্যেই প্রতাপ জানতে পারল, পশ্চিমবঙ্গে সরকারের তথ্য ও সাংস্কৃতিক বিভাগ থেকে বাংলা আকাদেমির ব্যানারে তরুণ কবি-লেখকদের বই করার জন্য আর্থিক অনুদান দিচ্ছে। আর কালবিলম্ব না করেই, ওর যে সব কবিতা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বেরিয়েছিল, ও সেগুলো কেটে কেটে এ ফোর সাইজের পাতায় আঁঠা দিয়ে সেঁটে সেঁটে রাতারাতি তৈরি করে ফেলল চার ফর্মা, মানে চৌষট্টি পাতার একটি পাণ্ডুলিপি। এবং অবাক কাণ্ড, ও সেই অনুদান অবলীলায় পেয়েও গেল। প্রকাশিত হল, ওর প্রথম কবিতার বই— শোকপ্রস্তাব।
সরকারি অনুদান পেলেও প্রকাশক হিসেবে নাম দিল, ষাট দশকের অন্যতম কবি, কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত পত্রিকা— কবিপত্র-র নামে।
প্রতাপ বুঝতে পারছিল, সে যত ভাল ব্যবহারই করুক না কেন, তার বন্ধুরা তার কাছ থেকে একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে। ও টের পাচ্ছে, ও উঠে গেলেই ওকে নিয়ে নানান গসিপ হচ্ছে। ওর সম্পর্কে ওর বন্ধুরাই সব চেয়ে বেশি উল্টোপাল্টা কথা বলছে।
ও তাই সে সব জায়গায় যাওয়া আস্তে আস্তে কমিয়ে দিয়েছিল। সেই সময়টা ও দিচ্ছিল, ওই পত্রিকা অফিসে। সেখানেই একদিন ও খবর পায়, এ বার থেকে সপ্তাহে একদিন আলাদা চার পাতা করে একটা সাপ্লিমেন্ট হবে। সেটা ওই দৈনিক পত্রিকার সঙ্গেই বিনে পয়সায় বিলি করা হবে। পরে যদি ওটা ক্লিক করে, তা হলে ওই নামে আলাদা একটা কাগজ বের করারও পরিকল্পনা আছে পত্রিকা কর্তৃপক্ষের। তাই এটাকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছে ওরা। এক-একদিন এক-একটা বিষয় বাছা হবে। সেই বিষয়ের নানান দিক নিয়ে ফিচার। মাঝে মাঝে পাঁচ মিশালিও হতে পারে। দু’-একজন ফ্রেশ লোকও নাকি নেওয়া হবে সেখানে।
নৃসিংদার মুখে এ কথা শুনেই প্রতাপ বলেছিল, তাই নাকি? দায়িত্বে কে?
— না, এখানকার কাউকে নাকি দায়িত্ব দেওয়া হবে না। এখানকার বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট থেকে একজন-দু’জন করে ওখানে দিলেও, মূল দায়িত্ব নাকি দেওয়া হবে একদম আনকোরা ফ্রেশ কাউকে।
প্রতাপ বলেছিল, সে কী! এ রকম আবার হয় নাকি?
— তা হলে আর বলছি কি… আসলে আমার মনে হয়, ম্যানেজমেন্ট চাইছে একদম ফ্রেশ ভাবনা-চিন্তার কাউকে। যে একদম নতুন করে কিছু করতে পারবে। একেবারে অন্য রকম কিছু।
— এ আর এমন কী কাজ, দু’দিন দেখলেই তো… কথা শেষ হয়নি প্রতাপের। তার আগেই নৃসিংহদা বলেছিলেন, আর ইউ ইন্টারেস্টেড?
— আমাদের আর কে চাকরি দেবে?
— তুমি করবে? হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন উনি।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।