নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণ মানুষের চিরকালের। তাই এই পরীক্ষার মরসুমে ফিরে ফিরে আসছে সেই সব স্মৃতি। আপাত গর্হিত মনে হলেও সেটা ছিল স্বাভাবিক এক প্রক্রিয়া। আরে হ্যা, ‘টুকলির’ কথাই বলছি,যেটা ছাড়া পরীক্ষার গল্প নৈব নৈব চ।
এক বাচ্চা ছেলে গ্রামের স্কুল থেকে ফোর পাশ করে শহুরে স্কুলে ভর্তি হলো। শহুরে স্কুলের ব্যাপার স্যাপার মাঝে মাঝে কেমন নতুন ও আলাদা ঠেকতো। দেখতে দেখতে পরীক্ষাও চলে এলো, দু হাফে চলছে পরীক্ষা ১০-১ টা আর ২-৫ টা। আমার যথারীতি প্রথম হাফে, নিয়ম মতো পরীক্ষার আগেই স্কুলে চলে এসেছি, রোল নাম্বার মিলিয়ে নিজস্ব সিট দখল করে বসে বই খাতা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করছি। এর মধ্যে দেখি এক হোমরা চোমরা দাদা গোছের ছেলে, হাতে তার বালতি। ছোটো মাথায় কিছুই ঢুকছে না। আমার কাছে এসে বললো একটু সরে বোস, ভয়ে ভয়ে সরে এলাম দেওয়ালের ধার হতে। দেখি দেওয়ালের ধারে গিয়ে, বালতিতে রাখা চুন, তুলি দিয়ে দেওয়ালে সফেদি কি চমক চলছে। আমার জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে বললো আরে সেকেন্ড হাফে আমার পরীক্ষা, দেওয়ালে লেখার কোনো জায়গায় বাকি নেই, ফলে নিজের সিটের আশেপাশে একটু চুনকাম করা, যাতে পরে এসে লিখতে পারি। যাওয়ার সময় পিঠ চাপড়ে আমাকে বললো তোরও তো এখানেই পরেছে, চাইলে তুই ও একটু, তবে বেশি নোংরা করিস না। সত্যি, সেদিনের সেই দাদার উক্তি এখনো কানে বাজে। তবে কে জানতো যে পিকচার অভি বহত বাকি হ্যায়।
তখন ক্লাস ফাইভ কি সিক্স, সাথে পরীক্ষা চলছে নাইনের দাদাদের। পরীক্ষা শুরুর একটু আগেই দেখলাম, তিন চার জন দাদা প্যাকেট থেকে কি সব বের করছে, দেখি কিসের পাতা, প্যাকেট খুলতেই নাকে তার গন্ধ লাগলো। তারা পাতা গুলোকে যথেচ্ছ ভাবে সামনের দুদিকের বেঞ্চে ও টিচারের টেবিলের তলায় চালান করে দিলো, শুধু চেয়ারটা থাকলো পত্রমুক্ত। নাকে এর গন্ধ লাগলেও এসব কথা বলা বারন। পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর স্যার খাতা ও প্রশ্নপত্র দিয়ে চেয়ারে বসতেই তার নাকে ঠেকলো এই উৎকট গন্ধ। একটু পরেই নাক সিটকিয়ে বললেন, তোরা না, পরীক্ষার আগে কেউ এতো রিচ খায়, আর গার্জেনদেরও বলিহারি, এরকম গ্যাসীয় অবস্থায় পরীক্ষা দিবি কি করে? সারা ক্লাসের উদ্দেশ্যে বলে তিনি চেয়ারটি নিয়ে ক্লাসের বাইরে গিয়ে বসলেন। ব্যাস আর যায় কোথায়, পুরো ১০০ তে ১০০, ক্লাসে চলতে থাকলো অবাধে টোকাটুকি। সেই আপাত নিরীহ লতা গাছটিকে কম বেশি সবাই চেনেন, তার আয়ুর্বেদিক গুনাগুনের থেকে তার উৎকট গন্ধের জন্য। হ্যা, ঠিক ধরেছেন গাঁদাল বা গন্ধভাদালি তার নাম। পরে শিবকালীবাবুর চিরঞ্জীবী বনৌষধি অনেক ঘেঁটেও এ গাছের এই অভিনব উপকারিতা খুঁজে পায়নি।
একবার পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়েছি, দেখি স্কুল মাঠে ছোটো জটলা, ছুটলাম সেই দিকে। দেখি দুই উঁচু ক্লাসের দাদা কথা বলছে, তারা তখন সত্যিই স্কুলের দাদা। কিন্তু কথাবার্তায় কেমন হেরো হেরো ভাব, মনোযোগ দিতেই বুঝলাম কেসটা। একজন অপরজনকে হিন্দি ঘেসা বাংলাতে বলছে, মায়ের দিব্বি, সব ছিলো লেকিন ঝাড়তে পারলাম না। আরো এগিয়ে গেলাম ভিড় ঠেলে, বলছে বাংলা পরীক্ষার সব উত্তর মজুত ছিল সারা শরীরে। সাথে একটা কাগজে ছিল তার ইনডেক্স ও তার অ্যাবরিভিয়েশন কিন্তু কাগজটি কোথায় পড়ে যায় আর এই বিপত্তি। কিন্তু কি ছিল কাগজে? যা শুনেছিলাম তাই তুলে দিচ্ছি
M.N ( মোজার নীচে) রচনা,
P.P ( পিছনের পকেট) ভাবসম্প্রসারণ,
B.T( বেল্টের তলায়) ব্যাকরন
J.V (বুঝে নিন,এ অন্দর কি বাত হ্যায়) ই টু বি।
অন্যদের নিয়ে অনেক কথা হলো এবার বাংলায় মানে নিজের কথায় ফিরে আসি। তবে এতে টুকলি নেই, নেহাতই নিজের পরীক্ষা কেন্দ্রিক নির্বুদ্ধিতার কাহিনী। সবে তখন ফাইভ, সামনে হাফইয়ার্লি পরীক্ষা, মাঝে একদিন স্কুল যায়নি, পরের দিন স্কুলে গিয়ে শুনলাম গতকাল পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে। ফলে পাশে বসা বন্ধুর কাছ হতে গতকাল দেওয়া রুটিনটা টুকলাম, টুকতে গিয়ে দেখলাম রুটিনে ভুগোল নেই। ওকে জিজ্ঞাসা করাতে বললো যে ভুগোল পরীক্ষা হবে না। মনে মনেই ভাবলাম যে ক্লাসে ভুগোল পড়াও বেশি হয়নি, সেজন্যই হয়তো। যাক একটা পরীক্ষা থেকে তো রেহাই। যথারীতি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো, বাংলা ইংরেজি শেষ, আজ ইতিহাস। স্যার খাতা দেওয়ার পর নাম, রোল, বিষয় সবই লিখে ফেলেছি। প্রশ্নপত্র পেয়ে, এ কি, ভুগোল প্রশ্ন। আমার মধ্যে পৃথিবীর ঘূর্ণন শুরু হলো, সে ব্যাটাও ক্লাসে, কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, এ কি রে, সে কাচুমাচু করে বলে আমিও তো পড়ে আসিনি। সেদিন বুঝেছিলাম পড়ার সাথে সাথে পরীক্ষার রুটিনও ভালো ছেলের কাছ হতে টুকতে হয়।