একছুটে রান্নাঘরে পৌঁছে শ্যামলী বলল, কি হয়েছে বলো!
মা বললেন, এই কাঠের বারকোষে পাথরের থালায় ফল সাজিয়েছি। আর এই পাথরের গেলাসে শরবত। সাবধানে নিয়ে চ। পিছন পিছন আমরা যাচ্ছি।
শ্যামলী বলল, আচ্ছা, তোমরাই যদি আসছ, আমাকে ডেকে পাঠালে কেন?
শ্যামলীর কথা শুনে ঝঙ্কার দিয়ে সবিতাপিসি বলল, আহা, নেকুপুষুমুনু, জানো না যেন কেন! শ্যামলী তাকিয়ে আছে দেখে, বাসন্তীবালা নিচু গলায় বললেন, রমা অনেকক্ষণ এসেছে। কতবার বলছি, একটু কিছু মুখে দাও। কিছুতেই রাজি নয়। শেষে তোর নাম করে বলল, ও এসে দিলে খাব।
শ্যামলী নিচু স্বরে বলল, বাহ্, বেশ আবদার তো। তারপর কাঠের বারকোষে পাথরের থালা গেলাস বাগিয়ে নেবার আগে শাড়ির আঁচল সামলে কোমরে গুঁজল।
সবিতাপিসি ধমকের সুরে বলল, মোটে তড়বড় করবিনি। একফোঁটা শরবত যেন চলকে না যায়। শ্যামলী পা টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে শ্রীমতী রাধিকার অভিসারের পদ মনে করে হেসে ফেলল। সবিতা চাপা স্বরে ঝামরে উঠল, এত হাসির কি হয়েছে রে!
ঘরে ঢুকে সবিতা শ্যামলীকে বলল, দাঁড়া। এই বলে একটা টি টেবিলের উপর একটা রেশমি রুমাল বিছিয়ে তার উপর বারকোষ নামিয়ে রাখার ইঙ্গিত করল।
বাসন্তীবালা রমানাথের দিকে সস্নেহে চেয়ে বললেন, একটু কিছু মুখে দাও বাবা, মেয়ে আমার নিজের হাতে করে এনেছে।
রমানাথ খেতে শুরু করলে শ্যামলী তার কাছে জানতে চাইল , জ্যেঠুর যে ধনুষ্টঙ্কার হয়েছিল বলছেন, টিটেনাস টকসয়েড দেবার পরেও হল?
শশাঙ্ক পাল মেয়েকে ইঙ্গিত করলেন রমানাথকে তার বাবার মৃত্যুর ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা না করতে।
রমানাথ বললেন, বাবা তো অ্যালোপ্যাথি ওষুধ পছন্দ করতেন না। চিরকাল হোমিওপ্যাথি আর বায়োকেমিকই ভরসা।
শ্যামলী বলল, কেটে গেলে তো টিটেনাস টকসয়েড দেবার কথা!
সবিতা শ্যামলীকে ধমক দিল, তুই থাম দিকি বাপু! সবজি কাটতে গিয়ে আমাদের কতবার কাটাকুটি হয়। সে কি আর বলার মতো কথা? ছোটবেলা থেকে জানি কেটে গেলে দুর্বো ঘাস চিবিয়ে লাগিয়ে দিতে হয়। তারপর ওই গাঁদাফুলের পাতা থেঁতো করে রস লাগিয়ে দিলেও হয়।
বাসন্তীবালা বললেন, বনতুলসীর আঠা দিলেও কাজ হয়।
শশাঙ্ক বললেন, কেউ কেউ বনতুলসীকে চুরচুরিও বলে। আমাদের দেশের গাছগাছালির অনেকগুণ।
শ্যামলী রমানাথের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, জ্যেঠুর কী চিকিৎসা হয়েছিল?
রমানাথ বললেন, আমাকে বাবা মা কেউ কিছুই বলেন নি। জানলে তো ডাক্তার দেখাতাম।
শ্যামলী বলল, এই যে বললেন, জ্যেঠু হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ছাড়া পছন্দ করতেন না, তো কোনো হোমিও ওষুধ দেওয়া হয়েছিল?
রমানাথ বললেন, কাটা ছেঁড়ায় রক্তপাত রুখতে হোমিওপ্যাথি ওষুধ যে নেই তা তো নয়, ক্যালেণ্ডুলা অফিসিনালিস মাদার টিংচার কাটা জায়গায় লাগানো যায়। ওই সাথে ক্যালেণ্ডুলা থার্টি খাওয়া চলে।
শ্যামলী বলল, কি ওষুধ দিয়েছেন সেটা জানতে চাই। ধনুষ্টঙ্কার এর দিকে গেল কেন?
শশাঙ্ক পাল অস্থির হয়ে বলে উঠলেন, তুই থাম্ দিকি! কেন , কি হয়েছে, এতকিছু বলার মনের অবস্থা কি ওর এখন আছে?
বাসন্তীবালা বললেন, বিধাতাপুরুষ যে কার কপালে কতদিন আয়ু লিখে রেখেছেন, তা কি আর জানা যায়!
শ্যামলী মায়ের দিকে মুখ টিপে হেসে উঠে বলল, মা ঠিক জানো, বিধাতা একজন পুরুষ। মোটেও নারী নন?
সবিতা শ্যামলীকে ধমকে উঠে বলল, একটা সিরিয়াস কথা হচ্ছে, তার মধ্যে তুই বিধাতা ব্যাটাছেলে না মেয়েছেলে, সেই ফুট কাটছিস!
শ্যামলী বলল, শোনো পিসি, মাটিতে ক্লসট্রিডিয়াম টিটানি নামে একটা ব্যাকটিরিয়া থাকে। ওই থেকে টিটেনাস অসুখটা হয়। বাংলায় ওকেই ধনুষ্টঙ্কার বলে। র্যাশনাল চিকিৎসা, মানে যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসা করতে হলে, কেটে গেলে টিটেনাস টকসয়েড দেওয়া দরকার।
শশাঙ্ক পাল বললেন, শ্যামলিমা, এতটা শোকের মধ্যে আর ওসব নিয়ে কাটাছেঁড়া নাই বা করলি। যে যায়, সে তো আর ফিরে আসে না।
শ্যামলী বলল, বাবা, রমানাথ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। শুধু তাই নয়, প্রাপ্তমনস্কও বটে। আমার সাথে কথা বলবেন বলেই বসে আছেন শুনেছি। একটা জিনিস সম্পর্কে আবছায়ায় থাকলে ভুল ধারণা জন্মায়। তাই ওঁর নিজের পক্ষেও ডিটেলে আলোচনা করে বুঝে নেওয়া উচিত।
রমানাথ বললেন, বাবা বা মা কেউ আমাকে কি হয়েছে কিছুই বলেন নি। আমি জানতে পেরেছি একেবারেই শেষ মুহূর্তে। অ্যাম্বুলেন্সটাও ডাকতে পারি নি। গাড়ি করে নিয়ে যেতে যেতেই বাবা আমার কোলে নিস্তেজ হয়ে ঢলে পড়েন।
রমানাথ বললেন, শুনেছি বাবার কেটে গিয়ে রক্ত বাঁধ মানছিল না বলে, মা আশ্রমে ফোন করেছিল। আশ্রম থেকে ওষুধ পাঠিয়ে দিয়েছিল।
শ্যামলী সোফার উপর মেরুদণ্ড সিধে করে বসে বলল, ওষুধটা কে দিয়ে গিয়েছিল?
রমানাথ মৃদুস্বরে বলল, বীরুবাবু। পরে জানতে পেরেছি, আমার অজান্তেই লোকটা আমাদের বাড়িতে আসত যেত।
শশাঙ্ক বললেন, বীরুর হাত দিয়ে আশ্রম থেকে ওষুধ পাঠাল?
রমানাথ বলল, আপনাদের গুরুদেব অ্যারেস্ট হয়ে যাবার পর থেকে উনিই এখন টাউন ব্রাঞ্চের হর্তাকর্তা বিধাতা।
শ্যামলী মুহূর্তের জন্য থমকে রইল। তারপর বলল,
আপনি বীরুবাবুর এগেনস্টে ফৌজদারি কেস করুন। তিনশো দুই ধারায় নরহত্যার মামলার চার্জ। এফ আই আর হবে পুলিশের কাছে। সিআরপিসির একশো চুয়ান্ন ধারায়। পুলিশ ইনভেসটিগেশন করে তিনশো দুই ধারায় চার্জ দেবে।
রমানাথ মাথা নেড়ে বলল, সে হয় না।
শ্যামলী বলল, কেন হয় না, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, লোকটা আপনার বাবা মায়ের সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে এই কাণ্ড করেছে।
রমানাথ বলল, মা ওদের বিরুদ্ধে কিছু বলতেই দেবে না। বাবা মারা গিয়েছে আমার। আর কতদিন অশৌচ হবে, কি কি করা হবে, বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধ হবে, সব ঠিক করে রেখেছে ওরা! এমনকি কার্ডটা পর্যন্ত ছাপিয়ে হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। মা ওদের উপর সব দায় দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছে।
শ্যামলীর মনে পড়ল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা সারদা দেবীর কথা। তাঁর হাতে ছেঁচে গিয়েছিল বাক্সের ডালা পড়ে। তখন এক আচার্যানীর পরামর্শে খয়ের দেওয়া হয়েছিল। তাইতে বিষিয়ে যায়। পরে অনেক ডাক্তার দেখিয়েও কিছু হয় নি।
বাবার দিকে তাকিয়ে শ্যামলী বলল, এইসব আশ্রমগুলো সমস্ত রকম ক্রিমিনালের আখড়া। এরা সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়া থেকে শুরু করে ধর্ষণ, গুমখুন, যতো রকম ক্রিমিনাল অ্যাকটিভিটি হতে পারে, সব কিছু করতে অভ্যস্ত। গনগনে দুটো চোখে শ্যামলী বলে, শুধু আশ্রম বলি কেন, সমস্ত রকম ধর্ম মানুষের ক্ষতি করে, ধর্মই মানবতার সবচেয়ে বড়ো শত্রু।